অন্দরসাজেই কিন্তু ধরা থাকে বাড়ির সদস্যদের জীবনশৈলী, রুচিবোধ ও তাঁদের মনন। একটা বাড়িতে ঢুকলেই তার অন্দরসাজে সেই আভাস পাওয়া যায়। বাড়িটা নিজেই যেন সেই পরিবারের একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। একাধিক রেস্তরাঁর কর্ণধার শিলাদিত্য চৌধুরীর বাড়িতে ঢুকতে সেই কথাটা আরও বেশি করে মনে হল। সিংহী পার্ক সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপের গা ঘেঁষে এই অ্যাপার্টমেন্টের বিল্ডিং উঠে গিয়েছে। নিরিবিলি পাড়ায় এই বাড়িটা যেন শান্তির নীড়। ছিমছাম অন্দরমহলে ধরা রয়েছে সাবেক কলকাতার সাজ। দেওয়ালসজ্জায় আবার গৃহকর্তার শিল্পমনের পরিচয়ও স্পষ্ট।
ডাইনিং রুম। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই বাঁ হাতে সাদা মার্বেলের তৈরি ঠাকুরঘর আর ডান দিকে রয়েছে ছড়ানো বৈঠকখানা। সে ঘরের সাদা আর অফহোয়াইটের কালারটোন ব্যালান্স করছে দেওয়ালে লাল রঙের প্রেক্ষাপটে দুর্গার তৈলচিত্র। শিলাদিত্যর স্ত্রী রেশমী চৌধুরী বললেন, “আসলে সাদা রং আমার ভীষণ প্রিয়। বিয়ের সময়েও সাদা বেনারসি পরতে চেয়েছিলাম। তবে ৩০ বছর আগে তখন সেটা কেউ পরতে দেয়নি। কিন্তু নিজের বাড়ি যখন হল, তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম দেওয়াল, ফ্লোরিং সব সাদা করব।” হলঘরের এক পাশে আবার সাদা-কালোর মিশেলে তৈরি হয়েছে মেঝে। সাদা-কালোর সেই চৌখুপি মেঝেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে রোদের আলপনায়।
দেশবিদেশের সুভেনির। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
“আসলে আমরা দু’জনেই দক্ষিণ কলকাতার পাড়ায়, যৌথ পরিবারের বাড়িতে থেকে বড় হয়েছি। তাই ফ্ল্যাটের বর্গফুটের মধ্যেও বাড়ির আমেজটা যাতে বজায় থাকে, সেটা সব সময়ে খেয়াল রেখেছি। বড় হলের মাঝে এই চৌখুপি মেঝে দেখলে মনে হয় যেন নিজের বাড়িতেই বসে আছি,” বলছিলেন রেশমী।
স্টাডি। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
আসবাবে বেতের কাজও কলকাতার সাবেক সাজ ধরে রেখেছে। বসার ঘরের সোফায়, বেডরুমের খাটে, স্টাডিরুমের চেয়ারে, আলমারির দরজায়... প্রায় সব জায়গাতেই চোখে পড়ে কাঠের ফ্রেমে বেতের কাজ। শিলাদিত্য বললেন, “পুরনো কলকাতার ঔপনিবেশিক সাজের ছোঁয়া রাখতেই এই কেনওয়ার্কটা বেছে নিয়েছিলাম। আর বেতের কাজ কখনও পুরনো হয় না। আমাদের পুরো বাড়ির কালার প্যালেটের সঙ্গেও বেতের কাজ খুব সুন্দর ব্যালান্স করেছে। বাঙালি বাড়ির আমেজও ধরা পড়ে এই কাজে। সব ঘরেই তাই আসবাবে কেনওয়ার্ক রাখার চেষ্টা করেছি।” বিছানা, সোফার ফ্যাব্রিকও বাছা হয়েছে বেতের কাজ ও ঘরের রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
বাগানে বসার ব্যবস্থা। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
তবে কেনওয়ার্ক মেনটেন করা কম ঝক্কির নয়। বেতের কাজের ফাঁকে ধুলো জমে খুব সহজেই। ঘর সাজালেই তো হল না, তা সুন্দর ও পরিপাটি রাখাটাও একটা বড় কাজ বলে মনে করেন রেশমী। তাই বাড়ির সব আসবাব, শো-পিস পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। “কিছু কেনার আগেই জিজ্ঞেস করি, সেটা পরিষ্কার করব কী ভাবে, ধোয়া যাবে কি না, লোকে শুনলে হাসে। কিন্তু আমি জানি মেনটেন করাটা কী কষ্টের। আসলে যে কোনও জিনিস কেনার সময়ে সুন্দরই থাকে, কিন্তু বছরের পর বছর সেটা সুন্দর রাখাটা সহজ নয়। রান্নাঘরে একটা কৌটো থেকে মশলা নিলেও আমি সঙ্গে সঙ্গে মুছে রাখি,” বললেন গৃহকর্ত্রী।
বেডরুম। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
এই বাড়িতে খাওয়ার ঘরের ব্যবস্থাও বেশ অন্য রকম। ডাইনিং রুমে ছিমছাম সাজে এক দিকে বড় ক্রকারির আলমারি আর তার সামনের দেওয়ালচিত্রতে বাবু সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। লম্বা ডাইনিং টেবলের উপরে ঝাড়বাতি ঘরের সাজ সম্পূর্ণ করছে। তবে এই ডাইনিং হলের আয়োজন বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। এখানে কিন্তু রোজকার খাওয়াদাওয়া হয় না। কর্তা-গিন্নি দু’জনায় খাওয়াদাওয়া সারেন ছোট্ট একটা টু-সিটার টেবিলে।
বাড়ির সাজে বেশির ভাগ জিনিসই বেড়াতে গিয়ে সংগ্রহ করা সুভেনির। একটা দেওয়াল জুড়ে রয়েছে শুধু দেশবিদেশ থেকে সংগ্রহ করা নানা রকমের ম্যাগনেট। ছোট ছোট পুতুলও সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন দেশ থেকে। উডেন কনটেনার ডল, ড্রাগন, সুইৎজ়ারল্যান্ড থেকে কেনা মিনিয়েচার দিয়ে সাজানো বসার ঘর। স্কাল্পচারের প্রতিও টান আছে গৃহকর্তার। বসার ঘর, স্টাডিতেও দেখা মিলল বিভিন্ন কাঠের ভাস্কর্যের।
তবে শিলাদিত্য ভালবাসেন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। বাঘের প্রতি তাঁর ভালবাসা একটু বেশিই। রণথম্বোর, তাড়োবা, বান্ধবগড়, কানহা, সিমলিপাল... দেশের সব জঙ্গলই তাঁর একাধিক বার ঘোরা। শিলাদিত্যর কথায়, “বাঘ দেখার জন্য যেমন যাওয়া, জঙ্গুলে পরিবেশের রোমাঞ্চ অনুভব করার অভিজ্ঞতাও কিন্তু প্রাপ্তি। সেই জন্যই বার বার জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ি। সব সময়ে যে বড় বড় রিসর্টে উঠি, এমন নয়। অনেক বার জঙ্গলের সার্কিট হাউসেও থেকেছি। সন্ধের পর থেকে সেখানে বিদ্যুৎ থাকে না। কোনও ইন্টারনেট নেই। অন্ধকারে সে সময়ে চারপাশ থেকে বন্য জন্তুর ডাক ভেসে আসে। জঙ্গলের মাঝে এমন রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো যায় না।”
প্রকৃতির কাছে থাকতে ভালবাসেন বলেই হয়তো ফ্ল্যাটের বারান্দা জুড়েও সবুজের সমারোহ। ফ্ল্যাটের সব ঘর থেকেই মোটামুটি নীল আকাশ আর সবুজ দেখা যায়। কথা বলতে বলতেই বারান্দায় উঠে এসে গাছ থেকে লেবু পেড়ে দিলেন গৃহকর্তা। বারান্দার মাটিতে মাথাচাড়া দিয়ে ডালপালা মেলে দিয়েছে একটা বিশাল গন্ধরাজ লেবুর গাছ। থোকা থোকা লেবু নিয়ে গাছের ডালপালা যেন ঝামরে পড়ছে। গাছ থেকে একটা লেবু ছিঁড়েই নাকের কাছে নিয়ে গেলেন, “মুগ ডালে বা কোনও খাবারে এই লেবুর রস পড়লেই ব্যস!” এই এককথাতেই খাদ্যরসিক শিলাদিত্যর পরিচয় পাওয়া গেল।
বাড়ির সদস্যদের স্বপ্ন জুড়ে জুড়েই ইট-কাঠ-পাথরের ইমারত একটা বাড়ি হয়ে ওঠে। এই বাড়ির অন্দরসাজেও সেই স্বপ্নপূরণের ছবি স্পষ্ট। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে দিনযাপনের ঠিকানা তো এমনই হয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)