Advertisement
E-Paper

রক্তশূন্য ব্লাড ব্যাঙ্ক, চলছে দালালরাজ

ব্লাড ব্যাঙ্কের পাশেই হাসপাতালের বহির্বিভাগের দেওয়ালে হেলান দিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন পূর্বস্থলীর বেনেপাড়ার সামসুদ্দিন শেখ। তাঁর এক আত্মীয়া আজপিয়া বিবি কয়েকদিন ধরেই প্রসূতি বিভাগে ভর্তি। অথচ হন্যে হয়ে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতাল ঘুরেও রক্ত জোগাড় করতে পারেন নি তিনি। শেষে কাটোয়া শহরের এক আত্মীয়ের সাহায্যে কোনওরকমে তিন বোতল ‘এ নেগেটিভ’ রক্তের ব্যবস্থা করতে পারেন তিনি। পরিস্থিতি একটু সামলে গেলে বলেন, “সহৃদয় ব্যক্তিরা রক্ত না দিলে বিপদে পড়ে যেতাম।”

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩০
দরজার বাইরে ঝুলছে জমা রক্তের তালিকা।— নিজস্ব চিত্র।

দরজার বাইরে ঝুলছে জমা রক্তের তালিকা।— নিজস্ব চিত্র।

ব্লাড ব্যাঙ্কের পাশেই হাসপাতালের বহির্বিভাগের দেওয়ালে হেলান দিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন পূর্বস্থলীর বেনেপাড়ার সামসুদ্দিন শেখ। তাঁর এক আত্মীয়া আজপিয়া বিবি কয়েকদিন ধরেই প্রসূতি বিভাগে ভর্তি। অথচ হন্যে হয়ে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতাল ঘুরেও রক্ত জোগাড় করতে পারেন নি তিনি। শেষে কাটোয়া শহরের এক আত্মীয়ের সাহায্যে কোনওরকমে তিন বোতল ‘এ নেগেটিভ’ রক্তের ব্যবস্থা করতে পারেন তিনি। পরিস্থিতি একটু সামলে গেলে বলেন, “সহৃদয় ব্যক্তিরা রক্ত না দিলে বিপদে পড়ে যেতাম।”

বেশ কিছুদিন ধরে এ ভাবেই এক ইউনিট রক্তের জন্য কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে মাথা খুঁড়ছেন অসংখ্য মানুষ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে ভিড় করে রয়েছেন তাঁরা। অথচ ডোনার কার্ড দেখিয়ে রক্ত নেওয়া, বিনামূল্যে রক্ত মিলে যাওয়া এবং শীতের জাঁতাকলে ব্লাড ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গিয়েছে। আবার কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক রক্তাল্পতায় ভুগতে শুরু করা মাত্র শুরু হয়ে গিয়েছে দালাল-রাজ। রোগীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রক্তদান করছেন অনেকেই।

এই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের উপরে নির্ভর করে রয়েছে কাটোয়া মহকুমা, পূর্বস্থলী থানা ছাড়াও পাশের নদিয়া জেলার কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া থানা, মুর্শিদাবাদের সালার, ভরতপুর, বড়ঞা থানা, বীরভূমের নানুর ও লাভপুর থানার একাংশের মানুষ। প্রতিদিন গড়ে এই ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ১৭ থেকে ২০ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। এই মাসে শেষ বার রক্তদান শিবির হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর। সেই শিবির থেকে মাত্র ৩২ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ হয়েছে। তার আগের দিনই একটা শিবির হয়েছিল সেখান থেকে ৪০ বোতল রক্ত সংগ্রহ করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৪ ডিসেম্বরের পর বেশ কয়েকটা শিবির পরপর বাতিল করা হয়েছে। তার মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নদিয়ার কালীগঞ্জে ও মুর্শিদাবাদের শিবিরটি বাতিল করছেন। বাকি কয়েকটি আয়োজক সংস্থা বাতিল করেছে। বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায় বলেন, “জেলার বাইরে রক্তদান শিবিরে গিয়ে রক্ত সংগ্রহ করতে পারে না আমাদের জেলার ব্লাড ব্যাঙ্ক। কারণ জেলার বাইরে থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে গেলে স্বাস্থ্য দফতর-সহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে আসতে হয় ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে।”

এ দিকে রক্ত সংগ্রহ না হওয়ায় কয়েক দিন ধরেই ব্লাড ব্যাঙ্কের ফ্রিজগুলি খাঁ খাঁ করছে। একেবারে রক্তশূন্য হওয়ার আগে সপ্তাহখানেক ধরে ভাঁড়ে মা ভবানী বলতে শুধু ‘বি পজিটিভ’ রক্ত পড়েছিল। তাও সেই ২৮ ইউনিট রক্ত দেড় দিনেই ফুরিয়ে যায়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, রক্ত না থাকায় বেশ কয়েকজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। সুদীপ্ত হাজরা নামে একজন আক্রান্তকে তো রাতেই স্থানান্তরিত করতে হয়। হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, “গড়ে প্রতি মাসে ১২টি করে রক্তদান শিবির হয়। সেই সব শিবিরে রক্তদাতার সংখ্যাও বেশি থাকে। কিন্তু শীতকালে রক্তদান শিবিরের সংখ্যা কমে এসেছে। তার উপর ভিন জেলায় গিয়ে রক্ত সংগ্রহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে।”

কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের সুপার বর্ণমান টুডু বলেন, “এখন আর ডোনার কার্ড দেখিয়ে রক্ত নেওয়া কিংবা রক্তদান করে রক্ত সংগ্রহের পদ্ধতি বাতিল হয়ে গিয়েছে। এখন হাসপাতালে ভর্তি থাকলেই বিনামূল্যে রক্ত মিলবে। এর ফলে রক্তের যোগান কমেছে। আবার শীতকালে রক্তদান শিবিরের সংখ্যাও কমে গিয়েছে। এই দুই কারণেই কাটোয়া মহকুমার মতো বড় একটা হাসপাতালের রক্তের ভাঁড়ারে টান পড়েছে।” তাঁর দাবি, “আমরা সমস্ত রকম সংগঠনের কাছে রক্তদান শিবির করার আবেদন জানিয়েছি।”

এ দিকে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের হাহাকার দেখা দিতেই দালালদের দেখা মিলতে শুরু করেছে বলে রোগীর পরিজনদের দাবি। ভুক্তভোগীরা জানান, মহকুমা হাসপাতালের বাইরে রোগীদের জন্য আগে রক্তের ইউনিট পিছু পাঁচশ টাকা লাগত, এখন সেখানে দিতে হচ্ছে ১০৫০ টাকা। সরকারি মূল্যের চেয়ে অনেক কম টাকায় রোগীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অনেক কম টাকায় রক্তদান করে যাচ্ছেন দালালেরা। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও আইসোলেশন ওয়ার্ডের মাঝে একটি গাছতলায় এমনই কয়েকজন বসেছিলেন। তাঁরাই বললেন, “রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচিয়ে গরিব মানুষের কাছ থেকে অনেক কম টাকা নিচ্ছিয় আমরা। রক্ত না দিলে রোগীরা তো মারা যাবে।” এই সব দালালরা অন্য সময়ে হাসপাতালের বাইরের রোগীদের জন্য রক্ত বিক্রি করেন বলেও অভিযোগ।

সুপার বলেন, “রোগীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কেউ মরণাপন্নকে রক্ত দিতে এগিয়ে এলে কী করব? আমরা দালালদের উত্‌পাত বন্ধ করার জন্য সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি।”

soumen dutta katoa katoa district hospital blood bank
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy