Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

লকডাউন: ‘ভিক্ষারও উপায় নেই’, অনাহারের আতঙ্ক ঝাড়খণ্ডে

জানুয়ারির শেষ দিকে ভারতে করোনাভাইরাস হানা দিলেও, ঝাড়খণ্ডে তার প্রভাব পড়েছে একটু দেরিতেই।

খাবারের দাবিতে আন্দোলন। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

খাবারের দাবিতে আন্দোলন। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

সংবাদ সংস্থা
রাঁচি শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৩৯
Share: Save:

গত কয়েক দিন ধরে পেটে কিছুই পড়েনি। ভিক্ষা করতে যে বেরোবেন, লকডাউনের জেরে সেই উপায়ও নেই। শেষমেশ না খেতে পেয়েই না মৃত্যু হয়। নোভেল করোনার প্রকোপে গোটা দেশ যখন ঘরবন্দি, সেইসময়ই ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে এই চিন্তাই এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের।

জানুয়ারির শেষ দিকে ভারতে করোনাভাইরাস হানা দিলেও, ঝাড়খণ্ডে তার প্রভাব পড়েছে একটু দেরিতেই। রবিবার সকাল পর্যন্ত সেখানে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ১ জনের।কিন্তু মারণ ভাইরাস নিয়ে যত না আতঙ্কিত স্থানীয় মানুষ, তার চেয়ে না খেতে পেয়ে মারা যাওয়ার ভয়ই চেপে ধরেছে তাঁদের।

গঢ়বা জেলার বাসিন্দা চন্দ্রবতী দেবী একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, সন্তান-সন্ততি মিলিয়ে তাঁর পরিবারে আট জন সদস্য। স্থানীয় ইটভাটায় দিনমজুরের কাজ করে কোনওরকমে সংসার চালাতেন। কিন্তু লকডাউনের জেরে এখন হাতে কাজ নেই। বাড়িতে যা মজুত ছিল শুরুতে, তা-ই দিয়ে ছেলেমেয়েদের পেট ভরিয়েছেন। কিন্তু এখন আর কিছু নেই। গত তিন দিন ধরে পেটে একটি দানাও পড়েনি তাঁদের।

আরও পড়ুন: পর্যাপ্ত পরীক্ষা, কড়া ব্যবস্থা, করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় লাগাম টেনে নজরে কেরল​

পরিবারের তিন জনের রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও সাহায্যই তাঁদের কাছে এসে পৌঁছয়নি বলে জানিয়েছেন চন্দ্রাবতী দেবী। তাঁর কথায়, ‘‘লকডাউনের জেরে সব বন্ধ। ভিক্ষা করতে বেরোব, তারও উপায় নেই। যা ছিল এত দিন তা-ই দিয়েই ছেলেমেয়েগুলোর পেট ভরিয়েছি।’’

এই গঢ়বা জেলারই ভাণ্ডারিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন সোমারিয়া দেবী (৬৫)। নিঃসন্তান তিনি। ৭২ বছরে স্বামীকে নিয়েই ছিল তাঁর সংসার। দরিদ্রসীমার নীচে হলেও সরকারি কোনও প্রকল্পে তাঁদের ঠাঁই হয়নি। পাশের একটি গ্রামে তাঁদের এক ভাইপো থাকেন, এতদিন সপ্তাহে একদিন করে ঢুঁ মেরে যেতেন তিনি। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর আর তা হয়ে ওঠেনি। সেই অবস্থায় লকডাউনের ন’দিনের মাথায় মৃত্যু হয় সোমারিয়া দেবীর।

না খেতে পেয়েই সোমারিয়া দেবীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি তাঁর স্বামী লাচ্চু লোহরার। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে এখন পাড়া প্রতিবেশীরা কিছু সাহায্য করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। স্থানীয় প্রশাসনের তরফে তাঁকে ১০ কেজি দানাশস্য এবং নগদ ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে স্ত্রীকে হারিয়ে এখন ভাইপোর বাড়িতেই গিয়ে উঠেছেন লাচ্চু লোহরা।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে বোকারোর গোমিয়া ব্লকে ১৭ বছরের এক প্রতিবন্ধি কিশোরীর মৃত্যু হয়। না খেতে পেয়েই তাঁদের মেয়ে মারা গিয়েছে বলে দাবি করেন ওই কিশোরীর বাবা-মা। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের চাপে শেষ মেশ ‘ভুল তথ্য’ ছড়ানোর জেরে তাঁদের ক্ষমা চাইতে হয়। বিষয়টি নিয়ে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যসচিব সুখদেব সিংহকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশন।

কিন্তু খেতে না পেয়ে সোমারিয়া দেবীর মৃত্যু হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের তরফে এ কথা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ ঝাড়খণ্ডের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নরেগা ওয়াচ আহ্বায়ক জেমস হেরেঞ্জ। তিনি বলেন, ‘‘প্রশাসনিক আধিকারিক দু’দু’বার এসে ওই পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে না খেতে পেয়ে মৃত্যু হয়নি সোমারিয়া দেবীর। দুর্ভিক্ষের কথায় আমলই দিতে চায় না রাজ্য সরকার।’’

আরও পড়ুন: মাত্র ২৪ ঘণ্টাতেই আক্রান্ত ৯৯, ফের করোনা-আতঙ্কে কাঁপছে চিন​

রাজ্য সরকার এ নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রাজ্যের ১৯টি জেলা এবং ৫০টি ব্লকে ‘রাইট টু ফুড ক্যাম্পেন’ নামের একটি সমীক্ষা চালানো হয়, যাতে শামিল ছিলেন অর্থনীতিবিদ জিন ড্রিজও। তাতে দুর্ভিক্ষের ছবিটাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেখা গিয়েছে, প্রান্তিক মানুষরা খাবার থেকে বঞ্চিতই রয়ে গিয়েছেন সেখান। রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও ৫০টি ব্লকের মধ্যে ২০টিতে কোনও চাল-ডাল-গম পৌঁছয়নি। এমন কিছু জায়গাও রয়েছে, যেখানে রেশনে খাদ্যশন্য মজুত থাকলেও, তা সাধারণের কাছে গিয়ে পৌঁছয়নি। বেশ কিছু জায়গায় আবার এ বছর জানুয়ারি থেকে রেশন বন্ধ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রেশন দোকানের ডিলারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে।

তবে বরাবরই দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে এসেছে ঝাড়খণ্ড সরকার। এ বছর মার্চে ক্ষমতায় আসা হেমন্ত সোরেনের সরকারও সেই পথেই হেঁটেছে। গত পাঁচ বছরে অনাহারে রাজ্যে কারও মৃত্যু হয়নি বলে দাবি করে তাঁর সরকার। রাজ্য বিধানসভায় অধিবেশন চলাকালীন সিপিআই বিধায়ক বলেন, অনাহারে এবং অপুষ্টির জেরে গত পাঁছ বছরে রাজ্যে ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন কি না, সরকারকে তা নিশঅচিত করতে হবে। জবাবে খাদ্যমন্ত্রী রামেশ্বর ওরাওঁ জানান, এই তথ্য ভুল। অথচ বিধানসভা নির্বাচনের আগে নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারেই ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা জানিয়েছিল, ‘‘অনাহারে মৃত্যুর জেরে আজও গোটা বিশ্ব পরিচিত ঝাড়খণ্ড।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যানেও এ কথা স্পষ্ট যে, গোটা দেশে অপুষ্টি গড় হারের তুলনায় ঝাড়খণ্ডের গ্রামাঞ্চলে ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ১৩ শতাংশ বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ১০ শতাংশ বেশি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কম ওজনের শিশুদের সংখ্যাও গোটা দেশের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE