Advertisement
E-Paper

প্রতাপদের চোখে আলো ফেরাচ্ছে সর্বশিক্ষা মিশন

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৭:৫৬

আকাশে বিমান গেলে মা ছোট্ট শিশুটিকে তা দেখানোর চেষ্টা করতেন। তা দেখতে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে সে-ও ছুট লাগাতো। কখনও মা তাকে কোলে তুলে দেখানোর চেষ্টা করতেন চাঁদও। কিন্তু ওই সব দেখতে কোথাও যেন শিশুটির অস্বস্তি হত। বাবা-মা এ নিয়ে অনেক সময় তাকে বকাঝকাও করতেন। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই বিষয়টি পরিষ্কার হল। শিশুটির অস্বস্তি দেখে স্কুলের দিদিমণিরা তাকে নিয়ে যান সর্বশিক্ষা মিশনের স্বাস্থ্য শিবিরে। সেখানেই ধরা পড়ে বছর পাঁচের শিশু প্রতাপের আদতে জন্ম থেকেই দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা। যা তার বাবা-মা কখনও জানতে পারেননি। বীরভূম জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের সৌজন্যে অস্ত্রোপচারের পরে সেই প্রতাপই এখন পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা পড়তে পারছে, দিদিমণির প্রশ্নে হাতের আঙুলের সংখ্যাও ঠিক করে বলে দিতে পারছে। সহপাঠী জিত, বাপিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা, খেলাধুলো সব কিছুই সমান তালে করছে প্রতাপ।

পেশায় দিনমজুর প্রভাত দাস সাঁইথিয়ার হাতোড়া গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা। ছোট্ট প্রতাপ তাঁরই ছেলে। কিন্তু ছেলের পাঁচ বছর বয়স অবধি তিনি বুঝতে পারেননি সে দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে। স্ত্রী টুকটুকি দাস বলছেন, “ছেলেকে কোলে নিয়ে চাঁদ দেখানোর চেষ্টা করতাম। বিমানও দেখাতাম। অনেক পরে বুঝেছি, ও সেগুলোর কোনওটাই দেখতে পেত না।” অনেক সময়ই প্রতাপের হাত থেকে মেঝেতে কোনও জিনিস পড়ে গেলে তা খুঁজে পেত না। প্রভাতবাবুর কথায়, “আমরা ভাবতাম ছেলে বদমায়েশি করছে। তাই অনেক সময় বকাঝকিও করেছি।” সমস্যার কথা প্রথম ধরা পড়ে তাকে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি করার পরে।

২০১২-’১৩ শিক্ষাবর্ষে প্রতাপ ওই কেন্দ্রের প্রাক প্রাথমিকে পড়তে আসে। ওই কেন্দ্রের মুখ্য সহায়িকা পার্বতী ঘোষ (সরকার) বলেন, “শিশুটিকে যখন বর্ণপরিচয় পড়াতাম, তখন ও বইয়ের দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পড়া বলতো। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতো, চোখে ঝাপসা দেখছি। পরে বুঝতে পারলাম ও শুনলে বুঝতে পারে। কিন্তু বোর্ডের লেখা পড়তে পারে না।” এর পরে শিশুশিক্ষা কেন্দ্র থেকেই প্রতাপের বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করে ছেলের চোখের চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার জন্য ওই পরিবারের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। পরে জেলা সর্বশিক্ষা মিশন থেকে আয়োজিত স্বাস্থ্য শিবিরে প্রতাপের চোখের অসুখ ধরা পড়ে। সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা প্রকল্প আধিকারিক অনিন্দ্য মণ্ডল জানান, দৃষ্টিহীনতা কাটাতে ওই শিশুটির দু’টি চোখেই অস্ত্রোপচার করা দরকার ছিল। সর্বশিক্ষা মিশনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পড়ুয়াদের সমন্বিত শিক্ষা’ প্রকল্পের অন্তর্গত ‘কারেক্টিভ সার্জারি স্কিম’-এ তা করা যেত। তিনি বলেন, “প্রথমেই এ নিয়ে মিশনের কলকাতা অফিসের সঙ্গে কথা বলি। যোগাযোগ করি মিশন অনুমোদিত ‘ন্যাশন্যাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ব্লাইন্ড’-এর সঙ্গে। ওই সংস্থাই সরকারি হেলথ্ স্কিমের মাধ্যমে শঙ্কর নেত্রালয়ে অস্ত্রোপচার করিয়ে প্রতাপের দৃষ্টি ফেরায়।”

বস্তুত, শুধু প্রথম শ্রেণির ছাত্র প্রতাপই নয়। জেলায় আরও কয়েকটি শিশু পড়ুয়ার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছে জেলা সর্বশিক্ষা মিশন। প্রতাপের মতো আরও দু’টি নাম হল বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের মালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কুহেলী দাস এবং বোলপুরের শ্রীনন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়া বিশ্বজিৎ মণ্ডল। জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের আধিকারিক শুকদেব চক্রবর্তী জানান, ২০১১-’১২ শিক্ষাবর্ষেই বিনা খরচে ওই দুই পড়ুয়ার চোখে অস্ত্রোপচার করিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফেরানো হয়েছে। কুহেলী এখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। বিশ্বজিৎ পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। কুহেলির স্কুলের প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ পাইন এবং বিশ্বজিতের স্কুলের শিক্ষক মিতা ঘোষ বলছেন, “দু’জনেই আগে চোখে কম দেখত। ফলে পড়াশোনা থেকে খেলাধুলো কোনটাই ঠিক ভাবে করতে পারত না।” কুহেলির বাবা বুদ্ধদেব দাস জানান, তাঁদের মেয়ে ছোট থেকেই হাত পেতে পেতে চলাফেরা করত। সামনে কী রয়েছে, তার কিছুই সে দেখতে পেত না। বুদ্ধদেববাবু বলেন, “মেয়ের যখন তিন বছর বয়স তখন চোখের ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মেয়ের চোখে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। চিকিৎসার জন্য তিনি মেয়েকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন।” বুদ্ধদেববাবুদের সেই সামর্থ্য ছিল না। পরে সর্বশিক্ষা মিশন পাশে দাঁড়ানোয় তাঁর মেয়ে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।

শুকদেববাবুর দাবি, ‘দু’বছর আগে রাজ্যে প্রথম বীরভূম জেলা সর্বশিক্ষা মিশনই পড়ুয়াদের ওই প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। এখন রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলাতেও ওই প্রকল্পে চোখে সমস্যা থাকা পড়ুয়ারা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে।” তিনি জানান, এই মুহূর্তে জেলার ৩২টি সার্কেলেই এমন বিশেষ পড়ুয়াদের জন্য প্রতি বছর ক্যাম্পের মাধ্যমে তাদের নিরীক্ষণের কাজ চলছে। ওই ক্যাম্প থেকে যদি কোনও পড়ুয়ার শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে কোনও অসুবিধা দেখতে পাওয়া গেলে এ ভাবেই সর্বশিক্ষা মিশন তাদের চিকিৎসার ভার নিচ্ছে।

sarbasikhsa mission blind students
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy