E-Paper

নীরবতাই যখন অস্ত্র

সব কথার উত্তর দেওয়ার কি কোনও দরকার আছে? কিছু কিছু ক্ষেত্রে চুপ করে থাকাও মোক্ষম জবাব হতে পারে। আর সেখানেই ‘গ্রে রকিং’ সফল

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:০৯

চারপাশে রোজ কত কী ঘটে চলেছে। আর সব বিষয়েই কত প্রতিক্রিয়া। সমাজমাধ্যমে কারও মতের সঙ্গে না মিললে তর্ক, তা থেকে গালমন্দ। অনেক সময়ে বিপরীতে যে মানুষটি রয়েছেন সে হয়তো আপনার কথার সঙ্গে একমত হচ্ছেন না, হবেনও না, কিন্তু আপনি বুঝিয়েই যাচ্ছেন। আবার অনেক সময়ে কেউ হয়তো রোজ অপমান করছে, আঘাত দিয়ে কথা বলছে, আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, রেগেমেগে বা আবেগপ্রবণ হয়ে কিছু বলতে গেলে আরও হয়রানি। এতে মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয়, হতাশা, অবসাদও দেখা যায়। এমন ক্ষেত্র থেকে মানসিক শান্তি অক্ষুণ্ণ রেখে বেরিয়ে আসার উপায় হল গ্রে রকিং।

গ্রে রকিং আসলে কী?

গ্রে রকিংয়ের আক্ষরিক অর্থ করতে হলে বলা যায়, পাথরের মতো নিজের মানসিক স্থিতিতে অটল থাকা। বিষয়টা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গার্গী দাশগুপ্ত, “এই ‘গ্রে রকিং’ টার্মটা নতুন, কিন্তু এই ধারণা বহুদিন ধরেই আমাদের সমাজে রয়েছে। সহজ করে বলা যায়, গ্যাসলাইটিংয়ের উত্তর হল গ্রে রকিং। কেউ যখন আমাকে আঘাত করছে, আমার অস্তিত্বটা নস্যাৎ করতে চাইছে বা যখন কারও সঙ্গে সম্পর্কে বিষাক্ততা চলে আসছে, তখন মেন্টাল শাটডাউন করা দরকার। কেউ আমাকে ইন্ধন দিলেই আমি উত্তেজিত হব না। অনেক সময়েই দেখি, অমুক একজন পার্টিতে যাবেন বলে আর একজন সেই পার্টিতে যাবেন না। কিন্তু সেই একজনকে যদি আমি গণ্যই না করি, তাকে যদি আমি একটা দেওয়াল মনে করি, তা হলে সে থাকুক আর না থাকুক আমার কিছু যায় আসে না।” নিজের চারপাশে এমন একটা বলয় তৈরি করে নিলে মানসিক শান্তি অক্ষুণ্ণ থাকে।

অনেক সময়েই দেখা যায়, নিজেদের মত গ্রহণযোগ্য না হলে বা অনেকে দলগত ভাবে রোজ আক্রমণ করলে বা হাসাহাসি করলে, অপমান করলে আমরা রেগে যাই, দুঃখ পাই, প্রতিক্রিয়াও দিয়ে ফেলি। সেখানেই এই বলয়টা গড়ে তুলতে হবে। গার্গীর কথায়, “বুঝতে হবে, সেই মানুষটা তার নিরাপত্তাহীনতা, হিংসা, উদ্বেগ থেকে হয়তো এমন কাজ করছেন। সে ক্ষেত্রে তার সমস্যার উত্তর আমি কেন দেব? তা হলে তো সেই নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগের আঁচ আমাকেও পোহাতে হবে। এখানে নীরবতাই সেরা পন্থা।”

এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, প্রতিক্রিয়া দেবেন না মানে পুরো চুপ করে যাওয়া নয়। কেউ যদি খারাপ কথা বলেন, দোষারোপ করেন বা অন্যায় করেন, সেখানে কথা বলা বা উত্তর দেওয়া জরুরি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেখানে নিজের প্রতিক্রিয়া দেবেন না, কারণ তার সঙ্গে আবেগ জুড়ে যায়। রেগে বা কেঁদে অন্য মতের বিরোধিতা করতে যাবেন না। প্রয়োজনে ভেবে যুক্তিসহ উত্তর দিতে হবে, বলে জানালেন গার্গী।

সামাজিক ক্ষেত্রে কতটা জরুরি

এখন সমাজের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সমাজমাধ্যম। সেখানে বেশির ভাগ সময়েই নানা বিষয়ে সিংহভাগ মানুষ নিজের মতামত দিতে থাকেন। নিজের মতের সঙ্গে না মিললে ঝগড়া, গালমন্দ, ব্যক্তিগত আক্রমণও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সব জায়গায় মতামত দেওয়ার কি দরকার আছে? সমাজবিদ ও অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ চৌধুরী বললেন, “আগে যখন মানুষ সত্যিই সমাজবদ্ধ ভাবে বাঁচত, তখন অনেকেই নিজের মত প্রকাশ করতেন। চায়ের দোকানে বা পাড়ার রকে এমন অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ বসতেন, যাঁদের মতামতকে আর পাঁচজন গুরুত্ব দিত। কিন্তু এখন মানুষের সেই যাপনটাই বদলে গিয়েছে। ফলে মতামত দেওয়ার সুযোগ সব সময়ে থাকছে না। আর কেউ মতামত দিলেও সেটা কি আদৌ গ্রহণ করছেন বাকিরা? তা হলে সেই মত দিয়ে লাভ কি? এখন সমাজমাধ্যমে প্রত্যেকে নিজের মতের সাপোর্টার জোগাড় করেন। কিন্তু সেটা ঠিক না ভুল তার ব্যাখ্যা বা পর্যবেক্ষণে যান না।” ফলে যেখানে আপনার মতের গুরুত্বই নেই, সেখানে সময় অপচয় করে লাভ কী? এখানে আর একটা বিষয়ও ভাবার। এত লোকের এত মত শুনে বা পড়ে আমার জীবনে আদৌ কোনও কাজে লাগছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। না হলে এত কথা, এত মত শুনতে শুনতে নিজের বোঝাও বাড়বে বই কমবে না।

এখানে আর একটা বিষয়ও উল্লেখ করলেন ড. অনিরুদ্ধ। সমাজমাধ্যমে ব্যক্তি আক্রমণ করা, সব বিষয়ে মতপ্রকাশ কারা করছেন, সেটাও দেখা দরকার। “এটা অনেকটা মেঘনাদের যাপন বলা যায়। এদের বেশির ভাগেরই সামনে কথা বলার মতো আত্মবিশ্বাস বা সাহস থাকে না। এরাই সমাজমাধ্যমের আড়াল খুঁজে নেয়। ফলে এমন ব্যক্তির আক্রমণাত্মক কথার প্রত্যুত্তর দিয়ে নিজের সময় নষ্ট করার কি দরকার আছে? ব্যক্তিগত স্তরে যাকে চিনি না, সে কতটা জানে আমি জানি না, তাকে বোঝাতে যাওয়া মানে অহেতুক নিজের সময়, যুক্তিবুদ্ধি ও মানসিক শান্তি নষ্ট করা। হয়তো দেখা যাবে, যে বিষয় নিয়ে সে লিখছে, সেটা তার গুগল-লব্ধ জ্ঞান। এ দিকে যিনি বোঝাতে যাচ্ছেন, তিনি সেই বিষয়ে পারদর্শী। সুতরাং এই অসম যুক্তি-তর্কে যাওয়ার দরকার কী?”

শব্দ ব্রহ্ম, অপাত্রে দান নয়, তাকে বুঝে খরচ করতে শিখুন। আশপাশে কে কী বলছে, তা নিয়ে অস্থির না হয়ে নিজের বলয়ের মধ্যে ভাল ভাবে বাঁচুন। সময় থাকলে নিজের চারপাশের মানুষদের খুঁটিনাটি দিকে নজর দিন। বাড়িতে গাছের যত্ন নিন, একটা নতুন সেলাই শিখুন বা গান শুনুন। প্রিয় মানুষের সঙ্গে সময় কাটান। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। কোথায় নিজের মত দেবেন আর কোথায় দেবেন না, এই পার্থক্য করতে শেখাটাও খুব জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Communication

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy