Advertisement
১১ মে ২০২৪

পাল্টে যাচ্ছে চেনা লক্ষণ, উপেক্ষা নয় সর্দিকাশিকেও

প্রথম চার দিনের পরীক্ষায় রক্তে শ্বেত কণিকার সংখ্যা ১০ হাজারের নীচে না নামলে ডেঙ্গি হয়নি— ৫০ বছরের অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর আত্মীয়দের এত দিন সেটাই জানাতেন।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৯
Share: Save:

প্রথম চার দিনের পরীক্ষায় রক্তে শ্বেত কণিকার সংখ্যা ১০ হাজারের নীচে না নামলে ডেঙ্গি হয়নি— ৫০ বছরের অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর আত্মীয়দের এত দিন সেটাই জানাতেন। ১৪ বছরের একটি ছেলে তাঁর এত বছরের অভিজ্ঞতার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। ১৭ হাজার শ্বেত কণিকা থাকা ছেলেটির অন্য চিকিৎসা যখন তিনি প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন, ধরা পড়ল কিশোরটির ডেঙ্গি হয়েছে।

মেয়েটির ঘন ঘন সর্দি-কাশি হয়। টনসিলাইটিসের চিকিৎসা করলে সেরেও যায়। এ বারেও সর্দি-কাশি দেখে টনসিলাইটিসের ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। তার পর কী মনে হতে তাঁর এক বন্ধুকে ফোন করলেন। ওষুধের নামগুলি কেটে ডেঙ্গির জন্য রক্ত পরীক্ষা করাতে পাঠালেন। দেখা গেল মেয়েটির ডেঙ্গি হয়েছে। ভাগ্যিস শেষ মুহূর্তে বন্ধুর পরামর্শ চেয়েছিলেন ওই চিকিৎসক!

খেলতে গিয়ে বছর ১৮-র ছেলেটি পায়ে চোট পেয়েছিল। সঙ্গে ঘুসঘুসে জ্বর। ব্যথা কমানোর ওষুধ চলল। সঙ্গে প্যারাসিটামল। জ্বর সারলেও ব্যথা কমল না। পা ছেড়ে ব্যথা ছড়াল গোটা দেহে। কী মনে করে গৃহ চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা করাতে দিলেন। দেখা গেল প্লেটলেট নেমেছে ৭০ হাজারে। শ্বেত কণিকা পৌঁছেছে ৮ হাজারে। ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষায় পজিটিভ।

এই সব অভিজ্ঞতা থেকে পরজীবী বিশেষজ্ঞদের দাওয়াই, বছরের এ সময়টায় জ্বর, সর্দিকাশি, গায়ে হাত পায়ে ব্যথা হলে কোনও ভাবেই তা অবজ্ঞা করা চলবে না। পাঁচটি সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত এক পরজীবী বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, জ্বর, সর্দি-কাশি, গা-হাত-পা ব্যথা, গলা ব্যথা থাকলে পাঁচটি সম্ভাবনার কথা ভেবে নিতে হবে। তালিকার প্রথমেই থাকবে ডেঙ্গি। তার পরে আসবে ম্যালেরিয়া, ভাইরাস সংক্রমণ, ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ।

রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ দু’টোই ধরা পড়ে। পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, জ্বরের প্রথম দিন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির জন্য এনএস-ওয়ান পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে। প্রথম দিন ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গির এনএস-ওয়ান পরীক্ষার ফল নেগেটিভ (জীবাণু না মিললে) হলে দ্বিতীয় দিন ফের ওই দু’টি পরীক্ষা করাতে বলছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। দ্বিতীয় দিনে ম্যালেরিয়া পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল আসার পরে বোঝা যায় ম্যালেরিয়া হয়নি। তবে ডেঙ্গি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্তত সপ্তম দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানাচ্ছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘সাধারণত এনএস-ওয়ান পরীক্ষায় ডেঙ্গি পজিটিভ হলেই আমরা রোগীর উপরে নজরদারি শুরু করি। কারণ, নতুন করে শরীরে ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকলেই তার অ্যান্টিজেনটি এসএম-ওয়ান পরীক্ষায় ধরা পড়ে। ডেঙ্গি জীবাণু রক্তে ঢুকে অ্যান্টিবডি তৈরি করার জন্য অন্তত সাত দিন সময় দরকার। তাই সাত দিনের আগে আইজিজি/আইজিএম পরীক্ষা করালে তার ফল মিলবে না।’’

এনএস-ওয়ান পরীক্ষায় পজিটিভ ফল হলে তাকে ডেঙ্গি বলতে রাজি নয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। সে ক্ষেত্রে আইজিজি/আইজিএম পরীক্ষার জন্য সাত দিন বসে থাকা কি যুক্তিযুক্ত?

পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা জটিলতা এড়ানোর জন্য জ্বর ধরা পড়ার পর দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত নিয়মিত রক্তের প্লেটলেট, শ্বেত কণিকা এবং প্যাক্ট সেল ভলিউম (রক্তে লোহিত কণিকার শতাংশের হিসেব) মাপার পরামর্শ দিয়েছেন। যদি ডেঙ্গির জীবাণু রক্তে থাকে তবে তৃতীয় দিনের পর থেকে প্লেটলেট এবং শ্বেত কণিকা নামতে থাকবে। প্যাক্ট সেল ভলিউমও কমবে। ডেঙ্গির বদলে অন্য ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া ঢুকলেও রক্তের ওই উপাদানগুলি কমে। তবে ডেঙ্গির ক্ষেত্রে হ্রাসের হার অনেক বেশি।

চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, চোখে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, ঘন ঘন বমি- এই সব উপসর্গেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডেঙ্গি ধরা পড়েছে। অমিতাভবাবুর অভিজ্ঞতা, ডেঙ্গি যদি কারও হয় তা হলে প্যারাসিটামলে জ্বর সারবে না। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ বমির ওষুধ কাজ করবে না। রোগীকে ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বমির ওষুধ দিতে হয়। জ্বরের সঙ্গে বমি, পেটের অসুখ থাকলে লিভার ফাংশন টেস্ট করাতে হবে। তাতে লিভারের এনজাইমগুলির কী অবস্থা, তা জানা যাবে। অমিতাভবাবু বলেন, ‘‘এত দিন আমরা শ্বেত কণিকার সংখ্যা ১০ হাজারের উপরে হলে চোখ বুজে বলে দিতাম ডেঙ্গি হয়নি। কিন্তু একটি অল্পবয়সী ছেলে আমার সেই ধারণা বদলে দিয়েছে। ওই ছেলেটির ডেঙ্গি হয়নি ধরে নিয়ে আমি অন্য ওষুধ দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি আইজিজি পজিটিভ। কী যে সব হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’’

ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ছাড়া অন্য সংক্রমণে জীবনহানির তেমন আশঙ্কা নেই বলে জানাচ্ছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরা বলছেন, মূত্রনালীর সংক্রমণে নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। অজানা ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। তবে ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গিতে জীবনহানির আশঙ্কা থাকায় ওই দু’টি রোগ নিয়েই বেশি চিন্তিত চিকিৎসকেরা। তাঁদের পরামর্শ, ডেঙ্গি ধরা পড়লে জ্বর হওয়ার পরে টানা ১০ দিন নিয়মিত ভাবে প্লেটলেট, শ্বেতকণিকা এবং প্যাক্ট সেল ভলিউম মাপাটা বাধ্যতামূলক। তাতে সংক্রমণ কতটা কমছে তার আঁচ পাওয়া যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE