Advertisement
E-Paper

চিকিৎসকের গোত্র গোপন করে ঠগবাজি হাসপাতালে

ধোঁকা দেওয়া হয় মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া বা এমসিআই-এর পরিদর্শকদের। ডাক্তারের অভাব এবং পরিকাঠামোর ঘাটতি ঢাকতে অন্য হাসপাতালের চিকিৎসক এবং সরঞ্জাম এনে কুমিরছানা দেখানোর রেওয়াজ এ রাজ্যে বহু পুরনো। একই ভাবে ঠকানো হচ্ছে রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়দেরও। স্রেফ চেপে যাওয়া হচ্ছে ডাক্তারের গোত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:১৩

ধোঁকা দেওয়া হয় মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া বা এমসিআই-এর পরিদর্শকদের। ডাক্তারের অভাব এবং পরিকাঠামোর ঘাটতি ঢাকতে অন্য হাসপাতালের চিকিৎসক এবং সরঞ্জাম এনে কুমিরছানা দেখানোর রেওয়াজ এ রাজ্যে বহু পুরনো।

একই ভাবে ঠকানো হচ্ছে রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়দেরও। স্রেফ চেপে যাওয়া হচ্ছে ডাক্তারের গোত্র।

অ্যালোপ্যাথিতে দ্রুত নিরাময়ের আশায় সঙ্কটাপন্ন রোগীকে নিয়ে বাড়ির লোকেরা ছুটলেন হাসপাতালে। রোগী দেখে কিছু ‘জরুরি’ ওষুধ দিলেন ইমার্জেন্সির চিকিৎসক। তাঁর পরামর্শে ভর্তিও করানো হল। কয়েক দিনের টানাপড়েনের পরে রোগী বাড়ি ফিরলেন বা মারা গেলেন। কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজন জানতে পারলেন কি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেই ডাক্তারের পরিচয়? খোঁজ নিলে জানা যাবে, ওই ডাক্তার আসলে আয়ুর্বেদ বা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন!

শুধু জরুরি বিভাগ নয়, খাস কলকাতায় অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার অনেক হাসপাতালে বহির্বিভাগ, আইসিইউ, আইটিইউ, অপারেশন থিয়েটারেও আয়ুর্বেদ ও হোমিও চিকিৎসকেরা কাজ করে চলেছেন বহাল তবিয়তে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা তা জানতেও পারছেন না। তাঁদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা চলছে সরকারি-বেসরকারি দু’ধরনের হাসপাতালেই। এমসিআই-কে বেশি ধোঁকা দেয় সরকারি হাসপাতাল আর ডাক্তারের গোত্র গোপন করার খেলাটা বেশি বেসরকারি হাসপাতালে।

অথচ সরকারি নিয়মকানুন বলছে, হোমিও বা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক কোনও অ্যালোপ্যাথি হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন না, বহির্বিভাগে রোগীও দেখতে পারেন না। তবে তাঁরা ওই সব হাসপাতালে ‘সহযোগী’ হিসেবে কাজ করতে পারেন। কেমন সহযোগী, তার ব্যাখ্যা দেওয়া আছে নিয়মবিধিতে। সহযোগী মানে হাসপাতালের এমবিবিএস বা ভিজিটিং ডাক্তারদের সঙ্গে থেকে চিকিৎসা-পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করা, অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার কী ভাবে হচ্ছে তা দেখা, মাঝেমধ্যে রোগীকে স্যালাইন দেওয়া, রক্ত নেওয়া, রক্তচাপ মাপা, ব্যান্ডেজ বাঁধা। কিন্তু বহির্বিভাগে রোগী দেখা বা প্রেসক্রিপশন লেখা চলবে না।

তবু নিয়ম ভেঙে এমনটা যে হামেশাই করা হচ্ছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সরকারি হাসপাতালের কর্তারা। তাঁদের সাফাই, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ‘কর্মরত’ এই সব হোমিও বা আয়ুর্বেদ ডাক্তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখছেন বা বহির্বিভাগে রোগী দেখছেন কি না, তার উপরে নজরদারি চালানোর পরিকাঠামো তাঁদের নেই।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ভবনে একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিষয়টি কর্তাদের নজরে আসে। কয়েক বছর আগে ফুলেশ্বরে একটি বেসরকারি হাসপাতাল চালু হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত তো বটেই, এ রাজ্যের অনেক ডাক্তারও বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে এসে ওই হাসপাতালে যোগ দেন। সেখানকারই কয়েক জন চিকিৎসক স্বাস্থ্য ভবনে লিখিত অভিযোগে জানান, নিয়মিত বেতন না-পেয়ে বহু অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসক হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করছেন হোমিওপ্যাথরা। তাঁঁরা রোগী দেখেন, অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লেখেন প্রেসক্রিপশনে। আইটিইউ বা ওটি-র বিভিন্ন কাজেও যোগ দেন। এ ভাবে রোগীদের ঠকানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ওই ডাক্তারেরা।

স্বাস্থ্য ভবনের খবর, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, এমআর বাঙুর, বিধাননগর স্টেট জেনারেলের মতো অনেক সরকারি হাসপাতালে হোমিও বা আয়ুর্বেদ চিকিৎসকেরা ইন্টার্ন হিসেবে ৪-৫ মাস প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। ভিজিটিং চিকিৎসকেরা বহু ক্ষেত্রেই নিজেদের কাজ চাপিয়ে দেন হাউসস্টাফদের উপরে। আর হাউসস্টাফেরা সেই দায়িত্ব চালান করে দেন প্রশিক্ষণ নিতে আসা হোমিও বা আয়ুর্বেদ ইন্টার্নদের ঘাড়ে। দক্ষিণ কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালের এক কর্তার কথায়, “হোমিও বা আয়ুর্বেদ ইন্টার্নদের উপরে দায়িত্ব দিয়ে হাউসস্টাফেরা চলে গিয়েছেন, এমন উদাহরণ বহু। দেখা যাচ্ছে, এই সব ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনে অ্যালোপ্যাথি ওষুধের নামের বানান ভুল লেখা হয়েছে। নির্দিষ্ট ওষুধের বদলে অন্য ওষুধ লিখেছেন বা মুখে ওষুধের ভুল নাম বলেছেন, এমন নজিরও কম নেই। এতে ক্ষতি হচ্ছে রোগীদের।”

কী বলছে সরকার?

রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে মনে করেন, আয়ুর্বেদ বা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকেরা পরিচিত ও বহু ব্যবহৃত কিছু অ্যালোপ্যাথি ওষুধ রোগীদের দিলে তাতে দোষের কিছু নেই। তাঁর যুক্তি, “ব্লকে ব্লকে আশা প্রকল্পের কর্মীদের মাধ্যমেও তো সাধারণ জ্বর, পেট খারাপ, যক্ষ্মার ওষুধ বা আয়রন ফলিক অ্যাসিড বিলি করা হচ্ছে। তাঁর প্রশ্ন, “আশা-কর্মীরা চিকিৎসক না-হয়েও যদি ওই কাজ করতে পারেন, হাসপাতালে আয়ুর্বেদ বা হোমিওপ্যাথ ইন্টার্নেরা প্রচলিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দিলে অসুবিধা কোথায়?”

স্বাস্থ্যসচিবের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বহু ডাক্তার। তাঁদের প্রশ্ন, হাসপাতালে সকলেই কি জ্বর-সর্দি-যক্ষ্মার চিকিৎসা করাতে আসেন? হাসপাতালে কার কী দরকার, সেটা রোগীর অবস্থা বুঝে ঠিক করেন ডাক্তার। হোমিও বা আয়ুর্বেদ ডাক্তার রোগীর সবটুকু বুঝে ঠিকঠাক অ্যালোপ্যাথি ওষুধ দেবেন, সেই নিশ্চয়তা সরকার দেবে কী ভাবে?

“গ্রামাঞ্চলে হাতুড়েদের দেওয়া অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার থেকে এই ব্যবস্থা অনেক ভাল,” বলছেন স্বাস্থ্যসচিব মলয়বাবু।

শুধু রোগী দেখা নয়। বহু ক্ষেত্রে হাসপাতালের নিজস্ব প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির রিপোর্টেও সই করছেন ভিন্ন গোত্রের ওই ডাক্তারেরা। এবং স্বাস্থ্যকর্তারাই জানান, এটা বেআইনি। তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?

“লিখিত অভিযোগ জমা না-এলে আমাদের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়,” বললেন এক স্বাস্থ্যকর্তা।

প্রশ্ন উঠেছে, হাসপাতালের ডাক্তার অ্যালোপ্যাথ না হোমিওপ্যাথ রোগীরা বুঝবেন কী ভাবে? এবং সেটা না-জানলে তাঁরা অভিযোগ করবেন কীসের ভিত্তিতে? কর্তাদের কাছে এর উত্তর নেই।

কলকাতার প্রায় সব নামী বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, সেখানে গড়ে পাঁচ থেকে ১৫ জন আয়ুর্বেদ বা হোমিও ডাক্তার রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার বা ওয়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। আলিপুরের একটি হাসপাতালের কর্তার পাল্টা প্রশ্ন, “সরকারি হাসপাতাল যদি ওই সব চিকিৎসককে দিয়ে কাজ করাতে পারে, আমরাই বা করাব না কেন?”

রীতিমতো হিসেব দিয়ে ই এম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা দেখিয়ে দিয়েছেন, কত কম খরচে ওই সব চিকিৎসককে দিয়ে কাজ করানো যায়! তিনি বলেন, “এমবিবিএস পাশ করা আরএমও রাখলে আইসিসিইউ-এর জন্য ঘণ্টায় ২৪০-৩০০ টাকা আর ওয়ার্ডের জন্য ঘণ্টায় ২৩০-২৮০ টাকা দিতে হয়। সেই জায়গায় ঘণ্টায় ১৩০-১৮০ টাকা ফেললেই হোমিও বা আয়ুর্বেদ ডাক্তার মেলে। আমরা এই ফায়দাটা নেবই।” রাত জাগার জন্যও যে তাঁরা ভিন্ন গোত্রের ওই ডাক্তারদের উপরে নির্ভর করেন, সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন সল্টলেকের একটি হাসপাতালের কর্তা। তিনি বলেন, “নাইট ডিউটিতে বেশির ভাগ সময়েই অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার পাওয়া যায় না। তখন হোমিও বা আয়ুর্বেদ ডাক্তারেরাই ভরসা। তাঁরা গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ওয়ার্ডে একটু পায়চারি করলে রোগীরা মনে করেন, তাঁদের দেখার জন্য কোনও ডাক্তার রয়েছেন। আমাদেরও চাপ কমে।”

সঙ্কটাপন্ন রোগী এলে হোমিও বা আয়ুর্বেদ ডাক্তারেরা কী ভাবে সামলাবেন? ওয়ার্ডে কোনও রোগীর অবস্থা খারাপ হলে কী করবেন তাঁরা?

“তখন ওঁরা কোনও অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারকে ফোন করে রোগের লক্ষণ বলে ওষুধ জেনে নেন। অনেক সময় অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারকে ডেকেও নেওয়া হয়,” বললেন সল্টলেক হাসপাতালের ওই কর্তা।

আর স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাহায্যকারীর কাজ করতে গিয়ে চিকিৎসায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ যতই নিয়মবিরুদ্ধ হোক, বিভিন্ন হাসপাতালে হ্যোমিওপ্যাথ ও আয়ুর্বেদ ডাক্তারদের ভূমিকা আপাতত মোটেই বদলাচ্ছে না।

mci soma mukhopadhyay parijat bandyopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy