Advertisement
০১ মে ২০২৪

হুঁশিয়ারিই সার, জেনেরিক নাম প্রেসক্রিপশনে ব্রাত্যই

বুঝিয়ে, শাস্তি দিয়ে, হুঁশিয়ারি দিয়ে, নির্দেশিকা জারি করে— কোনও উপায়েই সরকারি চিকিত্‌সকদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের ‘ব্র্যান্ড’ নাম লেখার অভ্যেস বন্ধ করতে পারছে না স্বাস্থ্য দফতর। বিশেষত, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিত্‌সকদের উপরে রাশ টানা মুশকিল হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যসচিব। গত কয়েক মাস ধরে কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজের আউটডোর টিকিট, ইন্ডোর স্লিপ, পে-ক্লিনিকের প্রেসক্রিপশন, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের ইন্ডেন্ট স্লিপ সংগ্রহ করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের ফার্মাকো ভিজিল্যান্স কমিটির সদস্যেরা।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩২
Share: Save:

বুঝিয়ে, শাস্তি দিয়ে, হুঁশিয়ারি দিয়ে, নির্দেশিকা জারি করে— কোনও উপায়েই সরকারি চিকিত্‌সকদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের ‘ব্র্যান্ড’ নাম লেখার অভ্যেস বন্ধ করতে পারছে না স্বাস্থ্য দফতর। বিশেষত, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিত্‌সকদের উপরে রাশ টানা মুশকিল হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যসচিব। গত কয়েক মাস ধরে কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজের আউটডোর টিকিট, ইন্ডোর স্লিপ, পে-ক্লিনিকের প্রেসক্রিপশন, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের ইন্ডেন্ট স্লিপ সংগ্রহ করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের ফার্মাকো ভিজিল্যান্স কমিটির সদস্যেরা। তাতে দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে কলকাতার অন্তত ৭০ শতাংশ সরকারি চিকিত্‌সক নির্দ্বিধায় ওষুধের ব্র্যান্ড নাম লিখছেন।

পরীক্ষামূলক ভাবে গত ৩ ডিসেম্বর এসএসকেএম হাসপাতাল ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেশ কিছু আউটডোর টিকিট, ইন্ডোর স্লিপ ও ওষুধের দোকানের স্লিপ সংগ্রহ করে স্বাস্থ্যভবনে জমা দিয়েছিলেন ফামার্কো ভিজিল্যান্সের কর্তারা। মাত্র এক দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টায় দুই মেডিক্যাল কলেজ থেকে ওষুধের ব্র্যান্ড লেখা অন্তত ১৮টি আউটডোর-ইন্ডোর টিকিট ও ড্রাগ ইন্ডেন্ট স্লিপ পাওয়া গিয়েছে। তা হলে গোটা মাসের হিসেবটা কী দাঁড়ায়, তা আন্দাজ করে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্যকর্তারা।

৩ ডিসেম্বর সংগ্রহ করা ওই টিকিটগুলির মধ্যে এসএসকেএমের কার্ডিওভাস্কুলার বিভাগের এক রোগী তপন বসুর আউটডোর টিকিটে যেমন দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ ওষুধের ব্র্যান্ড নাম লেখা। একই ভাবে মেডিক্যালে শ্যামাপ্রসাদ পালচৌধুরী নামে এক রোগীর আউটডোর টিকিট (এফ নম্বর৮২৯z, ৫০), এসএসকেএমের অর্থোপেডিক বিভাগে মমতা দেও নামে এক রোগীর আউটডোর টিকিট, এসএসকেএমে-ই সার্জারি আউটডোরে সুশান্ত সাহা নামে এক রোগীর টিকিটে, মেডিক্যাল কলেজের ‘আফটারনুন পে ক্লিনিক’-এ জেনারেল মেডিসিন বিভাগে অসীম ধন নামে এক রোগীর টিকিটে, এসএসকেএমের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে সুমন শেখ নামে এক রোগীর ডিসচার্জ নথিতে, মেডিক্যাল কলেজের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে ওই হাসপাতালের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের কেনা ওষুধের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওষুধের ব্র্যান্ড নাম লেখা। এ রকম উদাহরণ আরও অসংখ্য রয়েছে।

স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র কথায়, “ওষুধের ব্র্যান্ড লেখা নিয়ে সরকারি চিকিত্‌সকেরা অনেকেই চোর-পুলিশের খেলা খেলছেন। হাসপাতালের ফার্মাকো-ভিজিল্যান্স দলের নজরদারিতেও বিস্তর ফাঁক রয়েছে। নিয়ম করে ওই দলের সদস্যেরা আউটডোরে বা ইন্ডোরে আচমকা ঘুরে টিকিট পরীক্ষা করছেন না। প্রত্যেক মাসে স্বাস্থ্যভবনে রিপোর্টও দিচ্ছেন না।” পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, “বেশির ভাগ হাসপাতালে এখনও ই-প্রেসক্রিপশন চালু হয়নি। ফলে ডাক্তারবাবুদের ধরা পড়ার ভয় কম।”

স্বাস্থ্যভবনে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলির প্রেসক্রিপশন-অডিটের মাধ্যমে পাওয়া রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, এসএসকেএমে ৪০ শতাংশ, আর জি কর হাসপাতালে ৬৫ শতাংশ, নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে ৭০-৭৫ শতাংশ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮০ শতাংশ ব্র্যান্ডেড ওষুধ লেখা হচ্ছে। কলকাতার চারটি মেডিক্যাল কলেজে যে সংস্থা ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চালায়, তাঁদের উপদেষ্টা অম্বরীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “বহু ক্ষেত্রে রোগীর বাড়ির লোক আমাদের দোকান থেকে ব্র্যান্ডেডের বদলে জেনেরিক ওষুধ কিনে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবুরা সেগুলো ফিরিয়ে দেন এবং ওষুধে কাজ হবে না বলে ভয়ও দেখান।”

এর পিছনে কি শুধু ওষুধ সংস্থার থেকে পাওয়া ‘কমিশন’ই দায়ী, নাকি অন্য কারণও আছে?

এসএসকেএমের এক স্ত্রীরোগ চিকিত্‌সকের দাবি, “ন্যায্য মূল্যের দোকানে বেশির ভাগ জেনেরিক ওষুধ খারাপ মানের। স্বাস্থ্য দফতর সব জেনে চুপ করে আছে। তাই রোগীদের বাঁচাতে আমরা ব্র্যান্ডেড ওষুধ লিখছি।” নীলরতনের স্নায়ু বিভাগের এক চিকিত্‌সক বলেন, “আউটডোরের প্রচণ্ড ভিড়ে রোগী দেখতে গিয়ে সব সময়ে অত বড়-বড় খটমট জেনেরিক নাম লেখা সম্ভব হয় না। কিছু ব্র্যান্ডের প্রতি আমাদের দীর্ঘদিনের নির্ভরতা বা বিশ্বাস থাকে। তা চট করে কাটানো যায় না।” মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের এক চিকিত্‌সকের মন্তব্য, “রাতের দিকে হাসপাতালে ইন্টার্ন, পিজিটি আর নার্সরা ডিউটিতে থাকেন। তাঁরা বেশির ভাগই জেনেরিক নামের সঙ্গে সড়গড় নন। ফলে ওষুধের ব্র্যান্ড না লিখলে সমস্যা হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay generic name drugs medicine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE