Advertisement
১১ মে ২০২৪
Insomnia

অনিদ্রা সুস্থ জীবনের শত্রু

শরীর এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য একটু সময় নেয়। এই সময়টাই হল ঘুমের সময়।

সুবর্ণ বসু
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দিনের তিন ভাগের দু’ভাগ কাজকর্মের জন্য, বাকি একভাগ ঘুমের জন্য বরাদ্দ। ওই একভাগের উপরে নির্ভর করছে বাকি দু’ভাগ। কারণ ঘুম মস্তিষ্ক ও শরীরকে পূর্ণ বিশ্রাম দেয়। দিনে ষোলো ঘণ্টা ঠিকমতো পরিশ্রম করার জন্য আট ঘণ্টার ঘুম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, অনিদ্রার মতো কষ্ট যাঁদের আছে, তাঁরাই বুঝতে পারেন। অনিদ্রা মানে ঘুম না আসা, ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে ইনসমনিয়া।

কেন হয় ইনসমনিয়া?

জেনারেল মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, “আমাদের ঘুম পায়, কারণ ক্রমাগত কাজ করার ফলে আমাদের শরীরের এটিপি (অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট) অর্থাৎ শক্তি খরচ হয়। শরীর এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য একটু সময় নেয়। এই সময়টাই হল ঘুমের সময়। তখনই শরীর এটিপি বা শক্তির পুনরুৎপাদন করে নেয়। প্রকৃতি আমাদের মস্তিষ্ক থেকে একটি রাসায়নিকের ক্ষরণ ঘটায়, যার নাম মেলাটোনিন। এই মেলাটোনিন শরীরে ঘুমের সাইকেল বা চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মেলাটোনিন সব সময়ে তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু আলোর উপস্থিতিতে নষ্ট হয়ে যায়। তাই উজ্জ্বল আলোয় ঘুম পায় না। এখন অনেকেই দীর্ঘক্ষণ ল্যাপটপ বা মোবাইলে কাজ করেন, চোখের সামনে উজ্জ্বল আলো তাঁদের মেলাটোনিন নষ্ট করে ঘুমের সমস্যা তৈরি করে। ফলে অল্টার্ড স্লিপ হ্যাবিট দেখা যায়। তিনি ভোর চারটে অবধি জেগে রইলেন, তার পর দুপুর এগারোটা অবধি ঘুমোলেন। এ সব ক্ষেত্রে ঘুমের সাইকেল উল্টে যায়।”

অনিদ্রার লক্ষণ

রাতে ঘুম না হওয়া এই রোগের প্রধান লক্ষণ। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে যে সব উপসর্গ দেখা দিতে পারে, সেগুলো হল, দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব কিন্তু ঘুম না আসা, সর্বক্ষণ গভীর ক্লান্তি, খারাপ মেজাজ, কাজে মন না বসা, ইত্যাদি। এ সব উপসর্গ দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। তবে দৈনিক কতটা ঘুম প্রয়োজন, তার মাপ কিন্তু বয়স অনুযায়ী এক রকম নয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই মেলাটোনিন সংশ্লেষ ক্রমশ কমে আসতে থাকে। জন্মের পর এক মাস পর্যন্ত যেমন বাচ্চারা তেইশ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুমোয়, কারণ তখন মেলাটোনিন সংশ্লেষ সবচেয়ে বেশি। একজন স্কুলে পড়া বাচ্চার (ক্লাস এইট পর্যন্ত) দিনে ঘুম দরকার অন্তত ন’ঘণ্টা। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচ ঘণ্টায়, কারণ মেলাটোনিন সংশ্লেষ তখন সবচেয়ে কম।” যার যতটা ঘুম প্রয়োজন, তার কোটা পূরণ না হওয়াই অনিদ্রা রোগের লক্ষণ।

প্রতিরোধের কিছু সাধারণ উপায়

• ঘুমোতে যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদিতে কাজ করবেন না
• ক্যাফেইন, নিকোটিন, অ্যালকোহল পরিত্যাগ করুন
• রাতে ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত তিন-চার ঘণ্টা আগে হালকা ব্যায়াম করলে সুফল পাবেন
• পরিমিত ডিনার করুন এবং বেশি রাত করে খাবেন না। পেট ভরে বা দেরিতে খেলে অনেক সময়ই ঘুমের অসুবিধে হয়
• শোওয়ার ঘর যেন যথাসম্ভব আরামপ্রদ হয়। খুব বেশি গরম অথবা ঠান্ডা যেন না হয়। চোখ এবং কানের গার্ড পরে ঘুমোনোর অভ্যেসও করা যেতে পারে
• যে ভাবে শুতে আপনি সবচেয়ে আরাম বোধ করছেন, সে ভাবেই শোয়া উচিত। ঘুমের আগে বই পড়া, মৃদু লয়ের গান শোনা অথবা ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করার অভ্যেস তৈরি করতে পারেন
• ওজনের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখুন। উচ্চতা অনুযায়ী ওজন যেন ঠিক থাকে। যাঁদের অতিরিক্ত ওজন, তাঁদের অনেক সময়ে নাক ডাকার সমস্যা থাকে। এর কারণ অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। এটি পরবর্তী সময়ে হার্টের অসুখও তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পলিসমনোগ্রাফি টেস্ট করে দেখতে হয়, কতটা অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে, সেটা পূরণ করতে পালস বাড়ছে এবং এর জন্য হার্টকে কতটা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। উপযুক্ত চিকিৎসা না করলে হার্টের সমস্যা গুরুতর হতে পারে। ইনসমনিয়ার কারণগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে ক্ষতিকর

ইনসমনিয়ার প্রকারভেদ

ইনসমনিয়া দু’ধরনের। কখনও এটি হয় অ্যাকিউট বা সাময়িক। কেউ হয়তো রাস্তায় কোনও খারাপ দৃশ্য দেখেছেন বা কারও হয়তো সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে, সেই কারণ রাতে ঘুম এল না। এ ক্ষেত্রে ঘটনাটি মস্তিষ্ক নিজেই ধীরে ধীরে ভুলে যাবে, তাতেই অনিদ্রা এক সময়ে কেটে যাবে। কিন্তু কারও যদি ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা রোগ থাকে, তা হলে তার চিকিৎসা প্রয়োজন। অ্যাংজ়াইটি না ডিপ্রেশন, নাকি অন্য কোনও কারণ— কী কারণে তার ঘুম আসছে না, সেই কারণটিকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা করতে পারলেই অনিদ্রার সমাধান সম্ভব হয়।

কী করণীয়

প্রথমেই মনে রাখতে হবে, নিজে নিজে বা অন্য কারও কথা শুনে ঘুমের ওষুধ কিনে খাবেন না। ডাক্তার দেখিয়ে নির্দিষ্ট মাত্রার ঘুমের ওষুধই খাওয়া উচিত। কী ভাবে সে ওষুধ ধীরে ধীরে বন্ধ হবে, সে ব্যাপারেও চিকিৎসকের মতামতই শেষ কথা। ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, “অ্যাকিউট ইনসমনিয়ার ক্ষেত্রে, ঘুম না এলে পড়তে বসতে হবে। এ ক্ষেত্রে গল্পের বই নয়, প্রত্যেককে তার মতো করে একটু কঠিন বিষয় নিয়ে পড়তে হবে। পড়ার মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের এটিপি বেশি পরিমাণে খরচ হবে, মস্তিষ্ক ক্লান্ত হবে এবং ঘুম এসে যাবে। কিন্তু ক্রনিক ইনসমনিয়া, যেমন সপ্তাহের অর্ধেক রাতেই ঘুম আসছে না, এ রকম তিন মাস ধরে চলছে, তখন চিকিৎসার প্রয়োজন। দেখা গিয়েছে, স্থায়ী অনিদ্রা রোগের বেশিরভাগ কারণই সেকেন্ডারি বা গৌণ। প্রাইমারি কারণেও স্থায়ী অনিদ্রা হতে পারে, যেমন কারও ডিভোর্স হয়েছে, কিংবা বাড়িতে কোনও মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে— এর প্রভাব গিয়ে সরাসরি পড়েছে ঘুমের উপর। গৌণ কারণ হচ্ছে, অন্য কোনও রোগ, যেমন হাঁপানির কষ্ট, ক্যানসারের যন্ত্রণা ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হবে।”

স্বাভাবিক ঘুমের অভ্যেস ফিরে পেতে অকারণ দুশ্চিন্তা এবং যে কোনও ধরনের নেশা থেকে দূরে থাকুন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের মধ্যেই রয়েছে পর্যাপ্ত ঘুমের চাবিকাঠি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Insomnia Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE