নিজের কারখানায় কর্মীদের সঙ্গে অমিতাভবাবু। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
১৪ বছর ধরে পেটের নীচ থেকে গোটা শরীর অকেজো তাঁর। কোনও রকমে বসতে পারেন, ধীরে-ধীরে নাড়তে পারেন দু’টো হাত। তবু প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমাতে পারেনি। হুইলচেয়ার থামাতে পারেনি জীবনের গতি। ৮৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী অমিতাভ মিত্র নিজের কারখানা চালাচ্ছেন। আর সেই কারখানার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকও প্রতিবন্ধী। সেই কর্মীদের নিয়েই তাঁর কারখানা লক্ষ-লক্ষ টাকার কাচ তৈরি করে সরবরাহ করছে।
বছরে অন্তত দুই থেকে তিন বার ভেলোরের ‘ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজ’-এ (সিএমসি) গিয়ে দুর্ঘটনায় পঙ্গু রোগীদের কাউন্সেলিং করেন বছর সাতচল্লিশের অমিতাভ। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে গেঁথে দিতে চান কখনও হার না মানা-র জেদ।
কাঁচরাপাড়া পৌরবাজারে অমিতাভবাবুর কাচের কারখানা। রয়েছেন ১৩ জন কর্মী। তার মধ্যে ৬ জন প্রতিবন্ধী। গৌতম দাসের একটা হাত নেই, সীমা দাসের বাঁ হাত অকেজো, লালবাবু যাদব মূক-বধির, গোপাল দাস হাঁটতে পারেন না, কানাই সরকারের ডান হাত অকেজো, বাদল সরকারের একটি পা নেই। তাঁদেরই তৈরি কাচ যায় দক্ষিণ-পূর্ব রেল, পূর্ব রেল এবং জামালপুর ডিভিশনের অধিকাংশ ট্রেনের জন্য।
ঠিক বেলা এগারোটায় কারখানায় চলে আসেন অমিতাভবাবু। হুইলচেয়ার থেকে পিঠে করে উঠিয়ে একটা বিশেষ ধরনের চেয়ারে বসানো হয় তাঁকে, যাতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলেও মেরুদণ্ডে বেশি চাপ না লাগে। কারণ, চাপ লাগলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ওই চেয়ারে বসেই গোটা কারখানার কাজের তদারকি করেন, ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, হিসেবপত্র দেখেন।
রাজ্য প্রতিবন্ধী কমিশনে কোনও প্রতিবন্ধী জীবিকার জন্য সাহায্য চাইতে এলেই তাঁকে অমিতাভবাবুর উদাহরণ দেন কর্তারা। সৃজনশীলতার জন্য ২০১০-এ কেন্দ্রের পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। প্রতিবন্ধী কমিশনার মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অধিকাংশ প্রতিবন্ধীর মধ্যে নিজে থেকে কিছু করার ইচ্ছা মরে যায়। তাঁরা আত্মবিশ্বাস পান না। সরকারি ভাতার উপরে নির্ভর করে বাঁচতে চান। তাঁদের অমিতাভবাবুর উদাহরণ দিই। তাঁর কারখানায় কাজ দেখতে পাঠাই।”
মিতাদেবীর কথায়, “এমন একজন মানুষ শুধু কারখানাই চালাচ্ছেন না, এতগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের কাজের ব্যবস্থা করছেন, অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। এই রকম আরও কয়েক জনকে পেলেই প্রতিবন্ধীদের দুনিয়াটা বদলে যাবে। যেমন দুনিয়া বদলেছে কাঁচরাপাড়ার কারখানার কর্মী লালবাবু বা গোপাল দাসদের।” অমিতাভবাবুর কারখানার ওই প্রতিবন্ধী কর্মীরা বলেন, “চোখের সামনে এক জনকে দেখছি, যাঁর প্রায় গোটা শরীর পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পরেও দিনে ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করেন । তা হলে আমরা কেন পারব না?”
১৪ বছর আগে ছোট কাচের দোকান ছিল অমিতাভবাবুর। তখন অল্প দিন হল বিয়ে করেছেন। ছেলের বয়স তিন। এক বর্ষার দুপুরে ট্রাক থেকে কুলিদের সঙ্গে কাচের পেটি নামাচ্ছিলেন। আচমকা হাত পিছলে বিশাল ভারী পেটি পড়ল মাথা আর ঘাড়ের উপরে। মুহূর্তে গলার নীচ থেকে শরীর অসাড় হয়ে গেল। তার পরে দেড় বছর ভেলোর সিএমসি-তে ভর্তি ছিলেন তিনি।
তিনি যে ফের উঠে বসতে পারবেন, হাত নাড়তে পারবেন, তা ভেলোরের রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞেরাও ভাবেননি। কিন্তু অমিতাভবাবুই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন স্রেফ মনের জোরে। তাই এখনও ভেলোরে প্রতি বছর একাধিক বার দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়া মানুষের সামনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে যেতে হয় তাঁকে। সিএমসি-র ফিজিক্যাল রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চিকিৎসক জর্জ থেরিয়ানের কথায়, “চিকিৎসার বাইরেও আত্মশক্তি বলে একটা বস্তু থাকে। যার জোরে অমিতাভ শারীরিক ভাবে কিছুটা সচল হতে পেরেছেন। এটা অন্যদের মধ্যে আনতেই তাঁর সাহায্য নেওয়া হয়। পঙ্গু হয়ে পড়া মানুষগুলো মুগ্ধ হয়ে ওঁর কথা শোনেন।”
আর অমিতাভ নিজে কী বলেন? ঝকঝকে চোখে সোজাসুজি তাকিয়ে উত্তর দেন, “কী হয়েছে তার জন্য আফশোস না করে, কী করতে হবে সেটা ভাবা জরুরি। আমরাও পারি- এটা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করলে সব পারা যায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy