Advertisement
E-Paper

সহজলভ্য ঘুমের ওষুধ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে পুলিশের

ঘুমের ওষুধই ঘুম কেড়েছে পুলিশের। আদতে নাইট্রাজেপাম ঘুমের ওষুধ। অনিদ্রা, অবসাদ-সহ নানা সমস্যার চিকিৎসায় ওষুধটি দেন ডাক্তারেরা। অনেক ঘুমের ওষুধের মতো, এর-ও ব্যবহার হয় কখনও পার্টি ড্রাগ, কখনও মাদকের নেশার জন্য। কিন্তু সম্প্রতি নাইট্রাজেপাম (যার ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট চলতি কথায় এন-১০ বলে পরিচিত) ব্যবহারের কথা বারবার উঠে আসছে গুরুতর অপরাধের ঘটনায়।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৩৪

ঘুমের ওষুধই ঘুম কেড়েছে পুলিশের।

আদতে নাইট্রাজেপাম ঘুমের ওষুধ। অনিদ্রা, অবসাদ-সহ নানা সমস্যার চিকিৎসায় ওষুধটি দেন ডাক্তারেরা। অনেক ঘুমের ওষুধের মতো, এর-ও ব্যবহার হয় কখনও পার্টি ড্রাগ, কখনও মাদকের নেশার জন্য। কিন্তু সম্প্রতি নাইট্রাজেপাম (যার ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট চলতি কথায় এন-১০ বলে পরিচিত) ব্যবহারের কথা বারবার উঠে আসছে গুরুতর অপরাধের ঘটনায়। পরপর বেশ কয়েকটি খুনের তদন্তে নেমে নাইট্রাজেপামের ভূমিকা খুঁজে পেয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ। পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘একের পর এক খুনের ঘটনায় নাইট্রাজেপাম জাতীয় ট্যাবলেট ব্যবহারের তথ্য উঠে আসার পরে জেলার দোকানগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে।’’

রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তারা জানিয়েছেন, ওষুধটি যথেচ্ছ বিক্রি হওয়ার খবর তাঁদের কাছেও এসেছে। তা হলে তাঁরা কোনও পদক্ষেপ করছেন না কেন? এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ করেননি। এমনিতেই আমাদের লোকবল কম। তাই বহু জরুরি কাজই করা হয়ে ওঠে না। তবে নির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

নাইট্রাজেপাম জেনেরিক নাম, নানা কোম্পানি নিজস্ব ব্র্যান্ডে নাইট্রাজেপাম বিক্রি করে। তবে সাধারণত ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট বিক্রি হয় বলে ‘এন-১০’ নামে ওষুধটি পরিচিত। এর ব্যবহারের সর্বশেষ নিদর্শন মেলে দিন পাঁচেক আগে। দত্তপুকুর থেকে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা এক যুবকের ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে আসার পরে। বন্ধুদের টাকা ধার দিয়েছিলেন রফিক আলি নামে মৃত ওই যুবক। প্রয়োজনের সময়ে সেই টাকা ফেরত চাইছিলেন তিনি। বন্ধুরা রফিককে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ডাকে। মদের সঙ্গে আগেই মিশিয়ে রাখে বেশ কয়েকটি এন-১০ ট্যাবলেট। সেই মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লে। এর পরে শ্বাসরোধ করে রফিককে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেয় বন্ধুরা। রফিকের জামার একটি টুকরোকে সম্বল করে মাটি খুঁড়ে দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট এবং বন্ধুরা ধরা পড়ার পরে জেরায় ওষুধের রহস্য ফাঁস হয়।

তার কয়েক দিন আগেই গত বছরের ২৮ নভেম্বর দত্তপুকুরেই খুন হয় সানি শীল নামে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। রবিন সিংহ ওরফে শিব নামে এক যুবক খুন করে। রবিনের সন্দেহ ছিল, সানির সঙ্গে তার প্রেমিকার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই সে সানিকে দত্তপুকুরে ডেকে ঠান্ডা পানীয়ের সঙ্গে নাইট্রাজেপাম মিশিয়ে অচৈতন্য করে খুন করে। তার পরে সানির মোবাইল থেকে অন্য বন্ধুর নাম করে তার বাবাকে ফোন করে। খুনের পরে রাজারহাটের একটি শপিং মলে প্রেমিকার সঙ্গে দেখাও করতে যায় রবিন।

পুলিশ বলছে, নাইট্রাজেপামের স্পষ্ট উপস্থিতি প্রথম চোখে পড়ে গত বছরের ১১ জুন, হাসনাবাদের বাইলানি-বিসপুরে এক ব্যাক্তি খুনের ঘটনায়। নিজের এক প্রেমিকের সঙ্গে ছক করে আর এক প্রেমিক মৃন্ময় ঘোষকে নাইট্রাজেপাম খাইয়ে দেয় মিনতি পৌড়া নামে এক মহিলা। যাতে কোনও গন্ধ বা স্বাদ টের না পান মৃন্ময়, সে জন্য মাছের ঝোলে মিশিয়ে দেওয়া হয় ওষুধটি। মাছ-ভাত খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই এর পরে নিত্যানন্দ প্রামাণিক নামে প্রেমিকের সঙ্গে মিলে শ্বাসরোধ করে, মাথায় আঘাত করে মৃন্ময়কে খুন করে ওই মহিলা। খুনের চিহ্ন মুছতে গিয়ে মেঝে লেপা হয় গোবর দিয়ে। তাতেই সন্দেহ হওয়ায় ওই দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

কেন অপরাধীরা বেছে নিচ্ছে নাইট্রাজেপাম?

জেরায় অপরাধীরা জানিয়েছে, এই ট্যাবলেটটি লুকিয়ে কড়া ডোজে খাইয়ে দিতে পারলে ঘুমিয়ে পড়ে, বা অচৈতন্য হয়ে পড়ে ‘টার্গেট’। ফলে চিৎকার-চেঁচামেচি ছাড়াই কাজ হাসিল করা যায়। এক ধৃত জেরায় জানিয়েছিল, ‘‘ঘুমন্ত মানুষ জেগে গেলে তাকে খুন করতে তবুও কষ্ট হয়। কিন্তু অচৈতন্য মানুষের ক্ষেত্রে সে ঝুঁকি থাকে না।’’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য বলছেন, ফার্মাকোলজির দৃষ্টিতে ‘ভ্যালিয়াম’ বা ‘কাম্পোজ’-এর মতো পরিচিত ঘুমের ওষুধের থেকে ‘এন টেন’ জাতীয় ওষুধের প্রকৃতি বা কার্যকারিতায় তফাত নেই। কোনও বৈশিষ্ট্য না থাকলে নাইট্রাজেপাম এত জনপ্রিয় হচ্ছে কেন? ডাক্তারেরা যদি কোনও একটি ব্র্যান্ডের ওষুধ বেশি লেখেন, তা হলে সেটা মানুষের কাছে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে যারা মাদকাসক্ত, কিংবা পার্টি ড্রাগ নেয়, তাদের চক্র সংকীর্ণ। সেখানে এক জনের থেকে অন্য জনে কোনও একটি ওষুধের নাম ছড়িয়ে যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ থাকে না। তাই কোনও একটি ওষুধ বেশি ব্যবহার হতে থাকে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, কলকাতার থেকে শহরের আশেপাশের এলাকাতেই বেশি চলে নাইট্রাজেপাম। কলকাতার প্রাইভেট ডাক্তারেরা অন্যান্য ব্র্যান্ডের ওষুধ লেখেন।

বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক তথা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট সাইকিয়াট্রি’-র রাজ্য সভাপতি গৌতম সাহা বলেন, ‘‘মনোরোগীদের অনিদ্রার জন্য এই ওষুধটি দেওয়া হয়। তবে এই ওষুধ দেওয়ার ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকতে হয়। কারণ, এই ওষুধটিকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করে সমস্যায় পড়া অনেক রোগী আমাদের কাছে আসে। তাই এই ওষুধটি লেখা বা বিক্রির অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে।’’

তা কতটা মানছে ওষুধের দোকান? বারাসত হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান-মালিক অসীম সাহা বলেন, ‘‘এখন নিয়ম, নাইট্রাজেপাম জাতীয় ওষুধ বিক্রি করতে গেলে প্রেসক্রিপশনের ফটোকপি দোকানির কাছে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মাসে কত ওষুধ কেনা হয়েছে, বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে ফোটোকপি মিলিয়ে দেখা হবে।’’

তা হলে কী ভাবে অপরাধীরা হাতে পাচ্ছে এমন ট্যাবলেট?

দত্তপুকুর, বারাসত এবং মধ্যমগ্রামের পাঁচটি দোকানে ঘুরে তিনটি দোকান প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়। একটি দোকান প্রেসক্রিপশন ও তার ফটোকপি চায়। আর একটি দোকানে কিন্তু একটু অনুরোধ করতেই পাওয়া গেল এক পাতা এন-টেন।

ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন ‘বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর তরফে তুষার চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কোনও ভাবেই এই ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হওয়ার কথা নয়। কোনও দোকান এমন করছে বলে যদি নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, আমরা অবশ্যই তদন্ত করে দেখব। তবে কোন কোন দোকানে ওই ওষুধ বেশি বিক্রি হচ্ছে, সে দিকে ড্রাগ কন্ট্রোলেরও নজর রাখা উচিত।’’

Arunaksha Bhattacharya nitrazepam drug police murder barasat
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy