Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Pranab Mukherjee

উনি বললেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত, আমার কপাল’

মনীশ তিওয়ারি, আমাদের সহকর্মী-নেতা আমাকে প্রণবদার বাড়ি নিয়ে গেলেন আর বললেন, আমি প্রণবদার সঙ্গে কাজ করতে চাই।

প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। মঙ্গলবার দিল্লির রাজাজি মার্গে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে। পিটিআই

প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। মঙ্গলবার দিল্লির রাজাজি মার্গে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে। পিটিআই

প্রদ্যোত গুহ (কংগ্রেস নেতা)
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:১৮
Share: Save:

তারিখটা মনে নেই। ইন্দিরা গাঁধী নির্বাচনে পরাজিত। অনেক নামীদামি নেতা দলত্যাগ করেছেন বা নতুন দল শরদ কংগ্রেসে চলে গেছেন। আমরা তখন ছাত্র পরিষদে। আমাদের নেতা কুমুদদা, প্রিয়দা, সুদীপদা, সিদ্ধার্থবাবু, দেবীবাবুরা সবাই দল ছেড়েছেন। সুব্রতদাও মাঝরাস্তায়। হঠাৎ ডাক পড়ল নিজাম প্যালেসে। প্রণববাবু আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

সভায় গেলাম। সেখানে প্রায় ১০০ জনের উপরে উপস্থিত থাকলেও প্রথম সারির নেতা কম। প্রণবদার অকাট্য যুক্তি মুগ্ধ করল আমাদের, ইন্দিরা গাঁধীর জয়ধ্বনি করে নব কংগ্রেসে থেকে গেলাম। শেষ বেলায় থেকে গেলেন সুব্রতদাও।

আশির শুরুতে বরকত সাহেব ও প্রণবদা মন্ত্রী হলেন ইন্দিরা গাঁধীর নতুন মন্ত্রিসভায়। প্রিয়দাকে সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের কাজ করতে দেখে ইচ্ছা ছিল ওখানে কাজ করব। তা-ই হল। এনএসইউআই-এর সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হলাম রাজীব গাঁধীর সহায়তায়, রমেশ চেন্নিথালার অধীনে। ১৯৮৪ সালে রাজীবজি বর্ধমান লোকসভায় লড়তে পাঠালেন। বরকত সাহেব সমর্থন করলেও প্রণবদার সমর্থন পেলাম না। পরাজিত হয়ে ফিরে গেলাম। ’৮৫ সালে যুব কংগ্রেসের সভাপতি হয়ে আমার পশ্চিমবঙ্গে ফেরা। তত দিনে প্রিয়দা, সিদ্ধার্থবাবু, সুদীপদা, কুমুদদারা ফিরে এসেছেন। প্রণবদা দল ছাড়লেন। আবার ফিরেও এলেন। আমার রাজ্য সম্মেলন ছিল নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে। সাহস করে প্রণবদাকে বললাম, ‘‘আপনাকে আসতে হবে এবং বলতে হবে।’’ ওঁকে ডেকেছি বলে খুব খুশি হয়েছিলেন সে দিন। এরপর আবার দিল্লি গেলাম ইন্ডিয়ান ইউথ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হয়ে।

তার পরেই হঠাৎ রাজীবজি চলে গেলেন। আমি অসহায়। কী করি? মনীশ তিওয়ারি, আমাদের সহকর্মী-নেতা আমাকে প্রণবদার বাড়ি নিয়ে গেলেন আর বললেন, আমি প্রণবদার সঙ্গে কাজ করতে চাই। উনি সাদরে আমাকে গ্রহণ করলেন। শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। আমি, রমেশ চেন্নিথালা, মনীশ তিওয়ারি প্রণবদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতে লাগলাম। এমনকি, ওই সময় প্রণবদার নির্দেশে পি ভি নরসিংহ রাওকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য সনিয়াজিকে বলতে গিয়েছিলাম। এটা অনেক বড় রাজনীতি। কিন্তু মন্ত্রিসভায় প্রণবদার ঠাঁই না হওয়ায় প্রণবদাকে খুব বকাবকি করি। উনি শুধু সে দিন আমাকে বলেছিলেন, ‘‘চা খা। মন খারাপ করিস না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।’’ তার তিন দিন বাদে উনি বললেন, ‘‘আমাকে প্ল্যানিং কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হতে বলা হয়েছে। কী করি?’’ আমি অনেক ভেবে দাদাকে বলি, ‘‘নিয়ে নিন। না হলে আমাদের কী হবে?’’ উনি বলেছিলেন, ‘‘ঠিক আছে।’’ তার পরে উনি দায়িত্ব নিলেন। আমাদের জন্য রোজ বিকেলে ৫টা থেকে ৬টা ধার্য করলেন, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে।

আরও পড়ুন: কোভিড-বেড়া মেনেই বিদায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে

তার কয়েক বছর বাদে আমাকে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক করে ফিরতে বললেন উনি। সাধারণ সম্পাদক হয়ে প্রদেশে কাজ করলাম। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এক দিন হঠাৎ দিল্লি থেকে প্রণবদার ফোন, ‘‘আমার ইচ্ছা, নির্বাচন লড়তে চাই জঙ্গিপুর থেকে। যদি সনিয়াজি অনুমতি দেন, তবে লড়ব। তুই কি দায়িত্ব নিবি?’’ আমি বললাম, ‘‘নেব।’’ ক’দিন বাদে আবার ফোন, ‘‘লড়ব, কিন্তু দল আরও অনেক দায়িত্ব দিয়েছে। কী করি?’’ আমি বললাম, ‘‘নমিনেশন ফাইল করুন। আমরা সামলে নেব।’’ উনি ফিরে এলেন। ট্রেনে। রাতে জঙ্গিপুর গেলাম। অনেকে খুশি, অনেকে অখুশি। কিন্তু অধীর চৌধুরীর সমর্থন পেলাম। মন দিয়ে নির্বাচন লড়লাম সকলে। প্রণববাবু প্রথম লোকসভায় নির্বাচিত হলেন। বললেন, ‘‘গ্রাসরুট পেলাম। জঙ্গিপুরকে ভুলব না।’’ প্রণবদার সে দিনের টেনশন এবং আনন্দ ভুলতে পারব না। জয়ের শংসাপত্র আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘চ, দিল্লি যাই, সনিয়াজি প্লেন পাঠিয়েছেন।’’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘অনেকেই তো বলছে, আপনি প্রধানমন্ত্রী হবেন।’’ উনি শুধু হাসলেন আর বললেন, ‘‘ওটা ওরা ঠিক করুক।’’ ততক্ষণে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছি।

দিল্লি গিয়ে প্রণববাবু সনিয়া গাঁধীর বাড়িতে চলে গেলেন। রাতে যখন ফিরলেন, ক্লান্ত মনে হল। পর দিন আবার মিটিং। জানলাম, প্রণববাবুকে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি দেবে। মনটা বিক্ষুব্ধ। দাদা এলে বললাম, ‘‘এটা কী হল দাদা?’’ উনি বললেন, ‘‘চা খেয়েছিস?’’ খেয়েছি শুনে বললেন, ‘‘আর এক কাপ খা।’’ পরিচারক হীরালাল চা নিয়ে এলেন। খুব রেগে গিয়ে বলেছিলাম, ‘‘এটা কী হচ্ছে?’’ উনি বললেন, ‘‘দলের সিদ্ধান্ত, আমার কপাল।’’ কিছু ক্ষণের মধ্যে ঘোষণা হল, শ্রী মনমোহন সিংহ পিএম।

প্রণবদার মধ্যে যে গুণগুলো দেখেছি, তা লিপিবদ্ধ করা সত্যি দুষ্কর। শুধু বলতে পারি, উনি এক জন ভাল মানুষ। ওঁকে অনেকে চিনতে ভুল করেছেন। তবে প্রণবদাকে কখনও কারও নামে অভিযোগ করতে শুনিনি। যা নির্দেশ এসেছে, উনি মাথা পেতে নিয়েছেন। শুধু একটা কথা মাথায় রাখতেন— কী করলে দলের ভাল হবে। স্বপ্ন সবাই দেখে বা দেখায়, কিন্তু সেই স্বপ্নকে এক মুহূর্তে দলের জন্য ত্যাগ করতে পারে, এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।

প্রতি দিন অতি ব্যস্ততার মধ্যেও কর্মী বা সাধারণ মানুষকে ফোন করতেন, কথা বলতেন। ওঁকে আমি শীতের সময়ে নিজের গায়ের শাল গরিব কর্মীর গায়ে জড়িয়ে দিতে দেখেছি। ওঁর বাড়িতে রোজ রাতে কম করে প্রায় ৫০ জন সাধারণ মানুষ নানা সাহায্যের জন্য আসতেন। উনি কখনও কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না। কারও উপর রেগে গিয়ে তাকে ঘর থেকে বার করে দিলেও আমাকে আবার বলতেন, ‘‘ডেকে নিয়ে আয়।’’ হীরালাল কথাটা শুনে বলেছিলেন, ‘‘আরে দাদা, এটা তো আমার প্রতিদিনের কাজ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pranab Mukherjee Death Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE