বয়স একটা সংখ্যামাত্র— এই মতবাদেরই এখন জয়জয়কার। বেশির ভাগ মানুষই চান জন্মদিনের কেকে মোমবাতি যতই বাড়ুক, ত্বক ও চুলের ঔজ্জ্বল্যে যেন সেই সংখ্যা ও সময়ের ছাপ না পড়ে। তার জন্য অ্যান্টি-এজিং প্রসাধনী, চিকিৎসারও রমরমা। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম বয়সে যদি দেহে বার্ধক্যের চিহ্নগুলি ফুটে ওঠে, তবে দুশ্চিন্তা শুধু বাহ্যিক রূপ নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। অকালেই বার্ধক্যজনিত রোগব্যাধিও ঘিরে ধরে। ব্যথাবেদনা, দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় হয়, ইন্দ্রিয়ক্ষমতা কমে যায়। জীবনের মান হ্রাস পায়, কমতে পারে আয়ুও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু জীবনশৈলী ও দূষণের কারণে অকালবার্ধক্যও হানা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি কী ভাবে এড়াবেন, কিছু পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকরা।
কাকে বলে অকালবার্ধক্য?
জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “বয়সকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। ক্রোনোলজিক্যাল এজ বা কালানুক্রমিক বয়স (জন্মদিন হিসাব করে যত বয়স) এবং বায়োলজিক্যাল এজ বা জৈবিক বয়স (শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা কোষের সক্রিয়তা বিচার করার পদ্ধতি)। হয়তো কারও কালানুক্রমিক বয়স তিরিশ, কিন্তু দেখা গেল তার চুল-দাঁত পড়ে যাচ্ছে,বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে। এর মানে কালানুক্রমিক বয়সের চেয়ে জৈবিক বয়স বেশি। তখনই অকালবার্ধক্যের সমস্যা হবে। উল্টোটাও হয়, বয়স হয়তো ৭০, কিন্তু দেখতে লাগে ৫৫-৬০। জৈবিক বয়সের বৃদ্ধিকে শ্লথ করে বার্ধক্যের চিহ্ন ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। জিনগত কারণে অকালবার্ধক্য না এলে সেটা কিছুটা করাও সম্ভব।”
‘পা’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন প্রোজেরিয়া আক্রান্ত স্কুলছাত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। প্রোজেরিয়াও অকালবার্ধক্যেরই উদাহরণ। প্রোজেরিয়ার লক্ষণ কারও শৈশবেই, কারও কৈশোরে, কারও ৩০-৩৫-এও দেখা দেয়। প্রোজেরিয়া কঠিন রোগ ও জিনগত। তবে এটি অতিবিরল অসুখ।
—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
জৈবিক বয়স থামানো যায়?
কোষের মধ্যের ক্রোমোজ়োম তৈরি হয় ডিএনএ, আরএনএ দিয়ে। ডিএনএ-র দু’প্রান্তে টেলোমিয়ার নামক প্রোটিন থাকে। সেগুলি ওই প্রান্ত দু’টিকে খানিকটা টুপির মতো রক্ষা করে। যত দিন টেলোমিয়ার অক্ষত অবস্থায় প্রান্ত দু’টিকে রক্ষা করবে, ডিএনএ, ক্রোমোজ়োম-এর কোনও ক্ষতি হবে না, কোষ বুড়িয়ে যাবে না। টেলোমিয়ারকে ঠিক রাখার জন্যই বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে, কারণ সেটাই বয়স ধরে রাখার চাবিকাঠি, অকালবার্ধক্য রোখার একমাত্র রাস্তা। তবে জিনগত কারণে অকালবার্ধক্য এলে তাকে আটকানো মুশকিল। অন্যান্য যে কারণে টেলোমিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখলেই বার্ধক্যকে পিছিয়ে দেওয়া যায়।
টেলোমিয়ারের শত্রু বহুবিধ। যেমন— অনেকক্ষণ অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে থাকলে, ধূমপানের অভ্যাস, অপরিমিত সুরাপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। স্ট্রেস বেশি হলে হরমোনের ক্ষরণ কোষকে বুড়িয়ে দেয়, শরীর কম নড়াচড়া করলেও জরায় ধরে। কম ঘুম, দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তনও ক্ষতির জন্য দায়ী। ডা. তালুকদার বললেন, “যে দেশের আবহাওয়া ও জীবনশৈলীতে এই সব সমস্যা কম, সেই সব দেশে মানুষ বয়স অনুযায়ী তরুণ থাকেন। আবার যে দেশে সমস্যা বেশি, সেখানেই মানুষ তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যান।”
লক্ষণ দেখলে সতর্ক হন
কতগুলি বিষয় খেয়াল রাখুন। যেমন ত্বক জৌলুস হারাচ্ছে কি না, চামড়া ঝুলে যাচ্ছে কি না। এ ছাড়া কমবয়সেই চুল পেকে বা উঠে গেলে, পেশি শিথিল হলে, হাড় ভঙ্গুর হলে, চোখ-কানে অসুবিধা হলে, ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিলে, শ্লথ ভাব বা বোধবুদ্ধিতে কিছুটা ধোঁয়াশা, জড়তা এলে সতর্ক হোন। এ সবই জরার লক্ষণ যা মোটামুটি সত্তর-পঁচাত্তর বছরে দেখা দেওয়ার কথা। সেটাই তিরিশ-চল্লিশে হচ্ছে মানে অকালবার্ধক্যের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তখন চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি কোন কারণে টেলোমিয়ারের ক্ষয় অর্থাৎ অকালবার্ধক্য এসেছে নির্ণয় করে তা আটকানোর পদ্ধতি জানাবেন। এখানে চিকিৎসা বলতে কিন্তু শুধুই প্রতিরোধ। অকালবার্ধক্য থেকে আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব নয়, তবে ঠিক সময়ে সচেতন হলে জরার গতি কম করা সম্ভব।
বয়সের আগে বুড়িয়ে যাওয়ার সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে বয়সজনিত রোগের বহিঃপ্রকাশ দেখা দিচ্ছে অল্প বয়সেই। যেমন হার্টের সমস্যা কোনও যুবক যে ভাবে সামলাতে পারত, তার হৃদযন্ত্রের অবস্থা যদি ষাট বছরের মানুষের মতো হয়, তবে তার যুঝবার শক্তিও কমবে। তার সঙ্গে মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির অসুখ, শ্বাসকষ্ট থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
মনের রং হারাবেন না
অনেকেরই বিশ্বাস, মনের দিক থেকে তরুণ থাকার চেষ্টা করলে শরীরেও যৌবন থাকবে। এ ভাবে স্ট্রেস কমানোর কথাই বলা হচ্ছে। কনসালট্যান্ট ওল্ড এজ সায়কায়াট্রিস্ট দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “শরীর ও মন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই শরীর ঠিক রাখতে মনের যত্ন খুব জরুরি। প্রত্যেকটা কোষের একটা ঘড়ি থাকে, যা কত দিন চলবে তা নির্ভর করে জীবনযাত্রার উপরে। মানসিক অবস্থা সেখানে বড়সড় ভূমিকা নেয়। মনের অবস্থার প্রভাব শরীরের হরমোন, প্রেশার, সুগার সব কিছুর উপরেই পড়ে। তাই স্ট্রেস বাড়ছে কি না বুঝে সামলানোর উপায়ও ভাবতে হবে।”
দায়দায়িত্ব, কর্তব্য সামলেও নিজের অবসর-বিনোদনের দিকে খেয়াল রাখুন। সামাজিক মেলামেশা, ঘুরতে যাওয়া, শখপালন— যা আনন্দ দেয় সেটাই করুন। তা হলে শরীর থেকে স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ কমবে, নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখার তাগিদ জন্মাবে, সব মিলিয়ে অসময়ে বুড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কমবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)