Advertisement
E-Paper

ইনস্টাগ্রাম বা রিল, আসক্তি বাড়ছে কিশোরদের! কী ভাবে কমাবেন তার নিয়ন্ত্রণ অভিভাবকদের হাতেই

কৈশোরকালে সমাজমাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার তাদের কেরিয়ারের ক্ষতি করতে পারে। ‘শক্ত’ না হয়ে অভিভাবকদের প্রয়োজন তাদের পাশে থাকার। প্রয়োজনে জেনে নিতে হবে ছোটদের পছন্দ-অপছন্দ।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৫ ০৯:২০
How parents can control mobile and social media addiction in children

কৈশোরকালের ক্ষতি করছে সমাজমাধ্যম। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সম্প্রতি চর্চিত ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজ় ‘অ্যাডোলেসেন্স’ কিশোর মনের জটিলতা ও সমাজমাধ্যমের প্রভাবকে নতুন করে তুলে ধরেছে। কৈশোরকালেই এখন ছেলেমেয়েদের হাতে শোভা পায় মোবাইল। ইন্টারনেট তাদের পড়াশোনার সুবিধা করে দিয়েছে। আবার চারপাশে ছোটদের একটা বড় অংশ এখন সমাজমাধ্যমে আসক্ত। অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিল দেখতে ব্যস্ত। তাদের একাংশ ডিজিটাল পেমেন্টেও স্বচ্ছন্দ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু সমাজমাধ্যম প্রভাবীর সংখ্যাও। কিন্তু অভিভাবকদের সঠিক পরামর্শ ছাড়া অল্পেতেই ঘটে যেতে পারে বিপত্তি। অবসাদ থেকে অজান্তে সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারে কিশোরেরা। তাই সময় থাকতেই অভিভাবকদের সাবধান হওয়া উচিত।

সমস্যা কোথায়?

চলতি বছরে একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, বিশ্বের ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি কিশোরেরা প্রতি দিন সমাজমাধ্যমে গড়ে ৩ ঘণ্টা সময় কাটায়। ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার (আইএএমএআই) একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, ভারতে কিশোরদের ২৭ শতাংশ সমাজমাধ্যমে আসক্ত, যা তাদের পড়াশোনা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেছে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের মতে, সঠিক সময়ে সন্তানের পাশে না দাঁড়ালে পরিসংখ্যানগুলি সময়ের সঙ্গে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। পায়েল বললেন, ‘‘কৈশোরকালে মানসিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে বাচ্চারা গুরুত্ব পেতে ভালবাসে। আর সেটা পাওয়ার জন্য কার্যকারণ বিচার না করেই তারা যে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে।’’ সন্তানকে নিজের প্রদর্শিত পথে চালিত করার জন্য কখনও কখনও নিজেকে তাদের জায়গায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে সমস্যা বাড়তে পারে।

How parents can control mobile and social media addiction in children

সমাজমাধ্যমের ক্ষতিকারক দিকগুলি নিয়ে সন্তানকে সতর্ক করতে হবে। ছবি: সংগৃহীত।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াট্‌সঅ্যাপ ছাড়াও কিশোরেরা ইউটিউব বা স্ন্যাপচ্যাটের মতো মাধ্যম ব্যবহার করছে। পাশাপাশি, এখন তারা ওটিটিতেও সড়গড়। সমাজমাধ্যমে লাইক, অনুসরণকারী বা অন্যের মন্তব্য শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময়ে তারা ‘সাইবার বুলিং’-এর শিকার হয়, যা তারা অভিভাবকদের সঙ্গে খোলা মনে ভাগ করে নিতে পারে না। পায়েলের কথায়, ‘‘সমাজমাধ্যমে এই তৃপ্তি বা অতৃপ্তির মধ্যে দিয়েই কিন্তু কিশোর মন এগোতে থাকে।’’ একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করলেন তিনি। পায়েলের কাছে এক কিশোর এসে জানায়, তার বন্ধু সাহসী ছবি পোস্ট করে বলে তার অনুসরণকারী বেশি। কিন্তু সমাজমাধ্যমে পরিবারের সকলে রয়েছেন বলে ওই কিশোর সাহসী ছবি পোস্ট করতে পারে না। পায়েলের কথায়, ‘‘তার হীনম্মন্যতা আমার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু আমি যখন বললাম ‘সাহসী’ ছবির কোনও সীমা হয় না। ভবিষ্যতে অন্য কেউ তাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। তখন কিন্তু সেই কিশোর কিছুটা থমকে গেল।’’

কৈশোরে সমাজমাধ্যমে আসক্তি থেকে পড়াশোনা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। পায়েল জানালেন, মস্তিষ্কের সামনের কর্টেক্স অংশটি যুক্তি এবং সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করে। কৈশোরে পা দেওয়ার পর এই অংশটি পরিণত হতে শুরু করায় সাময়িক ভাবে কর্মক্ষমতা কমে যায়। তখন সেই কাজটি করে অ্যামিগডালা অংশটি। পাশাপাশি এটি ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় এই পর্যায়কে বলা হয়, ‘প্রুনিং’। পায়েল বললেন, ‘‘১৮ বছর বয়সের পর মস্তিষ্ক নতুন করে কাজ করতে শুরু করে। সুতরাং, এই সন্ধিক্ষণে বাচ্চাদের সঠিক গাইডেন্সের প্রয়োজন হয়।’’

অভিভাকদের কী কী খেয়াল রাখতে হবে

কৈশোরকালে সমাজমাধ্যম এবং সন্তানের মধ্যে যোগসূত্র বা সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পায়েল কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন।

১) বয়ঃসন্ধিকালে যৌনতা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে সন্তানের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। তাদের সঙ্গে বাবা-মাকে খোলা মনে কথা বলতে হবে। ‘আমি পারি না’— এই ধরনের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, শৈশব থেকে সন্তান কৈশোরে প্রবেশ করেছে। ফলে সন্তান ‘কথা শোনে না’ বা তাকে ‘জেদি’ বলে থেমে থাকলে চলবে না।

২) অভিভাবকদের মধ্যে অনেকেই সমাজমাধ্যম বিষয়টা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু সন্তানের প্রয়োজনেই তাঁকে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম সম্পর্কে জানতে হবে। তা না হলে সন্তান সমাজমাধ্যমে ঠিক কী করছে, তা নিয়ে তিনি অন্ধকারেই থেকে যাবেন। প্রয়োজনে ইন্টারনেট ঘেঁটে তাঁকে জেনে নিতে হবে।

৩) বাচ্চারা নিজের কাছে ফোন রাখার জন্য বড়দের বোকা বানানোর চেষ্টা করে। পায়েলের পরামর্শ, সে যদি পড়ার জন্য কোনও পিডিএফ চায়, তা হলে তা প্রিন্ট করেও সন্তানকে দেওয়া যেতে পারে। অভিভাবকেরা যদি প্রযুক্তি সচেতন হয়ে ওঠেন, সন্তানের সঙ্গে তর্কের অবকাশ তৈরি হবে না।

৪) অনেকেই বলপূর্বক সন্তানের ফোন চেক করতে চান। এর ফলে তাদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিরোধ তৈরি হয়। তাই শুরুতেই মোবাইলের খারাপ দিকগুলো গল্পের মতো সন্তানকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বলা উচিত যে, সন্তানের ব্যক্তিগত পরিসরে তাঁরা হস্তক্ষেপ করবেন না। পায়েলের কথায়, ‘‘যদি বলা থাকে যে, বিশেষ বিশেষ সময়ে আমি কিন্তু তোমার ফোন পরীক্ষা করতে পারি, তা হলে যখন করা হবে, তখন বাচ্চাটি রাগ না-ও করতে পারে।’’

How parents can control mobile and social media addiction in children

সন্তানের স্বার্থেই অভিভাবককে তার পছন্দ ও অপছন্দ বুঝতে হবে। ছবি: সংগৃহীত।

৫) সন্তানের জগৎ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হলে, তাদের সঙ্গে মিশতেও সুবিধা হবে। সমাজমাধ্যমে তারা কী কী পছন্দ করে, তা জানতে হবে। কোনও কিশোর ‘বিটিএস’ বা টেলর সুইফ্‌টের গান পছন্দ করলে অভিভাবকেরও তাঁদের সম্পর্কে জানা উচিত। ফলে সন্তানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোনো সম্ভব হবে।

৬) সমাজমাধ্যমে কিশোরেরা আদৃত হতে বা স্বীকৃতি পেতে পছন্দ করে। কিন্তু সেটাই যদি অভিভাবকদের থেকে তারা পায়, তা হলে তাদের মন ভাল থাকে। পায়েলের কথায়, ‘‘সমাজমাধ্যমে লাইকের তুলনায় বাবা-মা যদি বলেন, ‘তোকে কী সুন্দর দেখতে লাগছে’, তা হলে সেই বক্তব্যের ইতিবাচক প্রভাব থাকে।’’ পায়েলের মতে, কোনও একটি বিশেষণের পরিবর্তে সন্তানের প্রশংসায় তার সঙ্গে সংলাপ তৈরি করতে পারলে ভাল হয়।

৭) ফেসবুক বা এক্স (সাবেক টুইটার)-এর পরিবর্তে অল্প বয়সে সন্তানের লিঙ্কডইন প্রোফাইল তৈরির উপর জোর দিচ্ছেন পায়েল। তাঁর মতে, ছদ্ম বাহবার তুলনায় কাজের প্রকৃত স্বীকৃতি তাদের অবসাদ থেকে দূরে রাখতে পারে।

৮) বেশির ভাগ ওটিটি এবং ইউটিউবে এখন বাচ্চাদের জন্য নির্দিষ্ট বিভাগ থাকে। প্রয়োজনে অভিভাবক তা তৈরি করে দিতে পারেন (পেরেন্টাল কন্ট্রোল)। এর ফলে সন্তানকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখা যায়।

৯) বর্তমানে পর্ন সাইট বা অপরিচিত ওয়েবসাইট থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই মোবাইলে লোকেশন ট্র্যাকিং অফ রাখা-সহ অন্যান্য সুরক্ষাবিধি অভিভাবকের তরফে সন্তানকে শুরুতেই শিখিয়ে দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে অভিভাবকেরা সন্তানের ব্রাউজ়িং হিস্ট্রি বা আইপি অ্যাড্রেসও ট্র্যাক করতে পারেন। এ ছাড়াও সমাজমাধ্যমে সন্তানের নিজের ছবির পরিবর্তে কোনও কার্টুন বা লোগো জাতীয় ছবি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন পায়েল। এর ফলে সম্ভাব্য বহু সমস্যা এড়ানো সম্ভব।

১০) সন্তান দিনে কত ক্ষণ মোবাইল দেখবে, তা নিয়ে পরিবারে নিয়ম তৈরি করতে পারলে নির্দিষ্ট হিসেব রাখা সম্ভব। তার পর সন্তান কথা শুনলে, বাবা-মা তার প্রশংসা করলে, সময়ের সঙ্গে মোবাইল ব্যবহার আরও কমে যেতে পারে।

১১) সমাজমাধ্যমে আসক্তি কমাতে সন্তানকে কোনও খেলা বা বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পরিবারে খেলাধুলো বা পড়ার আবহ থাকতে হবে। পায়েলের কথায়, ‘‘বাবা-মা সন্তানের সঙ্গেই কোনও খেলা বা শরীরচর্চা শুরু করতে পারেন। একসঙ্গে বই পড়তে পারেন। মনে রাখতে হবে, বাচ্চারা যা দেখবে, সেটাই শিখবে।’’

Mobile Addiction Teenager Social Media Parents Mental Health
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy