Advertisement
০৪ মে ২০২৪

বাড়তি পরিচ্ছন্নতায় উল্টে বিপদ, বাড়ছে অন্ত্রের অসুখ

চিকিৎসকেরা একে বলছেন ‘পরিচ্ছন্নতার বিভ্রাট’ কিম্বা উলটপুরাণ! কারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত, অন্ত্রের এই রোগ নাকি ছোটবেলা থেকে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকলে, বিশেষত পরিষ্কার শৌচাগার ব্যবহারে হয়!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০২
Share: Save:

চিকিৎসকেরা একে বলছেন ‘পরিচ্ছন্নতার বিভ্রাট’ কিম্বা উলটপুরাণ! কারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত, অন্ত্রের এই রোগ নাকি ছোটবেলা থেকে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকলে, বিশেষত পরিষ্কার শৌচাগার ব্যবহারে হয়!

রোগের নাম ‘ক্রোনস’। পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এই রোগের সম্পর্ক কী? চিকিৎসকদের ব্যাখ্যায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে অনেকের দেহে অন্ত্রের কোষগুলির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে কোষ নষ্ট করতে থাকে। শুরু হয় অন্ত্রের সমস্যা। পাঁচ-ছ’বছর আগে পর্যন্ত বলা হত ক্রোনস হল মূলত আমেরিকা-ইউরোপের মতো উন্নত এলাকার রোগ। কিন্তু এই ধারণা দ্রুত বদলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলকাতার চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চল থেকে গত তিন-চার বছরে এই আপাত অপরিচিত ক্রোনস রোগে আক্রান্ত বহু রোগী পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টরা।

পিজির গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট গোপালকৃষ্ণ ঢালি-র কথায়, “অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতায় কিছু মানুষের শরীরে এত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায় যে, তাঁদের অন্ত্রে বন্ধু ব্যাকটেরিয়াগুলিও মরে যেতে থাকে। ফলে অন্ত্রের কোষগুলি সংক্রমিত হতে থাকে। একেই ক্রোনস রোগ বলা হয়।”

বত্রিশ বছর বয়সে আচমকা শারীরিক সমস্যা শুরু হয়েছিল হাওড়ার হাঁসখালিপুলের বাসিন্দা শম্পা সাধুখাঁর। টানা ডায়েরিয়া, বমি, মাথা ঘোরা, পিঠে-কোমরে যন্ত্রণা। ওজন কমছিল হু-হু করে। দু’তিন জন ডাক্তারের কাছে ঘোরাই সার হল। রোগের প্রকোপ বেড়ে চলল। শেষ পর্যন্ত গত বছর নভেম্বরে এসএসকেএম হাসপাতালের ‘ইনফ্ল্যামেটারি বাওয়েল ডিজিজ ক্লিনিক’-এ এসে ধরা পড়ল “ক্রোনস’ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন শম্পা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এ রোগ পুরোপুরি কমার নয়। তবে সারাজীবন ঠিকঠাক ওষুধ খেয়ে চললে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়েই মলের সঙ্গে রক্ত পড়া শুরু হয় মছলন্দপুরের শীলা ব্যাপারির। শুরু হয় ডাক্তার দেখানো। কেউ বলেন অর্শ, কেউ আলসার, কেউ কোলাইটিস। ওষুধে কিছু দিন রক্ত বন্ধ হয়, ফের শুরু হয়। দশ-বারো বছর আসল রোগ ধরা পড়েনি। অ্যানিমিয়ায় ধুঁকছিলেন শীলা। কিছু খেতে পারতেন না। বছরখানেক আগে পিজির গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগে পরীক্ষায় জানা যায়, আসলে ‘ক্রোনস’ রোগ হয়েছে তাঁর।

এসএসকেএম হাসপাতালে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের অন্তর্গত ‘‘ইনফ্ল্যামেটারি বাওয়েল ডিজিজ ক্লিনিক’ খোলা হয় ১৯৯৯ সালে। ’৯৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বারো বছরে এখানে ক্রোনস রোগের মোট ১৭৭ জন রোগী পাওয়া গিয়েছিল। বেশির ভাগই কলকাতার। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০১৪-র পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বদলে যাওয়া পরিস্থিতির কথা। শেষের চার বছরে ওই ক্লিনিকে ২৮৪ জন ক্রোনস আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে নতুন ৫১ জন, ২০১২ সালে ৬৩ জন, ২০১৩ সালে ৭৯ জন এবং ২০১৪ সালে ৯১ জন নতুন আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক বছর সংখ্যাটা বেড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ক্নিনিকেও মাসে ২-৪ জন করে ক্রোনস রোগী পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শহরের একাধিক গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, “একে সভ্যতার বিপত্তি বলে ধরা যেতে পারে। পরিচ্ছন্নতা যেমন বেশির ভাগ রোগ দূর করে, তেমনই ক্রোনস-এর মতো সমস্যাও ডেকে আনে। তাই বলে কি মানুষ পরিচ্ছন্নতা ছেড়ে দেবে? তা তো নয়। বরং ভয় না পেয়ে এ ভাবে দেখা উচিত যে, হলে মোকাবিলা করা যাবে।” অভিজিৎবাবু স্বীকার করেন, ব্যাপক হারে নগরায়ণ এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন এর জন্য দায়ী।

ক্রোন্সের রোগীরা প্রধানত পেট ব্যথা, রক্তাল্পতা, মলের সঙ্গে রক্ত, ডায়েরিয়া, ওজন কমা, পায়ু দিয়ে পুঁজ বার হওয়া, দুর্বলতার মতো উপসর্গ নিয়ে আসেন। চিকিৎসকদের মতে, সচেতনতার অভাবে অনেক সময়ে অন্ত্রের যক্ষ্মা বা ডায়েরিয়া, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা ফিশচুলার সঙ্গে অনেকে ক্রোনস-কে গুলিয়ে ফেলেন।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট শুভদীপ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, কলকাতায় এখন এত ক্রোন্সের রোগী মিলছে যে, ডাক্তারদের সচেতন হতে হবেই। এন্ডোস্কোপি, কোলনোস্কোপিতেই এই রোগ বোঝা যায়। দ্রুত ধরতে না পারলে রোগীর জীবনের মান ক্রমশ খারাপ হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay crohn's disease
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE