প্রবাসী বাঙালি। পরিচালক। ভুটান, জার্মানি, মুম্বই শহরেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। অথচ শিকড় জুড়ে রয়েছে এই বাংলাতেই। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই শহরের কয়েকটি পুজো দেখেছেন। সেই পুজো, সেই শহর, আর সেই উৎসবের পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে অকপট আড্ডায় চিত্র পরিচালক ওনির।
প্রশ্ন: বাঙালি হয়েও কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক এখন আর ঘনিষ্ঠ নয়, পুজোর সময়ে কি মনখারাপ হয়?
ওনির: আমায় কিন্তু কলকাতার বাঙালি বললে ভুল হবে। আমি ছোট থেকেই বাইরে থেকেছি। ভুটান আমার জন্মস্থান। ওই জায়গায়কেই বাড়ি বলে জানতাম ছোট থেকে। তার পর যেমন এখন মুম্বইকেই বাড়ি বলে জানি। মাঝে অতগুলো বছর জার্মানিতে পড়াশোনা… তবে তারই মাঝে কলকাতার সঙ্গে যে স্বল্প দিনের সম্পর্ক, তা বেশ স্বপ্নময় ছিল বটে। যতটুকুই হোক, সুন্দর ছিল।
প্রশ্ন: তাই আলাদা করে ‘পুজো বলতে কলকাতা’ বাক্যটি আপনার ক্ষেত্রে খাটবে না?
ওনির: না, কারণ কলকাতার পুজো দেখেছি কমই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়ার সময়ে কেবল শহর আর পুজোর যোগসূত্র আমার সামনে ছিল। তবে হ্যাঁ, আনন্দ করেছি সে সময়টা। কিন্তু সেটা কেবল পুজো বলে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা খুবই আনন্দের ছিল। গোটাটাই।
প্রশ্ন: কলকাতার দুর্গাপুজো আর এখন অন্যান্য শহরের পুজো...
ওনির: ভুটান বা জার্মানিতে তো সেই ভাবে এত দুর্গাপুজো হয় না। সংখ্যাটা খুবই কম। তবে মুম্বইয়ে সত্যিই মজা করি আমরা। বন্ধুরা মিলে সেজেগুজে প্যান্ডেলগুলি দেখতে যাই। যত বড় বড়, এবং ছোট পুজো হয়, চেষ্টা করি এক বার অন্তত ঘুরে নিতে। তবে পুজোর সময়ে বেড়াতে যেতে বেশি পছন্দ করি।
কলকাতার সঙ্গে যে স্বল্প দিনের সম্পর্ক, তা বেশ স্বপ্নময় ছিল বটে। ছবি: ফেসবুক
প্রশ্ন: তা হলে পুজো মানেই আনন্দে গা ভাসিয়ে দেওয়া নয় আপনার কাছে।
ওনির: আসলে পুজো কিন্তু আমার কাছে উৎসব। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু আমার আক্ষেপ একটাই, পুজোয় সবার এক রকম অধিকার নেই। সমকামী হোন বা প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষ, তাঁরা কি একই ভাবে পুজোয় জায়গা পান?
প্রশ্ন: আপনি কি বলছেন, পুজো 'সাতরঙা' হয়ে উঠতে পারেনি?
ওনির: আমার কাছে তো পুজো 'সাতরঙা'। সমকামী, প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচয়ের সমস্ত মানুষের জন্যই এই পুজো খুব জরুরি। কিন্তু সমস্যা হল, আমি এমন কোনও পুজোর খবর এখনও পাইনি, যেখানে এই সব মানুষই দায়িত্বের প্রথম সারিতে রয়েছেন।
প্রশ্ন: অনেক জায়গায় তো বাড়ির পুজোয় দায়িত্ব নিয়েছেন সমাজ নির্ধারিত ছকের বাইরে থাকা মানুষেরা…
ওনির: বাড়ির পুজোর কথা থাক, তার বাইরে? এই যে কলকাতা শহরে এত বড় বড় প্যান্ডেল, জনপ্রিয় সব মণ্ডপ, সেখানে স্থান পেয়েছে সবাই? পায়নি। তাই আমি চাই, এর পর থেকে শহরের এমনই এক বিখ্যাত পুজোর দায়িত্বে থাকুন সমকামী থেকে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষেরা। তবে সময়টা যে বদলাচ্ছে, তার অল্পবিস্তর প্রমাণ মেলে বইকি।
প্রশ্ন: কী ভাবে?
ওনির: পুজোর রীতিনীতিতে ধীরে ধীরে অন্তর্ভুক্তি ঘটছে। যেমন প্রান্তিক লিঙ্গ এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সিঁদুরখেলায় অংশ নিতে দেখা যায়। বা উৎসবে বহু পুরুষ (সমকামী হোন বা না হোন) শাড়ি বা তথাকথিত নারীদের পোশাকে সাজছেন আজকাল। সে সবকে খোলা মনে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন: তা হলে কি আপনার কাছ থেকে নতুন ছবি বা নতুন চিত্রনাট্য উপহার পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে? পুজো নিয়ে? বাংলা নিয়ে?
ওনির: (হেসে) না না সে ভাবে পুজো নিয়ে কখনও ছবি বানানোর কথা মাথায় আসেনি।
প্রশ্ন: দুর্গাপুজোকে তো নানা ভাবে সিনেমায় দেখানো হয়েছে। ‘কহানি’ বলুন, ‘বিসর্জন’ বলুন, আপনার ভাবনায় পুজো যদি প্রেক্ষাপট হয়? যা যা আফসোস রয়েছে, সে সবই তো বলতে পারবেন তাতে।
ওনির: হয়তো। কখনও। কোনও দিন। তবে এখনও আসেনি সে ভাবে কিছু। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলে রাখি, আমি যদি কলকাতা শহর নিয়ে ছবি বানাই, কয়েকটা জায়গা বা কয়েকটা জিনিস ফ্রেমে কখনওই আসবে না।
সমকামী, প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচয়ের সমস্ত মানুষের জন্যই এই পুজো খুব জরুরি। ছবি: ফেসবুক
প্রশ্ন: যেমন, ভিক্টোরিয়া?
ওনির: (হেসে) ঠিক ধরেছেন। তার সঙ্গে হাওড়া ব্রিজ, টানা রিকশা, হলুদ ট্যাক্সি— প্রবাসী বাঙালি বলে কলকাতায় পা রেখে কেবল এইগুলো আমার চোখে পড়বে, তা নয়। আমি শহরটাকে চিনি। অন্য ভাবে। সে ভাবেই আমার লেন্সে ধরা পড়বে। কিন্তু জানি না, আমায় কি গ্রহণ করবে বাংলা?
প্রশ্ন: সে কী! আপনার মতো পরিচালককে মানুষ গ্রহণ করবেন না? সব দর্শক হয়তো করবেন না, কিন্তু…
ওনির: কেবল দর্শকের কথাই বলছি না। ইন্ডাস্ট্রি। এমন একটি আশঙ্কা আমার মাথায় আছে। মনে হয়, বহিরাগতদের হয়তো সে ভাবে মেনে নিতে অসুবিধাও হতে পারে একাংশের। এমন কিন্তু নয় যে, আমি বাংলা ছবি একেবারেই দেখি না। যেমন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি আমি অনেক দেখেছি। আরও অনেক পরিচালকের ছবি দেখেছি। সম্প্রতি যে ছবি রটারডাম চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল, ‘নধরের ভেলা’, সেটিও দেখব বলে ঠিক করেছি।
প্রশ্ন: তা হলে আমাদের অপেক্ষার অবসানটা এ বারে হয়েই যাক। আপনাকেও এখানে টলিউডের পরিচালক হিসেবে দেখতে চান অনেকেই।
ওনির: বেশ, নিশ্চয়ই এক দিন ছবি বানাতে কলকাতা শহরেই ফিরব আমি। আশা থাকুক তেমনই। দুর্গাপুজোর এই শুভ উপলক্ষে তেমনই স্বপ্ন দেখা শুরু হোক। (হেসে) না কি?