Advertisement
E-Paper

জল-মুদি বন্ধ, মোদীর জন্মস্থানেই একঘরে সাত দলিত পরিবার, ভোটেও ‘টোটালি বয়কট’

গ্রামে দোকান রয়েছে। অথচ একটা দেশলাই বা সামান্য লবণটুকু কিনতে বাবুভাইদের যেতে হয় চার কিলোমিটার দূরের খেরালুতে। কেন?

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৮:২২
অম্রুতভাই সেনমা ও বাবুভাই সেনমা (বাঁদিক থেকে)। —নিজস্ব চিত্র।

অম্রুতভাই সেনমা ও বাবুভাই সেনমা (বাঁদিক থেকে)। —নিজস্ব চিত্র।

বাবুভাই সেনমা এ বার ভোট দেবেন না। ‘টোটালি বয়কট’— এই দুটো শব্দ বড্ড জোর দিয়েই উচ্চারণ করলেন। আর হ্যাঁ, এটাও না বলে পারলেন না, খোদ নরেন্দ্র মোদীর নিজের জেলাতেই যদি আমাদের এমন দশা হয়, তা হলে বুঝতেই পারছেন...

মেহসানা জেলা সদর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে নন্দালি। সম্পন্ন গ্রামই বলা যায়। পটেল, ঠাকোর, প্রজাপতি, রাজপুত— সবাই মিলিয়ে-মিশিয়ে। তার সঙ্গে সাত দলিত পরিবারও ছিল। হ্যাঁ, ছিল।

কারণ, সেই সাতের মধ্যে দুই পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর বাবুভাইদের মতো যে পাঁচ পরিবার রয়েছে, তারা কোনও রকমে উপেক্ষা-অবহেলা নিয়ে গ্রাম কাটাচ্ছে। কারণ, গোটা গ্রাম তাদের ‘বয়কট’ করেছে।

আরও পড়ুন: আজও এমজিআর-এই আটকে দলিত-উপজাতির প্রবীণরা, নবীনদের নজর কিন্তু ভবিষ্যতে

চৈত্রের গরম যেন নন্দালিতে একটু বেশিই। বিকেল তিনটের সময় মোবাইলের ওয়েদার অ্যাপ জানান দিচ্ছে, তেতাল্লিশ ডিগ্রি। গত আধ ঘণ্টার কথাবার্তায় যা যা জানা গিয়েছে—

গ্রামে দোকান রয়েছে। অথচ একটা দেশলাই বা সামান্য লবণটুকু কিনতে বাবুভাইদের যেতে হয় চার কিলোমিটার দূরের খেরালুতে।

গ্রামে কুয়োয় জল নেই। আছে ডিপ টিউবওয়েল। সেখান থেকে জল নেওয়া একেবারেই বারণ তাঁদের। পাশের গ্রাম থেকে আনতে হয়।

গ্রামে সব রাজনৈতিক দলেরই কয়েক জন করে নেতা আছেন। তাঁরা কেউই বাবুভাইদের কাছে ভোট চাইতে আসেননি। না, কোনও দলই নয়।

গ্রামে সেলুন আছে। কিন্তু বাবুভাইদের চুল-দাড়ি কাটতে যেতে হয় সেই খেরালুতেই। এ গ্রামে তাঁরা ক্ষৌরকার্য থেকেও বঞ্চিত।

২০১৬-র এপ্রিল থেকে এমন ভাবেই দিন কাটাচ্ছে নন্দালির সাত দলিত পরিবার। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে দুটো পরিবার অন্য গ্রামে চলে গিয়েছে। কিন্তু বাবুভাইরা এখনও থেকে গিয়েছেন, দাঁতে দাঁত কামড়ে। এখনও কোনও বদল হয়নি। নন্দালির অন্য বাসিন্দারা এই বিষয়ে একটি কথাও বলতে চান না। রাস্তায় যে দু’এক জন ছিলেন, তাঁরা প্রশ্ন শুনে নীরবে এগিয়ে গিয়েছেন। বাবুভাইয়ের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা পাড়তেই শোনা গেল, ‘‘এখন বিশ্রামের সময়। কথা বলা যাবে না।’’

আরও পড়ুন: দাম পাচ্ছেন না কৃষক, মন্ত্রীর প্রাসাদোপম বাড়ি, ক্ষোভের আঁচ দক্ষিণ দিনাজপুরে

মেহসানা বাসস্ট্যান্ড। —নিজস্ব চিত্র।

কেন এই বয়কট? বছর পঞ্চাশের বাবুভাই বলছেন, ওই এপ্রিলে মেহসানা জেলা উদ্যোগ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন পুত্রবধূর জন্য একটা সেলাই মেশিনের আবেদনপত্র নিয়ে। সরকারি প্রকল্পেই ওই মেশিন পাওয়া যায় বলে শুনেছিলেন। তাঁর কথায়: ‘‘যে সরকারি কর্মীর কাছে ওই আবেদনপত্র জমা দিতে গেলাম, তিনি নন্দালির বাসিন্দা। কিন্তু ওই কর্মী আমার আবেদনপত্র না নিয়ে জানিয়ে দিলেন, কপিলা সেনমা মানে আমার পুত্রবধূ সেলাই মেশিন পাবেন না। কেন? জি়জ্ঞেস করায় উনি চটে যান। তার পর দু’এক কথায় বচসা বেধে গেল। আমার গালে একটা চড় কষিয়ে দিলেন ওই সরকারি কর্মী! আমি দলিত তো, আমাকে মারাই যায়, তাই না!’’ এর পর বাবুভাই জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে ওই কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

কাসবা এলাকার রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।

বাবুভাই জানালেন, ওই সরকারি কর্মী এর পর গ্রামে ফিরে সমস্ত গ্রামবাসীকে একত্রিত করে সাত দলিত পরিবারকে বয়কটের দাবি জানান। সেই দাবি গ্রামবাসীরা মেনেও নেয়। তার পর থেকে বাবুভাইরা নিজের গ্রামেই একা। সরকার সেই অর্থে পদক্ষেপ করেনি বলেই অভিযোগ। তাই বাবুভাইয়ের সিদ্ধান্ত, ‘‘এ বার ভোট দেব না। টোটালি বয়কট। কোনও রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতা-কর্মী, ভোটকর্মী— কেউই আসেননি। ওদের যদি প্রয়োজন না থাকে, আমাদেরও নেই।’’ এর পর বাবুভাই মোক্ষম খোঁচাটা দিলেন, ‘‘মোদীজি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর জন্মভূমিতেই যদি দলিতদের এই হাল হয়, তা হলে আর কী-ই বা বলার থাকে।’’

হ্যাঁ, এই মেহসানার ভডনগরেই জন্ম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। শুধু কি তাই, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ এই মেহসানাতেই পড়াশোনা করেছেন। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দীবেন পটেল, গুজরাতের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী নিতিনভাই পটেল— তাঁদেরও জন্ম এই মেহসানায়। ১৯৮৪ সালে লোকসভায় বিজেপির খাতা খুলেছিল এই মেহসানার হাত ধরেই। এশিয়ার সবচেয়ে বড় ডেয়ারি ‘দুধসাগর’ এই জেলাতে। ওএনজিসি-র সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই মেহসানায়। বাবুভাইয়ের ভাই অম্রুতভাই সেনমার কথায়: ‘‘মেহসানা আসলে ভীষণই পাওয়ারফুল। তা সে রাজনীতি হোক বা অর্থনীতি। সেই পাওয়ারের তলায় আমরা চাপা পড়ে গিয়েছি।’’

আরও পড়ুন: গোটা গাঁধীনগরে একটা ছবিও নেই, আডবাণীকে শুধু পাওয়া গেল বিজেপি অফিসে প্রেস রুমের দেওয়ালে

কাসবা: যেখানে ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর কোনও প্রভাবই নেই। —নিজস্ব চিত্র।

চাপা শুধু নন্দালি পড়েনি। জেলাশহরের ঠিক গা ঘেঁষে দলিতদের বিশাল বসতি রয়েছে। ঝাঁ চকচকে সমর্পণ রোড থেকে ডান দিকে ঢুকলেই কাসবা এলাকা। পৌঁছে বোঝা গেল, এখানে কতটা ‘সফল’ মোদীর স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প। রাস্তার উপর দিয়েই নর্দমা বয়ে যাচ্ছে। এখানে সেখানে রাখা নোংরার ঢিবি। ঘিঞ্জি গলি। গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। গন্ধে নাক পাতা দায়। মহল্লার বেশ কিছু বাড়িতে শৌচাগার নেই। কেউ কেউ পাশের বাড়িরটা ব্যবহার করেন। কেউ বা... কাসবার বাসিন্দা অশোক পরমার বলছিলেন, ‘‘বার বার বলেও কোনও লাভ হয়নি। এই সব পরিষ্কার করার দায়িত্ব প্রশাসনের। আমাদের মানে দলিতদের দেখলেই তারা কার্যত দূরছাই করে। তবে ভোট বলে এখন একটু কাজ হচ্ছে। যেটুকু পরিষ্কার দেখছেন, সেটা ওই ভোটের কল্যাণেই।’’ এটা পরিষ্কারের নমুনা?

কেন দলিতদের এমন অবস্থা? মেহসানা থেকেই মোবাইলে প্রশ্নটা করা গেল বিজেপি নেতা কিসান সিন সোলাঙ্কিকে। তিনি তখন আমদাবাদে প্রচারকাজে ব্যস্ত। প্রশ্ন শুনে অবাক গলায় জবাব দিলেন, ‘‘না, না আপনি যেমনটা বলছেন তেমনটা নয়। দু’একটা জায়গায় সামান্য সমস্যা হয়তো আছে। তবে ও সব মিটে যাবে। চিন্তা করবেন না।’’ তার পরেই কটাক্ষ করে বললেন, ‘‘দলিতদের অবস্থা যদি এ রাজ্যে খারাপ হবে, তা হলে কি জিগনেস মেবানী নিশ্চিন্তে বিহারের বেগুসরাইতে কানহাইয়াকুমারকে জেতানোর জন্য পড়ে থাকতেন! এতেই তো বোঝা যায়, গুজরাতে দলিতরা ভাল আছে।’’

তবে কি দলিতদের মধ্যে জিগনেসের গ্রহণযোগ্যতা কমে গিয়েছে? তাই নিজের রাজ্যে ছেড়ে ভিন্‌রাজ্যে ভোটের কাজে? বিষয়টা মানলেন না জিগনেসের সহকর্মী কৌশিক পরমার। মেহসানা পুরনো আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘‘জিগনেসের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমি নিজে দলিত। জিগনেসের প্রভাব নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। এখনও তিনি সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য।’’

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

২০১৬-য় মেহসানার পটেল-বিপ্লব। —ফাইল চিত্র।

মেহসানার ভোট যদিও এই দলিতদের নিয়ে মোটেও ভাবিত নয়। কথাটা বললেন মেহসানারই বদলপুরা গ্রামের বাসিন্দা মফতলাল পটেল। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা জেলাটাই কার্যত পাটিদার প্রভাবিত। তাদেরই রাজ চলে এখানে।’’ সেই পাটিদাররা কি এখনও হার্দিক পটেলের সঙ্গে আছে? নাকি বিজেপির পটেল-ভোট ফের ফিরে আসবে তাদের কাছে? বছর দুয়েক আগে হার্দিক পটেলের নেতৃত্বে পাটিদার আন্দোলন বিপুল ভাবে শুরু হয়েছিল তো এই মেহসানা থেকেই। এখানকার বিশনগরে বিজেপি বিধায়ক রিশুভাই পটেলের কার্যালয়ে হামলা চালানোর অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হার্দিক ওই কারণে কংগ্রেসে যোগ দিয়েও ভোটে দাঁড়াতে পারলেন না। বৃদ্ধ মফতলাল একটু হাসলেন। তার পর বললেন, ‘‘এ বার এখানে দুই পাটিদারের লড়াই। এ জে পটেল আর সারদা বেন পটেল। এর মাঝে আর কোনও পটেল নেই।’’

কংগ্রেস এ জে পটেলকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সারদা বেনও দৌড়চ্ছেন মোদী-অমিতের ছবি নিয়ে। ভোট চাইছেন। কিন্তু বাবুভাইদের কাছে যাওয়ার কেউ নেই। বাবুভাইরা ‘টোটালি বয়কট’...

Lok Sabha Election 2019 Vote Boycott Social Boycott Narendra Modi BJP লোকসভা ভোট ২০১৯
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy