Advertisement
E-Paper

ঠিকমতো চিকিৎসায় প্রস্টেট ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব

এই ক্যানসার আসে নীরবে। আগে থেকে লক্ষণ বোঝা কঠিন। কিন্তু ঠিক সময়ে ধরতে পারলে প্রস্টেট ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব। দেরিতে ধরা পড়লেও ঠিকমতো চিকিৎসা করালে দীর্ঘদিন সুস্থ ভাবে বাঁচা সম্ভব। জানাচ্ছেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের রেডিওথেরাপি ইউনিটের প্রধান প্রদীপকুমার মাইতি।  সাক্ষাৎকার: সৌমেন দত্তবাইরে থেকে হরমোনের ওষুধ দিয়ে প্রস্টেটের হরমোনের মাত্রাকে ঠিক অবস্থায় রাখা হয়।

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৬:০৬
চলছে চিকিৎসা। সহকর্মীদের সঙ্গে রোগী দেখতে ব্যস্ত চিকিৎসক প্রদীপকুমার মাইতি (ডানদিক থেকে  দ্বিতীয়)। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। ছবি: উদিত সিংহ

চলছে চিকিৎসা। সহকর্মীদের সঙ্গে রোগী দেখতে ব্যস্ত চিকিৎসক প্রদীপকুমার মাইতি (ডানদিক থেকে দ্বিতীয়)। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। ছবি: উদিত সিংহ

প্রশ্ন: প্রস্টেট ক্যানসার কী?
উত্তর: পুরুষদের মূত্রথলির নীচে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড রয়েছে। ওই গ্ল্যান্ড থেকে হরমোন নির্গত হয়। হরমোনের সমস্যার জন্য মূত্রনালীতে সমস্যা হয়। সেখান থেকে এক ধরনের ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। এই অঞ্চলের ক্যানসারকে প্রস্টেট ক্যানসার বলে।

প্রশ্ন: প্রস্টেট ক্যানসার কেন হয়?
উত্তর: এই অঞ্চলের ক্যানসার নিয়ে এখন নানা গবেষণা চলেছ। এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে সাধারণত হরমোনের সমস্যার জন্যই প্রস্টেট ক্যানসার হয়। বাকি কারণ এখনও অজানা।

প্রশ্ন: প্রস্টেট ক্যানসার কোন সময়ে ধরা পড়ে?
উত্তর: এই ক্যানসারের একটি বড় সমস্যা রয়েছে। সেটি হল এই ধরনের ক্যানসার পুরুষদের শরীরে নীরবে বাসা বেঁধে থাকে। সাধারণত আগে থেকে এর লক্ষণগুলি বোঝা যায় না। এই রোগ থাকলেই মানুষ যে ভুগছে—এমন কথা বলা যায় না। তবে পুরুষদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেলে তাঁদের মধ্যে এই ধরনের ক্যানসারের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। আমাদের কাছে প্রতি দিন যত ক্যানসারের রোগী আসেন তার মধ্যে পাঁচ শতাংশ রোগী প্রস্টেট ক্যানসারের রোগী।

প্রশ্ন: কেউ প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, তা কী ভাবে বোঝা যাবে?
উত্তর: আগেই বলেছি এই ধরনের ক্যানসার শরীরে নীরবে বাসা বাঁধে। সাধারণ ভাবে বুঝে ওঠা কঠিন। তবে এর প্রথম লক্ষণ হল, প্রস্রাবের পথে বাধা তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, প্রস্টেট গ্ল্যান্ড অস্বাভাবিক বড় হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, প্রস্টেট ক্যানসার দূরে ছড়িয়ে পরতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডকে আক্রমণ করার আশঙ্কা থেকে যায়। এই সময়ে ব্যথা হয়। অনেকে সেই ব্যথাকে গুরুত্ব দেন না। অনেক সময় ব্যথাকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পরে। এ ছাড়াও খুব কম ক্ষেত্রেই প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

প্রশ্ন: প্রস্রাবের পথে বাধা হওয়া মানেই কি ক্যানসার?
উত্তর: না, না, একে বারেই তা নয়।
প্রশ্ন: তা হলে কী ভাবে বুঝব যে ক্যানসার হয়ে প্রস্রাবের পথে বাধা থেকে ক্যানসার হয়েছে?
উত্তর: প্রস্রাবের পথে বাধা তৈরি হতে পারে ওখানে কোনও টিউমার তৈরি হলে। এর ফলে প্রস্রাব বন্ধ হতে পারে। এখন টিউমার দু’ধরনের হতে পারে। প্রথম হল বিনাইন টিউমার। দ্বিতীয় হল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। সাধারণত হরমোন ঘটিত কারণে বিনাইন টিউমার তৈরি হয়। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অনেক সময় কিডনির সমস্যা থেকেও বিনাইন টিউমার তৈরি হয়েছে। অন্য টিউমার হল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। পরীক্ষায় ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রাথমিক ভাবে ক্যানসার হয়েছে ধরে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

প্রশ্ন: বিনাইন না ম্যালিগন্যান্ট— প্রস্টেটের ওখানে কোন ধরনের টিউমার হয়েছে তা আগে থেকে ধরা পড়বে কী ভাবে?
উত্তর: আগেই বলেছি প্রথম লক্ষণ হল প্রস্রাবে বাধা তৈরি হওয়া। প্রস্রাবে বাধা দেখা দিলে প্রথমেই ইউরোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। তিনিই প্রথমে পরীক্ষা করে আল্ট্রা সোনোগ্রাফি (ইউএসজি) করতে বলবেন। এই পরীক্ষায় প্রস্টেটের মাপ বোঝা যাবে। বোঝা যাবে প্রস্টেটটি বড় হয়েছে কি না। যদি দেখা যায় প্রস্টেটটি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে তা হলে পরের ধাপে হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা শুরু করবেন।

প্রশ্ন: হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা কী?
উত্তর: হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা আসলে ইউএসজি গাইডেড বায়োপসি। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে ট্রান-রেক্টাল আন্ডার সাউন্ড (ট্রাস) বায়োপ্সি বলা হয়। হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার শুরুতেই এই ধরনের বায়োপ্সি
করা হবে।

প্রশ্ন: কী ভাবে হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হবে?
উত্তর: এই পরীক্ষায় রেক্টামের পিছন দিয়ে ছবি তুলে প্রস্টেটের মাপ দেখা হয়। পরের ধাপে সেই ছবি দেখে নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নেওয়া হয়। এর পরে বেছে নেওয়া জায়গায় একটি সূচ পাঠানো হয়। ওই সূচটি ওই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে টিস্যু বা কোষ তুলে নিয়ে আসে। তার পরের ধাপে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা হয় যে ওই কোষগুলির মধ্যে কোনও কোষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে কি না।

প্রশ্ন: হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল বায়োপসিতে ক্যানসারে আক্রান্ত কোষের সন্ধান মেলা মানেই কি প্রস্টেট ক্যানসার হয়েছে?
উত্তর: না আরও প্রমাণের দিকে হাঁটেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসার সুবিধার জন্য আরও একটি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে আমরা রক্তের পিএসএ পরীক্ষা করতে বলি।

প্রশ্ন: পিএসএ পরীক্ষাটি কী?
উত্তর: পিএসএ হল প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেনের পরীক্ষা। রক্তের মধ্যে এই ধরনের অ্যান্টিজেনের খোঁজ করা হয়।

প্রশ্ন: এই পরীক্ষার মাধ্যমে কী বোঝা যায়?
উত্তর: এই পরীক্ষার ফলে প্রস্টেটের হরমোনের তারতম্য ধরতে পারা যায়।
প্রশ্ন: কতদূর পর্যন্ত হরমোনের তারতম্য ঠিক থাকা দরকার?
উত্তর: পিএসএ-এর ফলাফল চারের উপরে থাকলেই সমস্যা হয়েছে বলে দেখে নিতে হবে।

প্রশ্ন: তা হলে কি পিসএসএ চারের উপরে থাকলেই প্রস্টেট ক্যানসার হয়েছে ধরে নিতে হবে?
উত্তর: একদমই নয়। বায়োপ্সি পরীক্ষার ফলাফলে ক্যানসার আক্রান্ত কোষের সন্ধান না পাওয়া গেলে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরুই হবে না। ওই যে বললাম সাক্ষী জোগাড় করার জন্য পিএসএ পরীক্ষা করা হয়।

প্রশ্ন: পিএসএ চারের উপরে থাকলে কী চিকিৎসা করা প্রয়োজন?
উত্তর: পিএসএ চারের উপরে থাকলে বিনাইন টিউমার ধরে চিকিৎসা শুরু হবে।

প্রশ্ন: অনেকেই বললেন রেডমিট মানে পাঁঠার মাংস খেলে নাকি প্রস্টেট ক্যানসার হতে পারে? এটা কি সত্যি?
উত্তর: আগেই বলেছি প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ে নানা গবেষণা চলেছে। কিছু গবেষণার ফল বলছে রেডমিট খেলে ক্যানসার হতে পারে।

প্রশ্ন: তা হলে রেডমিটের সঙ্গে প্রস্টেট ক্যানসারের যোগাযোগটি ঠিক কী?
উত্তর: প্রথমেই বলা হয়েছে প্রস্টেট ক্যানসার মূলত হরমোনের সমস্যা থেকে দেখা দিতে পারে। রেডমিট জাতীয় খাবার বেশি খেলে ফ্যাট বাড়বে। আর ফ্যাট বাড়লে হরমোন বাড়বে— সেই কারণে বলা হয় রেডমিট খেলে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তবে আমরা খাবারের উপরে কিন্তু খুব একটা বাধানিষেধ আরোপ করি না।

প্রশ্ন: আপনি প্রথমেই বলছিলেন, প্রস্টেট ক্যানসার অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। অনেক সময় রোগী প্যারালিসিস বা পক্ষাঘাত পর্যন্ত হয়ে যায়। এটা আপনারা কী ভাবে ধরে থাকেন?
উত্তর: প্রথমে আমরা প্রস্টেট ক্যানসারের হয়েছে কি না, মানে‌ শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করে ফেলব। তার পরের ধাপে ধরতে হবে শত্রুর বিস্তার কতটা হয়েছে। মানে শরীরের কোথায় কোথায় শত্রু বাসা বাঁধতে পারে তার খোঁজ করা হবে। মূলত হাড়ের উপরেই শত্রুর নজর থাকে। সে জন্য আমরা পুরো শরীরের হাড়ের স্ক্যান করাব। সেখান থেকেই শত্রু আরও কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কি না তা ধরা পড়ে যায়।

প্রশ্ন: বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পুরো শরীরের হাড়ের স্ক্যান করা সম্ভব?
উত্তর: আমাদের এখানে শরীরের পুরো হাড়ের স্ক্যান করার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তা গড়ে ওঠেনি।

প্রশ্ন: তা হলে কি প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা বর্ধমানে করা সম্ভব নয়?
উত্তর: না, তা কেন হবে। বরং আমরা গর্বের সঙ্গে দাবি করতে পারি, কলকাতার অনেক সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা অনেক আধুনিক মানের হয়। এখানে সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি পাওয়া যায়।

প্রশ্ন: কী ভাবে শুরু হবে এই চিকিৎসা?
উত্তর: ইউরোলজিস্টরা পরীক্ষার পরে ক্যানসারের প্রমাণ পেলে আমাদের কাছে পাঠাবেন। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার করে ফেললেই রোগ নিরাময় হয়ে যাওয়া সম্ভব।

প্রশ্ন: অস্ত্রোপচার সম্ভব না হলে?
উত্তর: অস্ত্রোপচার সম্ভব না হলে প্রথমে আমরা জায়গা নির্দিষ্ট করে টেলিথেরাপি দেওয়া হবে। তাতে কাজ না হলে ব্রাকি থেরাপি।

প্রশ্ন: কিন্তু এ ধরনের ক্যানসার হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে কী হবে?
উত্তর: প্রস্টেট ক্যানসার হাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রমাণ পেলে তখন আমরা ‘রে’ দিয়ে থাকি।

প্রশ্ন: চিকিৎসা কী এখানেই শেষ?
উত্তর: না, তা কেন হবে। চিকিৎসা শেষ সেটা কে বলল? প্রস্টেট ক্যানসারের জন্য আমরা হরমোন থেরাপি দিয়েও চিকিৎসা করে থাকি।

প্রশ্ন: হরমোন থেরাপি কী? তা কী ভাবে হয়?
উত্তর: হরমোন থেরাপি আবার দু’রকমের হয়। একটি হলো অস্ত্রোপচার। আর একটি ধাপ হলো ওষুধ খাওয়া।

প্রশ্ন: আবার অস্ত্রোপচার? আগেই তো অস্ত্রোপচারের কথা বলা হয়েছিল?
উত্তর: না এটা আলাদা ধরনের অস্ত্রোপচার। এই অস্ত্রোপচারে, হরমোন থেরাপিতে, সম্ভব হলে শুক্রাণু গ্রন্থি কেটে দেওয়া হয়। এই চিকিৎসকে বলা হয়—অর্কিড টেটোমি।

প্রশ্ন: আর ওষুধ খাওয়ার চিকিৎসটা কী ভাবে হয়?
উত্তর: বাইরে থেকে হরমোনের ওষুধ দিয়ে প্রস্টেটের হরমোনের মাত্রাকে ঠিক অবস্থায় রাখা হয়। তবে এই চিকিৎসা কিন্তু বেশ ব্যয়সাধ্য। অনেক সময় সরকারি হাসপাতাল থেকেও এই ওষুধ দেওয়া হয়।

প্রশ্ন: এর পরেও যদি ক্যানসার সেরে না যায়, তা হলে পরবর্তী চিকিৎসার পদ্ধতি কী?
উত্তর: তখন আমাদের কেমোথেরাপি দিতে হয়। আমাদের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে কেমোথেরাপি-সহ উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব হয়।

প্রশ্ন: এত কিছু করলে তো শরীরে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে না?
উত্তর: এখন আর সে দিন নেই। সেই ভয়ও নেই। আগেই তো বললাম বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। ভাল রেডিওথেরাপিস্ট রয়েছে। কাজেই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা কম।

প্রশ্ন: দেরিতে এই রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা করা কি সম্ভব?
উত্তর: অবশ্যই রয়েছে। প্রস্টেট ক্যানসারে তো এটাই বড় সুবিধা। শুরুতে ধরা পড়লে রোগমুক্তি, আর কোনও কারণে দেরিতে ধরা পড়লেও ভোগান্তিহীন জীবন পাওয়া যায়।

প্রশ্ন: সে জীবন কত দিনের? অ্যাডভান্স প্রস্টেট ক্যানসার মানে কি মৃত্যুর পরোয়ানা?
উত্তর: ভুল ধারণা। অন্য কোনও কারণে মৃত্যু হতে পারে। তবে প্রস্টেট ক্যানসারের জন্য নয়।

প্রশ্ন: প্রস্টেট ক্যানসারের জন্য নয়?
উত্তর: ঠিকমতো চিকিৎসা করালে প্রস্টেট ক্যানসারের রোগী বছরের পরে বছর বেঁচে থাকতে পারেন।

Cancer Doctor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy