প্রতীকী ছবি।
কী জ্বালা! আশে পাশে কী হচ্ছে দেখতে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই! দরজার কব্জায় জং ধরে গেলে যেমন খুলতে বা বন্ধ করতে অসুবিধা হয়, ঘাড়ের অবস্থা প্রায় তেমন। কোমরের অবস্থাও তথৈবচ! সমীক্ষা বলছে জীবনের কোনও না কোনও সময় প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৬০ থেকে ৮০ জন পিঠ বা ঘাড়ের ব্যথায় কষ্ট পান। এদের বেশির ভাগই মধ্য বয়সী, ৩৫ থেকে ৬০ বছর। আমদের মাথা উঁচু করে চলার জন্যে শিরদাঁড়া ঋজু আর টানটান থাকা দরকার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে মেরুদণ্ডের অসুবিধা হলে ঘাড়, পিঠ আর কোমরের ব্যথায় কাতর হতে হয়। এই ব্যথার এক অন্যতম কারণ স্লিপ ডিস্ক বা ডিস্ক হার্নিয়েশন।
ঠিক কী হয়
ডাক্তারি নাম ভাটিব্রা অর্থাৎ কশেরুকা। ২৬টি ছোট্ট ছোট্ট হাড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি আমাদের মেরুদন্ড অর্থাৎ ভাটিব্রাল কলাম। দুটি কশেরুকার মাঝখানে থাকে ছোট্ট কুশনের মতো ডিস্ক। হাঁটাচলা, শোওয়া বসা সহ নানান কাজকর্মের সময় হাড়ে হাড়ে যাতে ঘষাঘষি লেগে হাড় ক্ষয়ে না যায়, তার জন্যে এই ডিস্ক। এর মধ্যে রয়েছে নরম জেলির মতো এক বিশেষ পদার্থ। এই ডিস্ক না থাকলে রোজকার কাজকর্মের ফলে হাড়ের টুকরো ঘষে গিয়ে ক্ষয় হয়ে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে ভয়ানক ব্যথায় কাতর হতে হয়। ডিস্ক দুটি হাড়ের টুকরোকে ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করে। ভারী জিনিস তোলা, দুর্ঘটনা সহ নানান কারণে ডিস্কের মধ্যের জেলির সামান্য অংশ বাইরে বেরিয়ে যায়। এরই নাম ডিস্ক হার্নিয়েশন বা স্লিপ ডিস্ক। শুধু বেড়িয়ে চুপচাপ বসে থাকে না। হাঁটা চলা বা কাজকর্মের সময় চাপ দেয় নার্ভের ওপর। আর এর ফলেই সাংঘাতিক ব্যথার প্রকোপ।
আরও পড়ুন: মুখের ক্যানসারের এই ৮ লক্ষণ সম্পর্কে সতর্ক থাকুন
ব্যথা যে পিঠ জুড়ে
ঘাড় আর কোমরের ব্যথায় আমরা বেশি কাতর হই। কেন না, মেরুদণ্ডের এই অংশ দুটিরই বেশি নড়াচড়া হয়। তাই ডিস্কের পিছলে যাওয়ার ঝুঁকি এই দুই অঞ্চলেই বেশি। ঘাড়ের ডিস্ক স্লিপ করলে বেশিরভাগ মানুষেরই ঘাড়ে ভয়ানক ব্যথা হয়। এই ব্যথা কাঁধ হয়ে হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। হাত ঝিন ঝিন করে। আর কোমরে স্লিপ ডিস্ক হলে হাঁটাচলা করাই দায় হয়ে পড়তে পারে। কোমরে তীব্র ব্যথা ঊরু হয়ে পায়ের নীচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। শুরুতে অল্প অল্প ব্যথা হতে পারে, ক্রমশ ব্যথার তীব্রতা বাড়ে। তবে অনেক সময় আবার ডিস্ক স্লিপ করেও জানান দেয় না। চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মধ্যে একটু আধটু চিনচিনে ব্যথা হয়। নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় অসহ্য নিউরোপ্যাথিক পেন। এই ব্যথা রোগীকে শয্যশায়ী করে দেয়। তাই কোনও রকম সমস্যা হলে বিশেষজ্ঞ চিকিসককে দেখিয়ে নেওয়া ভাল।
আরও পড়ুন: যখন ঘুম আসে না
রিস্ক ফ্যাক্টর
সামনে ঝুঁকে ভারী জিনিস তোলা ডিস্ক হার্নিয়েশনের অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর। অটো, বাস অথবা রিকশার ঝাঁকুনিতে আন নোটিশড চোট (যা চট করে বোঝা যায় না), অতিরিক্ত পরিশ্রম, মাসল বা পেশীতে আঘাত সহ দুর্ঘটনায় চোট, মেরুদন্ডের জন্মগত ও গঠনগত ত্রুটি, বেশি বয়সে হাড় ক্ষয়ে গিয়ে ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিজ, ফ্যাসেট আর্থ্রোপ্যাথি, স্যাক্রোইলাইটিস সহ নানান সমস্যা কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ককে স্থান চ্যুত করে দিতে পারে, আর এর ফলেই পিঠ, কোমর ও ঘাড়ের ব্যথায় কাবু হতে হয়।
দাদা, ভাইরা সাবধান
যে কোনও বয়সের মানুষের যে কোনও সময়ে ডিস্ক হার্নিয়েশনের ঝুঁকি থাকলেও ছেলেদের ঝুঁকি মেয়েদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আসলে ভারী কাজ, বৃষ্টি ভেজা পিছল মাঠে ফুটবল পেটানো, সাইকেল নিয়ে কসরত করা বা অতিরিক্ত দৌড় ঝাঁপ করার কারণে এই অসুখের সম্ভাবনা বাড়ে। ইদানীং আবার প্রপার ট্রেনার ছাড়া জিম ও ওয়েট লিফটিং করতে গিয়েও স্লিপ ডিস্কের ঝুঁকি বাড়ে। ৩৫ ঊত্তীর্ণদের মধ্যে ৫% পুরুষ ও ২.৫% মহিলা এই অসুখের শিকার হন। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে বংশে থাকলে এই অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। তবে নিয়মিত শিরদাঁড়ার সঠিক এক্সারসাইজ ও যত্ন এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।
ইন্টারভেনশন পদ্ধতিতে স্লিপ ডিস্কের চিকিৎসা
পিঠ, কোমর অথবা ঘাড়ে ব্যথার প্রচলিত চিকিৎসা সার্জারি। তবে অস্ত্রোপচার করেও অনেক সময় অসুখটা ফিরে আসার ঝুঁকি থাকে। ৫০% ক্ষেত্রে একাধিক বার অপারেশন করাতে হয়। ইদানীং ইন্টারভেনশনাল পেন ম্যানেজমেন্টের সাহায্য নিয়ে স্লিপ ডিস্কের ব্যথা ভ্যানিশ করা হচ্ছে। কলকাতাতেই এই চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। ইন্টারভেনশনাল বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে এপিড্যুরাল ইঞ্জেকশন, এপিডুরাল ব্লক, নার্ভ রুট স্লিভ, এপিড্যুরোলাইসিস ও ওজোন ডিসেকটমি। এদের মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় হল ওজোন ডিসেকটমি। এই পদ্ধতিতে সাফল্যের হার ৯০%, খরচ প্রচলিত সার্জারির তুলনায় দশ ভাগ কম। এই পদ্ধতিতে কোনও রকম কাটাকুটি ছাড়াই সূক্ষ্ম ক্যাথিটারের সাহায্যে রোগীর পিছলে যাওয়া জেলির ডিস্কের মধ্যে ওজোন গ্যাস প্রবেশ করানো হয়। এর জন্যে রোগীকে অজ্ঞান করারও দরকার পড়ে না। ওজোনের অ্যাকটিভ অক্সিজেন অ্যাটম নিউক্লিয়ার পাল্পোসাসের মধ্যের প্রোটিও গ্র্যালাইকান ব্রিজটি ভেঙে দেয়। ফলে জেলির জল ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গিয়ে এটি শুকিয়ে ছোট হয়ে যায়। একই সঙ্গে ওজোন গ্যাস আশপাশের নার্ভ রুটের প্রদাহ কমিয়ে দেয়। ব্যস, চকিতে অসহ্য যন্ত্রণার কবল থেকে মুক্তি। এর জন্যে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তিও থাকতে হয় না। সচেতনতার অভাব ও উপযুক্ত প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে কারোরই বিশেষ জানা নেই। যারা স্লিপ ডিস্কের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, তারা ওজোন ডিসেকটমির সাহায্যে ব্যথামুক্ত সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন অনায়াসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy