ধারকর্জের বোঝায় নুয়ে পড়েছে ঘাড়। রাজ্যের এমনই ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা যে, কর্মীদের ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা বকেয়া পড়ে যাচ্ছে কিস্তির পর কিস্তি। এই পরিস্থিতিতে ‘ক্যাশলেস হেল্থ স্কিম’-এর আওতায় সরকারি কর্মীদের পরিষেবা দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল। তাদের আশঙ্কা, ওই প্রকল্পে পরিষেবা দিয়ে সরকারের ঘর থেকে টাকা উসুল করা যাবে তো!
‘ক্যাশলেস হেল্থ স্কিম’ বা নগদ-শূন্য স্বাস্থ্য প্রকল্প মানে চিকিৎসার খরচ হাতে হাতে মেটানোর দায় থেকে অব্যাহতি। সরকারি কর্মীরা প্রকল্পের অধীন যে-কোনও হাসপাতালে গেলে কোনও টাকা না-দিয়েই পরিষেবা পাবেন। সরকার পরে সেই টাকা দিয়ে দেবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে।
কিন্তু এই সরকারি ব্যবস্থায় আদৌ আস্থা রাখতে পারছে না বেসরকারি হাসপাতাল। আসলে যে-সরকার ডিএ দিতে পারে না, তারা কর্মচারীদের চিকিৎসার টাকা সময়মতো মেটাবে, বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এটা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। ফলে অগস্টে সরকারি কর্মীদের জন্য ওই স্বাস্থ্য প্রকল্প চালু হওয়ার পরে পাঁচ মাসে মাত্র তিনটি হাসপাতালে ২৬ জন এই পরিষেবা পেয়েছেন। অথচ সরকারি ‘হেল্থ স্কিম’-এর আওতায় রয়েছে ৯২টি বেসরকারি হাসপাতাল। তার মধ্যে কলকাতার হাসপাতালের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি ৩৫। অর্থ দফতরের হিসেব, ওই ৯২টির মধ্যে এখনও পর্যন্ত কলকাতার মাত্র তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল ক্যাশলেস হেল্থ স্কিমে কিছু রোগী ভর্তি নিচ্ছে। বাকিরা জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কিছু শর্ত না-মানা পর্যন্ত এই প্রকল্প চালু করার কোনও প্রশ্নই নেই।
শর্তের এই রক্ষাকবচের দাবিটা উড়িয়ে দিতে পারছেন না সরকারি কর্তারাও। অর্থ দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, রাজ্য সরকারের আর্থিক দুরবস্থাই হাসপাতালগুলির অনীহার মূল কারণ। টাকা নেই বলে উন্নয়নের কাজ থমকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সরকারের সঙ্গে ক্যাশলেস চিকিৎসা পরিষেবায় যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না হাসপাতালগুলি। এমনই এক নামী হাসপাতাল কর্তার কথায়, “সরকারের যতটুকু টাকা রয়েছে, সেটাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে দানখয়রাত আর মেলা-উৎসবে খরচ করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা ব্যবসা করি। সরকার সময়মতো ক্যাশলেস পরিষেবার টাকা না-দিলে আমাদের তো পথে বসতে হবে!” অন্য এক হাসপাতাল-কর্তা জানান, ক্যাশলেস পরিষেবা দেওয়ার কত দিনের মধ্যে সরকার টাকা মিটিয়ে দেবে, সেটা স্পষ্ট করে জানানো হয়নি। এর জন্য কর্মচারীদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের কাজটুকুও শেষ করেনি সরকার। “এই অবস্থায় ওই প্রকল্পে পরিষেবা দেওয়ার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না,” মন্তব্য হাসপাতাল-কর্তার।
সরকারি কর্মী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জন্য একটি হেল্থ স্কিম বেশ কয়েক বছর আগেই চালু হয়েছিল। রাজ্যের ৯২টি বেসরকারি হাসপাতাল সেই প্রকল্পের আওতায় ছিল। তখনও হাসপাতালগুলিকে রাজি করাতে বছরখানেক লেগেছিল। তবে সেই প্রকল্পটা ‘ক্যাশলেস’ ছিল না। ওই ব্যবস্থায় চিকিৎসার খরচ রোগীকে প্রথমে নিজের পকেট থেকে দিতে হবে। সেই বিল দেখিয়ে কয়েক মাস পরে তিনি সরকারের কাছ থেকে টাকা পেয়ে যাবেন। সেই ‘রিইমবার্সমেন্ট’-এর টাকা পেতেও বছর পেরিয়ে গিয়েছে, এমন অভিযোগ অসংখ্য। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আবার চিকিৎসা-ব্যয়ের কিছুটা সরকার দিয়েছে। তার পরে নানান অজুহাতে বাকি টাকা দেওয়া হয়নি। তা নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে।
এই ক্ষোভের মধ্যেই গত ২৮ অগস্ট অর্থ দফতর থেকে একটি নোটিস (৪৪৭৬-এফ, এমইডি) জারি করে ‘ক্যাশলেস হেলথ স্কিম’-এর কথা জানানো হয়। নোটিসে বলা হয়, কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মীরা ৯২টি বেসরকারি হাসপাতালে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্যাশলেস পরিষেবা পাবেন। অর্থাৎ এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের অধীন সরকারি কর্মীদের নিজেদের পকেট থেকে কোনও টাকা দিতে হবে না। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল চিকিৎসার বিল নির্দিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে দেবে। সেখান থেকে সরকার টাকা মিটিয়ে দেবে হাসপাতালকে। কিন্তু ৯৯% বেসরকারি হাসপাতাল বেঁকে বসে। তারা জানায়, হাতে হাতে টাকা না-পেলে তারা পরিষেবা দেবে না। একের পর এক রোগী ফিরিয়েও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
সরকারি প্রকল্প ক্যাশলেস হেল্থ স্কিমে এমন অনাগ্রহ কেন?
বেঁকে বসা বিভিন্ন হাসপাতালের তরফে রূপালি বসু, সুয়েশ বোয়ার, সুজয়রঞ্জন দেব, শুভাশিস দত্ত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় প্রসাদ, তাপস ঘোষের মতো অনেকেই অনাগ্রহের নানা কারণ দেখিয়েছেন।
• সরকারি কর্মীদের জন্য হেল্থ স্কিমে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার প্যাকেজ এমনিতেই কম রাখা হয়। তার উপরে সেটা ক্যাশলেস হলে যথাযথ মানের পরিষেবা দেওয়া যাবে না। পরিকাঠামোর খরচ চালাতে, বিশেষ করে ডাক্তারদের ফি দিতে সমস্যা হবে। এক হাসপাতাল-কর্তার কথায়, “সরকারের যা আর্থিক অবস্থা, তাতে আমরা কবে টাকা হাতে পাব, বোঝা যাচ্ছে না। পরিষেবা দিয়ে অনির্দিষ্ট কাল টাকা না-পেয়ে বসে থাকার ঝুঁকি আমরা নেব না।”
• ক্যাশলেস স্কিমে যে-জেলার যে-দফতরের কর্মী চিকিৎসা করাবেন, নিয়ম অনুযায়ী তাঁর চিকিৎসার টাকা সেই জেলার সেই দফতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে। এই ঝক্কি বেসরকারি হাসপাতাল পোহাতে যাবে কেন?
অর্থ দফতর নিরুত্তর।
ক্যাশলেস স্কিমের ব্যাপারে বেসরকারি হাসপাতালগুলির লিখিত মতামত সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছিল অর্থ দফতর। সেটাও এখনও পর্যন্ত করে ওঠা যায়নি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী বলেন, “কিছু বলব না।” আর যিনি বিষয়টি দেখছেন, অর্থ দফতরের সেই বিশেষ সচিব সমীরণ পাল স্রেফ বলে দেন, “আমার কিচ্ছু বলার নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy