চলছে চিকিত্সা শিবির।—নিজস্ব চিত্র।
“আয়লার পর ছ’বছর হতি চলল এখনও খেতে ধান নাই। চোখে দেখতি পাই না, ওষুধও নাই”-- সুন্দরবনে খটখটে রোদ মাথায় করে লাইনে দাঁড়িয়ে এমনই ‘নেই’ রাজ্যের কথা এক নাগাড়ে শুনিয়ে যাচ্ছিলেন হেঁতালবাড়ির বাসিন্দা, বছর পঁয়তাল্লিশের কমলা মণ্ডল। গোটা রাজ্যের কাছে আয়লা ইতিহাস। সুন্দরবনের এই মানুষগুলোর কাছে এখনও ঝড়ের ঝাপটা তেমনই দুঃসহ।
বানতলা দিয়ে বাসন্তী রোড (রাজ্য সড়ক ৩) ধরে ঘন্টা তিনেকে পৌঁছনো যায় ধামাখালি। সেখান থেকে লঞ্চে করে আরও ঘন্টা দু’য়েক গিয়ে ছোটমোল্লাখালির মঙ্গলচন্দ্র বিদ্যাপীঠ। স্কুলের মাঠে স্বাস্থ্য-শিবির। ডাক্তার দেখাতে লাইনে সকাল-সকাল প্রায় শ’-আটেক মানুষের ভিড়। হঠাত্ দেখলে যেন মনে হয়, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের ঝড়-বিধ্বস্ত জেলেপাড়ায় এসে পড়েছি। শিশুদের গা উদোম, বড়দের শাড়ি-ধুতি বহুবার সেলাইয়ের দাগ। সকলেরই পায়ে কাদা শুকিয়ে রয়েছে। দারিদ্র নিজেকে ঘোষণা করছে সোচ্চারে।
শিবিরের শুরুতেই বুকে ব্যাথার উপসর্গ নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এলেন এক বৃদ্ধ সারেং। ভোটার কার্ড অনুযায়ী তাঁর বয়স ১০০ পেরিয়েছে। একখানা শতছিন্ন কালো জোব্বা পরা প্রাক্তন সেই সারেং গল্প করতে করতে বললেন, এলাকার ভরসা হাতুড়ে ডাক্তারেরা তাঁকে প্রায় দু’মাস ধরে শুধু ব্যথার ওষুধ দিয়ে গিয়েছেন। শিবিরে যোগ দেওয়া কলকাতার হৃদ-রোগ বিশেষজ্ঞ মুক্তিশ সরকারের ইসিজি যন্ত্রে দেখা গেল, হার্টে ব্লক। দরকার অস্ত্রোপচারের।
পাশের ঘরে তখন এক চোখ চেপে ডাক্তারবাবুর জন্য অপেক্ষা করছেন মৌখালির বাসিন্দা অনুরাধা মৃধা (৫৪)। বনে মৌচাক ভাঙতে গিয়ে চোখে মৌমাছির হুল ফুটেছে। এতদিন স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে পাওয়া ‘ড্রপ’ই ছিল ভরসা। অনুরাধাদেবীর মতো প্রায় ৩৭ জনকে ঘটকপুকুরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। প্রায় ২৫০ জনকে বিনামূল্যে দেওয়া হল চশমা। আরও কতজন চশমার দাবিদার আসতেই পারেননি শিবিরে, কে জানে।
অসুখ-বিসুখ, অপুষ্টি, দুর্বলতা যেন লেপটে আছে সুন্দরবনের বসতিপূর্ণ ৫২টি দ্বীপের সঙ্গে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সুন্দরবনের প্রতি তিন জন শিশুর এক জন অপুষ্টির শিকার। শিবিরেও সেই ছবিই স্পষ্ট হল। সামসুরের মতো শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগে পেট ফুলে ঢোল। চিকিত্সা করতে করতেই হাওড়ার সরকারি হাসপাতালের চিকিত্সক দীপঙ্কর দোলাই জানান, সুন্দরবন এলাকার শিশুদের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। মাঝেসাঝে চটজলদি শিবির করে সামাল দেওয়া যাবে না। পাশ থেকে ঘাড় নাড়লেন সুন্দরবন কোস্টাল থানার অ্যাসিস্ট্যান্ড সাব ইন্সপেক্টর সুমিত দে এবং ওসি হিমাংশু বিশ্বাস।
কিন্তু তেমন দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা কোথায়? এ দিনের স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করেছিলেন আয়কর বিভাগের প্রাক্তন কর্তা অশোককুমার বালা এবং ঘটকপুরের বাসিন্দা এমএ ওয়াহাব। আয়লার সময় কমলাদের জন্য ত্রাণের কাজ করতে করতেই একদিন হঠাত্ মরিচঝাঁপিতে পরিচয় হল দু’জনের। তখনই তাঁরা ঠিক করলেন কমলাদের জন্য কিছুটা হলেও পৌঁছে দেবেন চিকিত্সা। তারপর থেকে নিয়মিত শিবির করেন। অস্থায়ী শিবির থেকে ক্রমশ স্থায়ী ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ঘটকপুকুরে চোখের হাসপাতালটি ওয়াহাব সাহেব নিজের উদ্যোগে তৈরি করেছেন। অশোকবাবু জানান, লাক্সবাগানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ‘সেবা কেন্দ্র।’ বিধাননগরের বাসিন্দা অশোকবাবু বলেন, “আয়লার সময় এখানকার মানুষের দুর্দশা দেখে আমি আর আমার স্ত্রী অনুরাধা ঠিক করি, বাকি জীবনটা এঁদের সঙ্গেই কাটাব।”
অশোকবাবু আর ওয়াহাব সাহেবের আয়োজিত শিবিরই ভরসা সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপের অগণিত মানুষের। প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল আটটা নাগাদ নানা ঘাটে পৌঁছে যায় ওয়াহাব সাহেবদের লঞ্চ। লঞ্চেই এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষা হয়, প্রাথমিক চিকিত্সা করেন ডাক্তারবাবুরা। পাশে থাকে প্রশাসনও। শিবির চলতে চলতেই স্পিড বোট নিয়ে টহল দিয়ে ফিরেছেন সুন্দরবন কোস্টাল থানা, ছোটমোল্লাখালির এসআই বছর তিরিশের তাপস মণ্ডল। শিবিরে রোগীদের লাইন ঠিক করতে করতে তাপসবাবু বলেন, “যে কোনও ভাল কাজেই আমরা পাশে থাকি।”
নেমারের ছবিওয়ালা টি-শার্ট পরে খালি পায়ে ফুটবল খেলছিল দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া, আমতলির বাসিন্দা প্রসেনজিত্ মণ্ডল। বল ড্রিবল করতে করতেই সে বলল, “সুন্দরবনে একশোরও বেশি স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে। তবু লঞ্চ না এলে স্রেফ মৃত্যু দেখতে হয় চোখের সামনে।”
‘আবার কবে আসবে?’ নানা গলায়, চোখে, হাতের স্পর্শে এই প্রশ্নের মধ্যেই লঞ্চ ফেরার পথ ধরল রায়মঙ্গল দিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy