Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

অবিশ্বাস্য সাম্রাজ্য! নিশ্চিন্ত আসনে বৃদ্ধ সম্রাট, কিন্তু যাদব দুর্গে হিতে বিপরীত ঘটাচ্ছে জোটটাই

নামেই শহর মৈনপুরী, চেহারা-ছবিতে গঞ্জই এখনও। রাস্তাঘাট চমৎকার। কিন্তু আধুনিক সমৃদ্ধির কোনও ছাপ নেই। মুলায়ম সিংহ যাদব নিজের এই খাসতালুককে অত্যন্ত যত্নে সাজিয়ে তুলেছেন, এমনটা এক বারের জন্যও মনে হবে না।

মৈনপুরীতে আরও একবার লড়তে নেমেছেন এই প্রাসাদের অধীশ্বর। অনুগামীরা বলছেন, জয় নিয়ে নয়, জয়ের ব্যবধান নিয়ে চর্চা হতে পারে। নিজস্ব চিত্র।

মৈনপুরীতে আরও একবার লড়তে নেমেছেন এই প্রাসাদের অধীশ্বর। অনুগামীরা বলছেন, জয় নিয়ে নয়, জয়ের ব্যবধান নিয়ে চর্চা হতে পারে। নিজস্ব চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
মৈনপুরী শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ১২:৫৯
Share: Save:

লম্বা-চওড়া প্ল্যাটফর্মটা টানটান রোদে ঝিমিয়ে রয়েছে। ত্রিসীমানায় কোনও যাত্রী নেই। থাকবেনই বা কেন? দিনে এক বারই ট্রেন আসে, এক বারই ফিরে যায়। স্কুলফেরত কয়েকটা বাচ্চাকে অবশ্য সাইকেল চালিয়ে চলে যেতে দেখা গেল ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে। আর স্টেশনের বাইরে প্রকাণ্ড বটগাছের গোড়ায় উবু হয়ে বসে রামশরণ যাদব বললেন, ‘‘ইঁয়াহা সাইকিল হি চলত্‌ হ্যায়।’’ বুড়ো রামশরণের এই আবেগটাই ততোধিক প্রবীণ ‘নেতাজি’র সবচেয়ে বড় মূলধন নিজের সাম্রাজ্য অটুট রাখার যুদ্ধে।

অবিশ্বাস্য এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ৮০ বছর বয়সে পৌঁছেও প্রত্যক্ষ নির্বাচনী লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রার্থী হয়েছিলেন আজমগঢ় আর মৈনপুরীতে। দুটোতেই জিতে মৈনপুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ বার শুধু মৈনপুরী থেকে লড়ছেন। এ মৈনপুরীতে নতুন করে কিছুই প্রমাণ করার নেই তাঁর।

ভোটের ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকার কোনও কারণ রয়েছে বলে তাঁর ঘোর বিরোধীও মনে করেন না। কারণ এ যাদবগড়ের রাজনীতি আর লাল টুপি, লাল-সবুজ পতাকা, সাইকেল প্রতীক প্রায় সমার্থক। বুড়ো যাদবজি ওই কারণেই বলেছিলেন— এখানে সাইকেলই চলে।

এলাকায় সমাজবাদী পার্টি ছাড়া আর কোনও দলের পতাকা দেখা যাচ্ছে না। বিজেপি নির্বাচনী কার্যালয় খুলেছে বটে, কিন্তু ময়দানে নিস্তেজ। মৈনপুরী, এটা, ইটাওয়া— যাদবদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। এই অঞ্চলে মুলায়ম সিংহ যাদবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পণ্ডশ্রম বা সময়ের অপচয় করতে চান না কোনও বিবেচক রাজনীতিকই। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে সৈফইয়ের যাদব পরিবারের ঝুলিতে উজাড় করে ভালবাসা ঢেলে দিচ্ছে যে মৈনপুরী, সেই মৈনপুরী কী পেয়েছে বিনিময়ে? উত্তরপ্রদেশের যাদব কুলপতি কী করেছেন মৈনপুরীর জন্য? এ প্রশ্নটাও ঘুরছে।

সৈফইয়ের যাদব পরিবারের ঝুলিতে উজাড় করে ভালবাসা ঢেলে দিচ্ছে যে মৈনপুরী। নিজস্ব চিত্র।

মুলায়ম কী করেছেন, এ প্রশ্ন বটতলার রামশরণকে করলে অবশ্য ফুঁসে উঠছেন। বছর পঞ্চাশের এক ক্ষৌরকারও ক্ষুর-কাঁচি নামিয়ে রেখে গুটি গুটি বটলতলার দিকে এগিয়ে আসছেন। তার পরে বলছেন, ‘‘আপ কো কিছু দিখে না দিখে, মৈনপুরীকা হালত সুধারনেওয়ালা মুলায়ম হি হ্যায়।’’ কিন্তু চাওয়ালা যুবক আর তাঁর তরুণ সঙ্গী মানতে নারাজ। চিমটি কাটার ভঙ্গিতে তিনি বলছেন, ‘‘কালকে এসেছিলেন না মুলায়ম, পর্চা ভরতে (মনোনয়ন দাখিল করতে)। তখন ওঁর দোকানে চুল কাটিয়ে গিয়েছেন। ২০ টাকার বদলে ২০০ টাকা দিয়েছেন বোধহয়, ওই জন্যই এই সব বলছেন।’’ শুনেই হো হো করে উঠছে ছোট্ট জমায়েতটার একটা অংশ। বাকিরা আবার রে-রে করে তেড়েও উঠছেন।

এ বছর মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন মুলায়ম সিংহ যাদব। ছবি: পিটিআই।

নামেই শহর মৈনপুরী, চেহারা-ছবিতে গঞ্জই এখনও। রাস্তাঘাট চমৎকার। কিন্তু আধুনিক সমৃদ্ধির কোনও ছাপ নেই। মুলায়ম সিংহ যাদব নিজের এই খাসতালুককে অত্যন্ত যত্নে সাজিয়ে তুলেছেন, এমনটা এক বারের জন্যও মনে হবে না। হৃষিকেশ থেকে ফারুখাবাদ পর্যন্ত যাওয়া একটা ট্রেন মৈনপুরী স্টেশন হয়ে যায়। সেটাই আবার ফেরে। স্টেশনের আর কোনও কাজ নেই দিনভর। তাই শহরের মধ্যে স্টেশন চত্বরটাই সবচেয়ে শান্তশিষ্ট। বটের ছায়ায় রোজ জমে ওঠে আড্ডা।

কিন্তু বটতলার আড্ডায় নেতাজিকে নিয়ে কী রকম চর্চা চলছে, সে সব লহমায় ভুলে যেতে হচ্ছে সৈফইয়ের স্কাইলাইন নজরে আসতেই। হ্যাঁ, স্কাইলাইনটাই সঠিক শব্দ।

চকচকে সড়ক মৈনপুরী থেকে বেরিয়ে আগরা-লখনউ হাইওয়ের তলা দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছে ইটাবার দিকে। সেই পথ ধরে খানিক এগিয়ে আবার ছোট রাস্তায় নামতে হচ্ছে। যে দিকে দু’চোখ যায়, গম পেকে রয়েছে মাঠ ভরে। কোথাও আবার পাকা গমের টানে হানা দিয়েছে নীলগাইয়ের ঝাঁক। হাইওয়ে থেকে অনেক ভিতরে এমন এক প্রত্যন্ত প্রান্তে এগোতে এগোতে আচমকা থমকে যেতে হয়। আরও গভীর দিগন্তে দেখা দিয়েছে কর্পোরেট চেহারার এক ঝাঁ-চকচকে শহরের অবয়ব! ওটাই সৈফই, মুলায়ম সিংহ যাদবের পৈতৃক ভিটে ওই গ্রামেই। অবশ্য এখন আর কোনও মাপকাঠিতেই গ্রাম বলা যাবে না।

প্রচার চলছে মৈনপুরীতে।

যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে যে রকম কংক্রিটে তৈরি, সৈফইয়ে পৌঁছনোর আগে রাস্তা সে রকম চেহারা নিল, প্রশস্ত হয়ে গেল। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং মহাবিদ্যালয়, বড় বড় স্কুল, একাধিক কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, সুবিশাল হাসপাতাল, পূর্ত বিভাগের বিরাট নিরীক্ষণ কেন্দ্র, বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের একের পর এক অট্টালিকাসম দফতর— চার পাশে গমের খেত আর নীলগাইয়ের রাজত্বের মাঝে আচমকা এই দৃশ্য দেখে আক্ষরিক অর্থেই থ হয়ে যেতে হয়!

আরও পড়ুন: লাইভ: নাগরিকপঞ্জী সংসদে পাশ করব এবং কার্যকরী করবই, ইস্তাহার প্রকাশে বললেন রাজনাথ​

তবে বিস্ময়ের আরও অনেক বাকি ছিল। এত ক্ষণ শুধু কলকাতা লাগোয়া নিউটাউন ধাঁচের শহরটা চোখে পড়ছিল। কিন্তু হনুমানের বিরাট মূর্তি সম্বলিত সুদৃশ্য পার্কের পাশ থেকে রাস্তাটা মুলায়ম সিংহ যাদবের বাড়ির দিকে মোড় নিতেই আবার ধাক্কা। নিউটাউন কোথায়? এ তো লুটিয়েন’স দিল্লি! সাদা পাঁচিলে ঘেরা একের পর এক সাদা সাদা বাংলো। কোনওটা ৩ একর, কোনওটা ৫ একর, কোনওটা না জানি কত একর জুড়ে! কোনও বাংলোয় উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার আদল, কোনওটাকে রাজভবনের মতো দেখতে, কোনওটা অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর বাংলোর মতন। কোনওটা বদায়ুঁর সাংসদ ধর্মেন্দ্র যাদবের, কোনওটা মুলায়মের ভাই তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শিবপাল যাদবের, কোনওটা অখিলেশের আর এক কাকা রামগোপাল যাদবের। গোটা এলাকাটাই লুটিয়েন’স দিল্লির ধাঁচে গাছে গাছে ঢাকা। বাঁক নিতে নিতে রাস্তা পৌঁছচ্ছে সৈফইয়ের প্রায় শেষ প্রান্তে। সেখানেই চোখধাঁধানো দুর্গপ্রাকার। পাঁচিল কোন প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে, আর কোথায় গিয়ে শেষ, তা রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে জরিপ করা অসম্ভব।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পাঁচিলের ভিতরে তিনটে বিশাল বাংলো। মেন গেটের ঠিক সামনেরটা মুলায়ম সিংহের জন্য। আর একটু ভিতরে অতিথিদের জন্য। তার চেয়েও ভিতরেরটা সমাজবাদী পার্টির বর্তমান সুপ্রিমো অখিলেশ যাদবের জন্য। এ সবের মাঝেই অস্থায়ী কাঠামোর কার্যালয়ও রয়েছে, সেটা মুলায়মের বাংলো লাগোয়া এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কর্মীরা আনাগোনা করছেন বাইক নিয়ে।

আরও পড়ুন: তৃণমূলের আধিপত্য ও বিজেপির অগ্রগতি, দুই ইঙ্গিত সমীক্ষায়

হোলিতে শেষ বার সৈফইয়ের বাংলোয় এসেছিলেন নেতাজি, জানালেন অতিথি নিবাস থেকে বেরিয়ে আসা যুবক। মনোনয়ন দাখিল পর্বে আর আসেননি, ইটাবায় ছিলেন, সেখান থেকেই লখনউ ফিরে গিয়েছেন। অখিলেশ যাদব, ডিম্পল যাদবরা ফেরেননি, তাঁরা সৈফইয়ের দুর্গপ্রাকারেই রাত কাটিয়েছেন। অতিথি নিবাসের কর্মী বললেন, ‘‘ভাইয়া (অখিলেশ) সকাল সকালই বেরিয়ে গিয়েছেন। ভাবিজি (ডিম্পল) আর বাচ্চারা ঘণ্টাখানেক আগে বেরোলেন।’’

আরও পড়ুন: দ্বিধাবিভক্ত জাঠভূমিতে অজিতের সম্বল বাবা, দুশ্চিন্তা আরও বাড়াচ্ছেন দলিতরা

আত্মীয়তার এই সম্বোধন শুধু দুর্গপ্রাকারের ভিতরে নয়, গোটা সৈফইয়েই। মুলায়ম, অখিলেশ, ডিম্পল নামগুলো সচরাচর উচ্চারিত হয় না। নেতাজি, ভাইয়াজি, ভাবিজিতেই স্বচ্ছন্দ সৈফইয়ের বাসিন্দারা।

যাদব কুলপতির দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর পরিবার ঠিক কোথায় পৌঁছে গিয়েছে, সৈফই না পৌঁছলে তার অনেকটাই জানা যায় না। কিন্তু একই সঙ্গে নিজের খাসতালুকটাকে যে ভাবে সাজিয়েছেন মুলায়ম, তা চাক্ষুষ না করলে বোঝা যায় না, খাসতালুক কেন খাসতালুক হয়েই থেকে যায় দশকের পর দশক।

গণ্ডগ্রামটা ঝাঁ-চকচকে শহরের চেহারা নিয়েছে। সৈফইয়ের অর্থনীতি বদলে গিয়েছে। বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রের মাঝে এয়ারস্ট্রিপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এর পরে মুলায়মের বাংলোর আকার নিয়ে আর কে ভাবতে চান?

বাংলোর আকার নিয়ে ভাবুন বা না ভাবুন, ‘যাদবগিরি’ নিয়ে ভাবনার চোরাস্রোত খেলতেই থাকে ভোটের যাদবগড়ে। এলাকায় কী রকম ‘দাদাগিরি’ চলত যাদবদের, দলিতের দিন কী ভাবে কাটত মুলায়ম বা অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সেচ ক্যানালের ধারে যেতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের কী ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হত ফাঁকা প্রান্তর থেকে, কী ভাবে রিপোর্ট লিখতে অস্বীকার করত থানা, স্বর্ণলঙ্কার বাইরে বেরলেই সে সব নিয়ে শোনা যায় বিস্তর অভিযোগ।

অতএব মায়াবতী যতই হাত মেলান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদীর সঙ্গে, মুলায়ম সিংহ যাদবের নিজের গড়ে সে জোট কতটা দানা বাঁধছে, তা নিয়ে সংশয় গভীর। যদিও মৈনপুরী, এটা, ইটাবায় জয় পাওয়ার জন্য মুলায়ম সিংহকে কখনও মায়াবতীর উপরে নির্ভর করতে হয়নি। এ বারও তিনি নির্ভর করছেন না। কিন্তু প্রদীপের ঠিক নীচেই যে অন্ধকার সবচেয়ে গাঢ়, মুলায়মের খাসতালুকে মায়া-অনুগামীদের মধ্যে চোরাস্রোতের আভাস সে কথাই বুঝিয়ে দিচ্ছে।

মুলায়ম সিংহ যাদবের নিজের গড়ে সে জোট কতটা দানা বাঁধছে, তা নিয়ে সংশয় গভীর। নিজস্ব চিত্র।

যাদবকুল অবশ্য কোনও চোরাস্রোত নিয়ে ভাবতে নারাজ। নেতাজির জয়ের মার্জিন কত হবে, চর্চা শুধু তা নিয়েই। মুখে মুখে ফিরছে ভাইয়াজির বেঁধে দেওয়া স্লোগান— সাইকিল চলায়েঁ, সেহত বনায়েঁ। আর একদা মায়ায় ভরসা রাখা ভোটদাতারা সাইকেল চালানোর উপকারিতা বুঝুন বা না বুঝুন, এ কথা বেশ বুঝছেন যে, আপাতত স্লোগানটায় সুর না মেলালে স্বাস্থ্য ভাল থাকবে না|

যদুবংশের রাজধানীতে মহাগঠবন্ধনের দিকে দলিতদের বক্র দৃষ্টির প্রতিফলন কি ভোটযন্ত্রেও ঘটতে পারে? যাদব দুর্গে সাইকেলে যদি ছাপ না দেন দলিত ভোটার, তা হলে কোন বোতামে চাপ দেবেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলে কিন্তু বৃদ্ধ যাদব সম্রাটকেও চিন্তায় পড়তে হতে পারে|

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE