Advertisement
E-Paper

সংসার কি সত্যিই সুখের হয় শুধু রমণীর গুণে? নারীবাদ নিয়ে এত হাসি-ঠাট্টা কেন তবে?

হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে নারীবাদী আন্দোলনের প্রত্যেকটি প্রয়াসকে হেয় করা রোজকার ব্যাপার। ভারতে গৃহহিংসা বিরোধী আইন নিয়ে চটুল রসিকতা প্রায় সকলেই করেন। কিন্তু নারীবাদ নিয়ে এত মজা করার দরকার কেন?

Women\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s Day 2025, feminism is perceived as a laughing matter or joke by patriarchal society

নারীবাদী চেতনা পুরুষতন্ত্রের পক্ষে বিশেষ ঝামেলার। চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।

সমতা বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৩৩
Share
Save

এক দিকে শুনি, মেয়েরাই অর্ধেক আকাশ।

অন্য দিকে জবাব আসে, ‘‘আরে, নাসা এখনও চাঁদে ‘মেয়েমানুষ’ কেন পাঠায়নি? আরে চাঁদে এখনও রান্নাবান্না, ঘর গোছানোর কাজ-কাম নাই, তাই!’’

প্রায় দশ বছর আগে আমার ভীষণ প্রিয়, ভীষণ বিচক্ষণ এক (পুরুষ) বন্ধু হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘বেশি ফেমিনিস্ট ফেমিনিস্ট কথা বোলো না তো’!

ফেমিনিস্ট, অর্থাৎ নারীবাদী। তার আগে পর্যন্ত আমি ভাবতাম, আমরা যাঁরা রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক এবং গবেষণার দিক দিয়ে একই পথের পথিক, তাঁরা সকলে নারীবাদীও বটে।

নাইজ়িরিয়ার লেখক ও সমাজকর্মী চিমানান্দা আদিচির সহজপাঠ্য বইয়ের নাম ‘উই শুড অল বি ফেমিনিস্টস’। যার মানে হল, আমাদের সকলের নারীবাদীই হওয়া উচিত (আজকে অবশ্য আদিচিকে উদ্ধৃত করতে আমার একটু অস্বস্তি হয়, রূপান্তরকামী মেয়েদের তিনি মেয়ে বলে স্বীকৃতি দেন না, তাই)। বইটির শিরোনাম বড়ই নজরকাড়া। ছোট থেকে বড় হওয়ার সময়ে সচেতন ভাবেই সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে পড়াশোনা এবং তার পরে গবেষণা করার ফলে নারীবাদী অবস্থান, যাকে অধ্যাপক ও লেখক নিবেদিতা মেনন বলেন ‘সিয়িং লাইক আ ফেমিনিস্ট’, বা নারীবাদীর মতো দেখা, সে অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু বন্ধুবরের ওই বাক্যবাণ আমাকে বেশ বিহ্বল করে তোলে।

Women's Day 2025, feminism is perceived as a laughing matter or joke by patriarchal society

অনেকের কাছে ‘ফেমিনিস্ট’ বা ‘নারীবাদী’ একটি হাসির কথা। কাউকে গালাগালি করতে হলেও ব্যবহার করা হয় সেই শব্দ। ছবি: সংগৃহীত।

তবে বিচলিত হলেও, এড়িয়ে যাওয়া যায় না সত্যটা। নারীবাদ নিয়ে নানা কথা, হাসি-টিপ্পনী চলতেই থাকে গোটা সমাজে। শুধু আমার সেই বন্ধু নন, অনেকের কাছে ‘ফেমিনিস্ট’ বা ‘নারীবাদী’ একটি হাসির কথা। কাউকে গালাগালি করতে হলেও ব্যবহার করা হয় সেই শব্দ।

নারীবাদীদের কারা গালি দেন? দক্ষিণপন্থী, গোঁড়া , পিতৃতান্ত্রিকরাই তো? কারণ, নারীবাদ সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে, ঘরের নোংরা লন্ড্রি, অর্থাৎ, ঘরের কথা— গার্হস্থ্য হিংসা বা বঞ্চনার কথা প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, একই কাজের জন্য সমান সমান পারিশ্রমিক দাবি করে, যৌনতার কথা বলতে লজ্জা পায় না, গর্ভপাতকে সমর্থন করে, প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনপরিচয়ের মানুষের দাবিকে নারীবাদী দাবি বলে স্বীকৃতি দেয়। কেউ কেউ আবার গৃহশ্রম, মানে নিজের ঘরের কাজ— রান্না করা, শিশু বা বয়স্কদের দেখাশোনার জন্য পারিশ্রমিকের কথা বলেন। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার কঠোরতম শাস্তি চান, বিজ্ঞান থেকে প্রযুক্তি, খেলাধুলো থেকে ব্যবসা, সব ক্ষেত্রে যোগদানে মেয়েদের উৎসাহ দেন।

আপাতদৃষ্টিতে চিরায়ত, অর্থাৎ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মুখে এগুলি সজোরে থাপ্পড়। বাড়ির কাজকে কাজ বা শ্রম বলে স্বীকৃতি না দিলে নানা রকম ভাল ভাল ঘটনা ঘটতে পারে। মেয়েদের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয় না, আর যাঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে (অন্যের) ঘরের কাজ করেন, সেই ‘ঝি-চাকরদের’ নূন্যতম মজুরিই টিকে থাকে। যৌনতার কথা প্রকাশ্যে বললে বিসমকামী বিবাহের মোড়কে তাকে আটকে রাখা যায় না। কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত আদিরসাশ্রিত কৌতুককে যৌন হেনস্থার তকমা দেওয়া হলে অনেক পুরুষ বিপাকে পড়েন।

Women's Day 2025, feminism is perceived as a laughing matter or joke by patriarchal society

কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা-বিরোধী আইনের আওতায় আসা অনেক ঘটনাকেই কিন্তু ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া বহুলপ্রচলিত। ছবি: সংগৃহীত।

বোঝাই যাচ্ছে নারীবাদী চেতনা পুরুষতন্ত্রের পক্ষে বিশেষ ঝামেলার। তাকে কী ভাবে ঠেকানো যায়? একটা উত্তর অবশ্যই বলপ্রয়োগ। ভারতে ও পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যাঁরাই প্রচলিত ব্যবস্থার অন্য দিকে যান, তাঁদের উপর নেমে আসে আঘাত। ন’মাসের শিশুর বিয়ে আটকানোর অপরাধে ভাঁওরি দেবীকে ধর্ষণ করে পাঁচ জন তথাকথিত উচ্চ বর্ণের পুরুষ। বর্ণ-ধর্মের বাইরে প্রেম করলে করা হয় ‘সম্মানরক্ষার্থে হত্যা’, একই লিঙ্গের মানুষকে ভালবাসার পরিণাম ‘সংশোধনমূলক ধর্ষণ’। একশো বছর আগে মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবিতে সরব গোষ্ঠীগুলি আমেরিকা থেকে ব্রিটেন সর্বত্র অত্যাচারিত।

কিন্তু শুধুমাত্র শারীরিক বা প্রাতিষ্ঠানিক হিংসা নয়। হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে নারীবাদী আন্দোলনের প্রত্যেকটি প্রয়াসকে হেয় করা রোজকার ব্যাপার। ভারতে গৃহহিংসা-বিরোধী আইন নিয়ে চটুল রসিকতা প্রায় সকলেই করেন। যেখানে হাত চালানো যায় না, চোখ রাঙানো যায় না, সেখানে টিপ্পনী তো কাটাই যায়! মশকরাও একটি অস্ত্র। পুরুষতন্ত্র তা ভাল ভাবেই প্রয়োগ করেছে বরাবর। তাই তো আমার সেই বন্ধু সহজে ‘ফেমিনিস্ট’ বলে হাসলেন। তিনি তো আর আমাকে মারতে পারতেন না। কিন্তু ও রকম ঠাট্টা থাপ্পড়ের থেকে কম কিছু কি?

কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা-বিরোধী আইনের আওতায় আসা অনেক ঘটনাকেই কিন্তু ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া বহুলপ্রচলিত, মেয়েদের বলা হয়, ‘এত কঠিন ভাবে নিচ্ছ কেন, ঠাট্টাই তো করছি’! তা কি শুধুই ঠাট্টা? তা কি হিংসা নয়? যে কোনও জিনিস যা অস্বস্তি তৈরি করে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি অস্ত্র কিন্তু ঠাট্টাও। তা কি ভুলে যাওয়া যায়? নারীবাদও যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তেমনই একটি ‘অস্বস্তি’। ফলে নারীবাদীরা ঠাট্টার শিকার হন বার বার। এখনও।

Women's Day 2025, feminism is perceived as a laughing matter or joke by patriarchal society

নারীকে পূর্ণ হতে পুরুষের প্রয়োজন হয় না। ছবি: সংগৃহীত।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কলকাতার ব্যঙ্গচিত্রে জায়গা পান খোঁপা বাঁধা, বগলদাবা করে ছাতা ধরা কেরানি মহিলা। তার পঞ্চাশ বছর আগে পড়াশোনা জানা মেয়ে পটচিত্রের কটাক্ষের নিয়মিত শিকার। অফিস-কাছারি, বাড়িতে, রাস্তায়, লিঙ্গবিদ্বেষকে রসিকতার মোড়কে হামেশাই পেশ করা হয়। বোকামির সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায় ‘ব্লন্ড’ পরিচয়, অক্ষমতার সঙ্গে হাতে চুড়ি পরা। নারীবাদী মানুষ বেরসিক সাব্যস্ত হন।

নামজাদা দার্শনিক সারা আহমেদের টুইটার (অধুনা এক্স) হ্যান্ডেল ‘ফেমিনিস্ট কিলজয়’— মূর্তিমান নারীবাদী নিরানন্দ— নারীবাদী বেরসিক। আহমেদের বইয়েরও তাই নাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী যখন গর্বের সঙ্গে জানান দেন, তাঁর বাড়ির বৌয়েরা চাকরি করেন না, তার ফলে বাড়িতে শান্তি বজায় থাকে, তখন আমার নিজেকে এই নিরানন্দের মূর্তিই মনে হয়। নারীবাদী নিরানন্দ হামেশাই অনুভব করি, নারীবাদী আনন্দ কী?

আজকাল আবার টিভিতে দেখা যাচ্ছে বাংলা ধারাবাহিক, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। মূর্তিমান নারীবাদী নিরানন্দ বলবেন, মানে আমি নিজেই বলব, শুধু রমণী কেন, নারী-পুরুষ সকলেই সংসারকে সুখের করতে পারেন। কিংবা সংসার মেয়েদের কাছে সহিংসতা/ বঞ্চনার ঠাঁই। অথবা, শুধুমাত্র সংসারের গণ্ডিতে রমণীরা আবদ্ধ কেন থাকবেন, সারা পৃথিবীর সুখ কি তাঁর কাম্য নয়? তিনটেই সত্যি, আর প্রয়োজনীয় কথা।

নারীবাদী বেরসিক/ নিরানন্দ তকমা ঘোচাতে আমরা কী বলব?

১৯৭০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ায় নারীবাদী ছাত্রীদের (এখন সকলের) পরিচিত স্লোগান, ‘আ উওম্যান নিডস আ ম্যান, লাইক আ ফিশ নিডস আ বাইসাইকেল’। মানে, একটা মাছের ঠিক যতটা সাইকেলের প্রয়োজন, মেয়েদেরও ততটাই প্রয়োজন পুরুষকে। অর্থাৎ, নারীকে পূর্ণ হতে পুরুষের প্রয়োজন হয় না। মূর্তিমান নারীবাদী আনন্দ, ঠাট্টা, মশকরার প্রতীক এই প্রবাদের ভাবকেই কি আমরা পুরুষতান্ত্রিক ব্যঙ্গের/ কথকতার/ প্রবাদের প্রতিকার হিসাবে ঠাওর করব?

যদি করি, তা হলে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’- এর পরের পঙ্‌ক্তি হতে পারে— ‘যদ্দিন ধরা থাকে চুন তার পানে’। কারণ, পান থেকে চুন খসলে সুখের সংসার ছারখার হতে কত ক্ষণ?

(লেখক সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)

Women's Day Special Women's Day Feminism Patriarchal Society

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}