Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রেফার-ফাঁসে তিন দিন বেঞ্চে পড়ে মুমূর্ষু

অপেক্ষার বেঞ্চে পড়ে তিন ধরে কাতরাচ্ছেন এক মুমূর্ষু তরুণ। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। বমি করছেন। আর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উল্টো দিকে। অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত তরুণটিকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ‘রেফার’ করা সত্ত্বেও।

এনআরএসের সামনে বেহুঁশ তরুণ সবুজ মণ্ডল।  নিজস্ব চিত্র

এনআরএসের সামনে বেহুঁশ তরুণ সবুজ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪১
Share: Save:

অপেক্ষার বেঞ্চে পড়ে তিন ধরে কাতরাচ্ছেন এক মুমূর্ষু তরুণ। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। বমি করছেন। আর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উল্টো দিকে। অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত তরুণটিকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ‘রেফার’ করা সত্ত্বেও।

সরকারি স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর ‘রেফার’ নামক মুশকিল-আসানের সূত্রটি কত পলকা, এই ঘটনায় ফের তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। দুই সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ঠেলাঠেলিতে বহরমপুরের ওই তরুণের অসহায় প্রতীক্ষাই বলে দিচ্ছে, গুরুতর অসুস্থকে রেফারের প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য দফতর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যে-দাবি করে, সেটা স্রেফ ফাঁপা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়।

চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, বছর কুড়ির ওই তরুণকে অবিলম্বে আইসিইউয়ে-এ ভর্তি না-করলে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। অথচ মরণাপন্ন সেই রোগীর চিকিৎসা নিয়েই ঠেলাঠেলি চলছে দুই মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে। তার জেরে ডিসেম্বরের ঠান্ডায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় দু’রাত-তিন দিন নীলরতনের জরুরি বিভাগের উল্টো দিকে বেঞ্চে পড়ে থেকে তরুণটি ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছেন। টানা হেঁচকি ওঠা শুরু হয়েছে। অভিযোগ, তাতে হাসপাতালের ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনকী নীলরতনে ভর্তি হতে না-পারলে ছেলেটিকে কলকাতার আর কোন সরকারি হাসপাতালে কী ভাবে ভর্তি করা যায়, এনআরএস-কর্তৃপক্ষ সেই সহায়তাটুকুও করছেন না।

বহরমপুরের কাছে বদরপুর এলাকার বাসিন্দা সবুজ মণ্ডল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৬ ডিসেম্বর। সাড়ে তিন দিন তাঁকে ভর্তি রাখার পরে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ জানিয়ে দেয়, তারা চিকিৎসা করতে পারবে না। লিখিত ভাবে সবুজকে রেফার করা হয় নীলরতনে। কিন্তু নীলরতনে আনার পরে ‘ইমার্জেন্সি কেস’ হওয়া সত্ত্বেও সবুজকে একাধিক বহির্বিভাগে ঘুরিয়ে শয্যা না-থাকার যুক্তিতে চিকিৎসকেরা তাঁকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করেন বলে অভিযোগ। আর্থিক সঙ্গতিহীন সবুজের পরিবারের পক্ষে বড় বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বহরমপুরে ফিরে গেলেও যে চিকিৎসা মিলবে না, সেটা তাঁরা বুঝে গিয়েছেন। যদি নীলরতন-কর্তৃপক্ষের দয়া হয়, এই আশায় মরণাপন্ন ছেলেকে নিয়ে প্রায় তিন দিন ধরে হাসপাতালের উল্টো দিকের ওই বেঞ্চেই বসে রয়েছেন বাবা-মা।

এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে অনেক। l সবুজকে ভর্তি করেও কেন চিকিৎসা করল না বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ? l এক মেডিক্যাল কলেজ অন্য মেডিক্যাল কলেজে আদৌ রোগী রেফার করবে কেন? তাদের তো একই রকম পরিষেবা থাকার কথা! l যদি রেফার করেও থাকে, তা হলে ‘রেফার নীতি’ মেনে রেফারাল হাসপাতালে শয্যা রয়েছে কি না, সেটা আগে থেকে দেখে নেবে না কেন? l এমন জরুরি রোগীর ক্ষেত্রে শয্যা প্রস্তুত রাখতে বলা হবে না কেন? l হাসপাতাল-চত্বরে পড়ে থেকে যে-রোগী খাবি খাচ্ছেন, কেন তাঁকে তুলে জরুরি বিভাগে ন্যূনতম একটা অবজার্ভেশন ট্রলিতে রেখে কেনই বা চিকিৎসা দেওয়া হবে না?

কেন চিকিৎসা করেননি এবং কেন রেফার করে দিয়েছেন, তার সাফাই দিয়েছেন বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অজয় রায়। তিনি জানান, তাঁদের মেডিক্যাল কলেজ তিন বছর হল চালু হয়েছে। এখনও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, কার্ডিওলজি, নিউরোসার্জারির মতো বিভাগ চালু হয়নি। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ছাড়া এত মারাত্মক প্যাংক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা করা যায় না। “তা ছাড়া আমাদের এন্ডোস্কোপির ব্যবস্থাও নেই। সবুজ মণ্ডলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। এন্ডোস্কোপি করে ওঁকে অবিলম্বে আইসিইউয়ে রাখা দরকার। তাই রেফার করতে বাধ্য হয়েছি,” বললেন অজয়বাবু।

কিন্তু রেফার করার আগে নীলরতনে শয্যা খালি আছে কি না, সেটা দেখে নেওয়া হয়নি কেন?

অজয়বাবু জানান, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের দায়িত্ব নেওয়া উচিত ছিল। হয়তো রোগীর চাপে তিনি সেটা পারেননি। বহরমপুরের চিকিৎসকদের কথায়, মুর্শিদাবাদের কোথাও সরকারি বা বেসরকারি কোনও স্তরেই গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি সংক্রান্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাই কলকাতায় রেফার করাটাই নিয়ম।

নীলরতনে এসে কী অভিজ্ঞতা হয়েছে সবুজ এবং তাঁর আত্মীয়দের?

সবুজের বাবা গিরীন মণ্ডল জানান, ১৯ তারিখ গভীর রাতে তাঁরা এনআরএসে পৌঁছন। ২০ তারিখ সকালে সার্জারির বহির্বিভাগে দেখানোর পরে চিকিৎসক দু’টো ইঞ্জেকশন আর একটা সিরাপ বাইরে থেকে কিনে আনতে বলেন। বাইরে থেকে এক্স রে-ও করাতে বলেন তিনি। সব কিছু করতে দুপুর গড়িয়ে যায়। গিরীনবাবুর অভিযোগ, তার পরে তাঁরা ফের বহির্বিভাগে গেলে চিকিৎসকেরা গেট বন্ধ করতে করতে জানিয়ে দেন, রোগীকে মেডিসিন বহির্বিভাগে দেখাতে হবে। তার আগে ভর্তি হবে না। জরুরি বিভাগ থেকে একটি লোক এসে বেঞ্চে শোয়া সবুজকে শুধু ইঞ্জেকশন দু’টো দিয়ে চলে যান। শনিবারেও সারা রাত ওই বেঞ্চেই কেটে যায়। রবিবার বহির্বিভাগ বন্ধ। এ দিনও ভর্তি সম্ভব নয় বলে জানান নীলরতন-কর্তৃপক্ষ। বেঞ্চে পড়ে থাকা সবুজের হুঁশ নেই। শুধু শোনা যাচ্ছে তাঁর গোঙানি।

বাড়ির লোকজনই বা সবুজকে কলকাতার অন্য কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?

পরিজনেরা জানান, ওই তরুণের যন্ত্রণা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, একটু ছোঁয়াতেই ককিয়ে উঠছেন। এই অবস্থায় তাঁরা কী করে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়াবেন? ঘুরলেও ভর্তি যে নেওয়া হবে, সেই নিশ্চয়তাই বা কোথায়?

এমন মরণাপন্ন রোগীকে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না-ই বা কেন?

নীলরতনের ডেপুটি সুপার পার্থ দে-র পাল্টা প্রশ্ন: বহরমপুর মেডিক্যাল কেন রেফার করল, সেটা তো জানতে চাইছেন না? ওঁদের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট না-থাকুক, মেডিসিনের ডাক্তারেরাও তো চিকিৎসা করতে পারতেন। খালি দায় এড়ানোর চেষ্টা! “আমাদের মেঝে পর্যন্ত রোগী। কোনও আইসিইউ খালি নেই। ইমার্জেন্সির ৩০টি শয্যাও ভর্তি। কোথায় রাখব এই রোগীকে? কী ভাবে চিকিৎসা করব? মরে গেলে তো তখন হাসপাতালকেই ধরবেন। যা অবস্থা, তাতে এখন ভর্তি নেওয়া অসম্ভব,” সাফ বলে দিলেন পার্থবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay sabuj mondal refer nrs
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE