একান্তে: এমন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত লকডাউনে এখন বিরল। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ কোয়রান্টিন যে মুহূর্তে ঘটছে, যখন পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত বলে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), তখন সেই নিয়ম সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গত মাসেই নিকারাগুয়ার রাস্তায় বেরিয়েছিলেন নাগরিকদের একাংশ। সঙ্গে স্লোগান, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কোভিড ১৯’। যে জমায়েতের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ওই দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট খোদ রোসারিয়ো মুরিল্লো, প্রেসিডেন্ট দানিয়েল ওর্তেগার স্ত্রী! যা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় নিকারাগুয়া সরকারকে। সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে বিস্মিত,
ক্রুদ্ধ অনেকেই।
কিন্তু এই ঘটনা যে প্রশ্ন তুলে ধরেছে তা হল, মহামারির সময়ে প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক অটুট থাকছে তো? না কি বাকি অনেক কিছুর মতোই তাতে পরিবর্তন আসছে? গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ় লিখেছিলেন, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। কিন্তু লকডাউনের দুনিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি উপন্যাসের গণ্ডি ডিঙিয়ে প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কগুলি সম্পূর্ণ নতুন প্রেক্ষিতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যা নিয়ে গবেষণাও শুরু হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর প্রশান্ত চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘কলেরার সময়েও বাইরে বেরোনোর সুযোগ ছিল। এ রকম ঘরবন্দি অবস্থা হয়নি। এই সময়ে প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক নতুন করে চেনা যাবে। কারণ, মৃত্যুভয় বা অস্তিত্ব সঙ্কটের সর্বজনীন পরীক্ষায় আগে বসতে হয়নি সম্পর্ককে।’’
তবে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্কের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কোয়রান্টিন। এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকদের একটি অংশ। তাঁদের বক্তব্য, কর্মব্যস্ততার কারণে অনেক দম্পতি, যুগল একসঙ্গে বেশি ক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ পেতেন না। ফলে মতবিরোধ থাকলেও তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু লকডাউনে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘হোম কোয়রান্টিন’ পারস্পরিক সেই মতবিরোধের পরিসর বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণত কর্মরত দম্পতি, যুগলেরা ঘুমের সময়টুকু বাদ দিয়ে গড়ে ১৫০-২০০ মিনিট একসঙ্গে সময় কাটান বলে গবেষণা জানাচ্ছে। এক গবেষকের কথায়, ‘‘বাড়িতে হয়তো একসঙ্গে দু’জন রয়েছেন। কিন্তু দু’জনে সময় কাটানো বলতে যা বোঝায়, তা গড়ে ওই সময়ের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে।’’ ইতিমধ্যেই পাওয়া তথ্য দেখিয়েছে, তা পারিবারিক হিংসাও বাড়িয়ে দিয়েছে। অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলছেন, ‘‘যেটা চিন্তার সেটা হল, যে ভাবে পেশা-জীবনের অনিশ্চয়তার কথা বলে এই হিংসাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে বা সমর্থন করা হচ্ছে।’’
শুধুই দম্পতি বা একসঙ্গে থাকা যুগলই নয়, আলাদা থাকা অবিবাহিত যুগলদের সম্পর্কেও কোভিড ১৯-এর প্রভাব পড়ছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা। কোন সম্পর্ক শারীরিক দূরত্ব-জনিত ‘চাপ’কে সঙ্গে নিয়ে টিকে যাবে, কোন যুগল এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে পারবে, তা এই দুঃসময়ে বোঝা যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা। গবেষকদের বক্তব্য, সাধারণ সময়েও প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কে ভার্চুয়াল জগতের একটি ভূমিকা থাকে। কিন্তু সেই জগৎই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নয়। অবশ্য যাঁরা সম্পর্কে থেকেও দূরে থাকেন (লং ডিসট্যান্স), তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু লকডাউনের দুনিয়ায় সকলের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল জগৎই একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদ ও ন্যাসকমের পূর্বাঞ্চলীয় প্রাক্তন অধিকর্তা সুপর্ণ মৈত্র এ বিষয়ে বলেন, ‘‘প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক মানে তো শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও বোঝায়। দূরত্ব-জনিত এই পরিস্থিতি কারা মানিয়ে নিতে পারবেন, না কি পুরনো সম্পর্কের বদলে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে নতুন সম্পর্ক তৈরি হবে, তা এখনই বোঝা যাবে।’’
ধনকুবের এবং চিনেরই এক বহুজাতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা এক সময়ে বলেছিলেন, ‘লাভ কোশেন্ট’-কে (এলকিউ) সঙ্গী করে মানুষ দারিদ্র, বিশ্ব উষ্ণায়ন-সহ মূল সমস্যাগুলির সমাধান সূত্র খুঁজে পাবে। যা যন্ত্র পারবে না। কারণ, যন্ত্রের ভালবাসার ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি নেই, ‘এলকিউ’ নেই। জ্যাক এ-ও বলেছিলেন, ‘এলকিউ’-ই আবার মানুষকে মহামারির নিরাময় সূত্র খুঁজতে সাহায্য করবে।
ঘটনাচক্রে জ্যাকের সেই বক্তব্যের বছর তিন পরে এই মহামারির কবলে সমগ্র বিশ্ব। আর তারই
সংক্রমণকালে সেই ‘এলকিউ’-ই পরীক্ষিত হবে বলে মনে করছেন অনেকে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy