Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নবজাতকের মৃত্যুতে গাফিলতির অভিযোগ হাসপাতালের বিরুদ্ধে

প্রায় ১৬ ঘণ্টা প্রসব-যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন আসন্নপ্রসবা। এমনিতেই তাঁর উচ্চ রক্তচাপ ছিল। শেষ রাতে যখন স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে শিশু জন্মাল, তখন তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। দেড় দিন হাসপাতালের ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’-এ (এসএনসিইউ) তাকে বাঁচানোর চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু ৬ এপ্রিল দুপুরে প্রায় তিন কেজির ফুটফুটে, হৃষ্টপুষ্ট শিশুপুত্রটি মারা যায়।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৫
Share: Save:

প্রায় ১৬ ঘণ্টা প্রসব-যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন আসন্নপ্রসবা। এমনিতেই তাঁর উচ্চ রক্তচাপ ছিল। শেষ রাতে যখন স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে শিশু জন্মাল, তখন তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। দেড় দিন হাসপাতালের ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’-এ (এসএনসিইউ) তাকে বাঁচানোর চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু ৬ এপ্রিল দুপুরে প্রায় তিন কেজির ফুটফুটে, হৃষ্টপুষ্ট শিশুপুত্রটি মারা যায়।

ঘটনাস্থল: টালিগঞ্জের এমআর বাঙুর হাসপাতাল। সেখানকার এসএনসিইউয়ের চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, শিশুটির অন্য কোনও সমস্যা ছিল না। শুধুমাত্র সময় মতো প্রসব না-হওয়ায় তার প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। একটু আগে সিজার করা হলেই সে বেঁচে যেত। নবজাতকের মৃত্যু আটকাতে যখন জেলা জুড়ে উন্নত ডেলিভারি পয়েন্ট তৈরি করতে তৎপর স্বাস্থ্য দফতর, যখন সেই কেন্দ্রগুলির কাজের খতিয়ান চেয়ে পাঠানো হচ্ছে এবং ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্তরে সিজার করার উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে তখন কলকাতায় অবস্থিত দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রধান হাসপাতালে এই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে স্বাস্থ্য ভবনে।

রোগীর বাড়ির লোকের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক রকম স্বীকার করেই নিয়েছেন যে, পরিকাঠামোয় একটা বড়সড় ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। সোনারপুরের শিরপুর-বাদামতলার বাসিন্দা, সদ্য শিশুহারা দম্পতি শক্তি ও কাজল দাস বললেন, “আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়ে গেল। স্বাস্থ্য দফতর এত ঘোষণা করে যে শিশুকে বাঁচাতে বাড়িতে প্রসব না করিয়ে হাসপাতালে করান। কিন্তু জেলা হাসপাতালের মতো বড় জায়গায় রাতে যা পরিকাঠামো দেখলাম, এর থেকে বাড়িতে দাইয়ের কাছে বাচ্চা হলে খারাপ কিছু হত না মনে হচ্ছে।”

তাঁরা অভিযোগ করে বলেন, “৩ এপ্রিল মাঝরাতের পর থেকে স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান ডাক্তারকে পাওয়া যায়নি। তিনি বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। বাকি ডাক্তারবাবুরা কিছুতেই সিজার করেননিা। শেষ রাতে যখন বাচ্চাটা হল, তখন সে শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে গিয়েছে। বাচ্চার অবস্থা ডাক্তারেরা কিছুই আঁচ করতে পারলেন না?”

যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মুখে জোগায়নি সেগুলি হল প্রসবের রাতে স্ত্রীরোগ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন-কল চিকিৎসক রাত সাড়ে এগারোটার পরে হাসপাতালে ছিলেন না কেন? রোগিণীর যেখানে উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে এবং তিনি প্রথম বার গর্ভবতী, তখন প্রায় ১৬ ঘণ্টা তাঁকে প্রসব যন্ত্রণা-সহ ফেলে রাখা হল কেন? গর্ভস্থ শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে কি না বুঝতে বাঙুরে আধুনিক ডপলার যন্ত্র এবং ‘ফেটাল কার্ডিও টোপোগ্রাফি’ যন্ত্র রয়েছে। সেগুলি ব্যবহার না-করে চিকিৎসকেরা শুধু স্টেথোস্কোপের উপরে ভরসা করলেন কেন? যখন প্রসবে সমস্যা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছিল, তখন কেন অন কল-এ থাকা চিকিৎসককে বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেন না ডিউটিতে থাকা আরএমও এবং হাউসস্টাফেরা?

হাসপাতালের খাতায় দেখা যায়, ডেলিভারির দিন রাত ১১টা ৩৬ মিনিটে একটা সিজার হয়। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তার পরেই অন-কল স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বাড়ি চলে যান। হাসপাতালের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সেই সময় শক্তিদেবীর প্রসব-যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তাঁকে পরীক্ষাও করেন। পরে বাড়ি থেকে তিনি রোগিণীর অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ রাখলেন না কেন? কেনই বা গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা আঁচ করে আরএমও বা হাউসস্টাফেরাই সিজারের সিদ্ধান্ত নিয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠালেন না? একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ১০ এপ্রিল তাদের রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।”

স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়: “আমরা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক প্রসবের উপর জোর দিই, তা বলে মা বা শিশুর অবস্থা জটিল হচ্ছে বুঝেও সিজার না-করে ফেলে রাখাটা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। মায়ের শরীরে জল কমছে কি না, শিশুর সমস্যা হচ্ছে কি না সেটা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকেই লাগাতার নজরদারি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যখন কোনও রোগী প্রসব যন্ত্রণায় আছেন তাঁকে রেখে অন কলে থাকা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বাড়ি যান কী করে?”

সে দিন অন কল-এ ছিলেন চিকিৎসক অভিলাষা কুমার। তাঁর সাফাই, “সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাচ্চার হৃদ্স্পন্দন যাচাই করি। তখন কোনও সমস্যা পাইনি। অনেক সময়ে প্রসবে কোনও সমস্যা না থাকলেও বাচ্চা শ্বাসকষ্ট নিয়ে জন্মায়। আগে থেকে বোঝা যায় না।” প্রশ্ন করা হয়েছিল, সাড়ে এগারোটার পরে অনেকক্ষণ মায়ের প্রসব-যন্ত্রণা চলে। তখন কে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট নজরদারি করেছে? তিনি উত্তর দেন, “সেটা তো আরএমও বা হাউসস্টাফদের করা উচিত। খারাপ কিছু পেলে আমাকে ডাকা উচিত ছিল।”

আরএমও-রা পাল্টা বলছেন, “আমরা ডাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ চিকিৎসক রাতে আসতে চান না। উল্টে আমাদের গালমন্দ করেন। তা হলে আমরা দায়িত্ব নেব কেন?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE