অ্যালবাম থেকে: স্বরাজ কৌশল ও সুষমা স্বরাজ। -ফাইল ছবি।
দু’টি আলাদা রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়েও যে কী ভাবে মিলে গেল তাঁদের দু’টি হাত, মিলে গেল হৃদয়, সেই রহস্যটা কখনওই তাঁরা ভেদ করেননি প্রকাশ্যে! এক জন কট্টর বিশ্বাসী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) মতাদর্শে। অন্য জন পুরোদস্তুর সমাজবাদী।
আলাপ কলেজে পড়ার সময়। দু’জনেরই হাঁটাহাঁটি একে অন্যের ঠিক উল্টো দিকে। মতাদর্শের দিক দিয়ে তো বটেই, পরিবারে দিক থেকেও।
তবু দু’জনের দু’টি পথ, দু’জোড়া হাত মিলে গেল সেই ১৯৭৫-এ। দেশে তখন জরুরি অবস্থা জারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। তার তিন-চার বছর আগে থেকেই গোটা দেশ তোলপাড় করে দিয়েছে লড়াকু নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজের রেল আন্দোলন। জরুরি অবস্থার সময় গ্রেফতার করা হল সমাজবাদী নেতা জর্জকে। মামলা শুরু হল সুপ্রিম কোর্টে।
স্বামী স্বরাজ কৌশলের সঙ্গে সুষমা। -ফাইল ছবি
সেই মামলায় জর্জের পক্ষে লড়ছিল আইনজীবীদের যে দল, তাতে ছিলেন দু’জনেই। সুষমা ও স্বরাজ কৌশল। হরিয়ানার অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারের কন্যা সুষমার অগাধ বিশ্বাস আরএসএসের মতাদর্শে। আর পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক স্বরাজ কৌশল বিশ্বাসী সমাজবাদের আদর্শে।
কিন্তু সেই সময় ইন্দিরা গাঁধীর জারি করা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সমাজবাদীদের সঙ্গে একজোট হয়েছে জনসঙ্ঘ, আরএসএস। ফলে, জর্জের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে লড়ছিল আইনজীবীদের যে দল, তাতে দু’জনের এক সঙ্গে কাজ করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আর সেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে লড়তেই দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, বিয়ে করার।
অত্যন্ত রক্ষণশীল হওয়ায় হরিয়ানায় সুষমার মা, বাবা, পরিবার, আত্মীয়স্বজন একেবারেই চাননি, সুষমা ও কৌশলের বিয়েটা হোক। কিন্তু বিয়েটা হল সুষমার জেদেই। ১৯৭৫-এর ১৩ জুলাই। সুষমা তাঁর নামের শেষে বসিয়ে দিলেন ‘স্বরাজ’। যখন তার সব নখ-দাঁত বের করে ফেলেছে জরুরি অবস্থা! সেই কঠিন সময়ে। নিজের বাড়ির বিরুদ্ধে কার্যত, ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেই!
আরও পড়ুন- সুষমার শেষ টুইট: ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী, জীবনভর এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম
আরও পড়ুন- বিজেপির সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সুষমার মরদেহ, শেষকৃত্য বিকেলে
সারাটা জীবন ধরে একই ছাদের তলায় কাটিয়েছেন সুষমা ও কৌশল, নিজেদের আলাদা আলাদা মতাদর্শে বিশ্বাসী থেকে। কেউ কাউকে প্রভাবিত করেননি। করার চেষ্টাও করেননি। তাই কোনও দিন স্বরাজ কৌশল যোগ দেননি বিজেপিতে। আবার সুষমাও কখনও সঙ্ঘ পরিবার ছেড়ে হাঁটেননি সমাজবাদী রাজনীতির পথে। তাই বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারিতে স্বরাজ কৌশলকে পাঠানো হল মিজোরামের রাজ্যপাল করে। সেখানে রাজ্য়পাল ছিলেন ’৯৩ পর্যন্ত।পরেও হরিয়ানা বিকাশ পার্টির সাংসদ হয়েছিলেন সুষমার স্বামী।
বাড়িতে শেষ শয্যায়। এক পাশে স্বামী স্বরাজ কৌশল, অন্য় পাশে কন্যা বাঁসুরি স্বরাজ। ছবি- পিটিআই
নিজে সমাজবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে স্বরাজও কখনও আপত্তি করেননি সুষমার রাজনীতিতে। বরং দু’জনেই চাইতেন রাজনীতির আবহ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের ব্যক্তিগত বৃত্তে আটকে রাখতে। পারতেন না, রাজনীতির প্রয়োজনে, মতাদর্শের পিছুটানে।
তবু যখন সুষমা এ বার সিদ্ধান্ত নিলেন, আর লড়বেন না ভোটে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জানিয়ে দিলেন, আর চান না মন্ত্রী হতে, তখন সম্ভবত খুব খুশিই হয়েছিলেন স্বামী স্বরাজ কৌশল। ভেবেছিলেন, এ বার সব সময় পাশেই পাবেন পেশায় আইনজীবী কন্যা বাঁসুরি ও স্ত্রী সুষমাকে।
নিজের স্বস্তির কথা অকপটে জানিয়েছিলেন কৌশল তাঁর টুইটে, ‘‘আর কখনও নির্বাচনে না লড়ার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার মনে আছে, একটা সময় মিলখা সিংও দৌড়নো বন্ধ করেছিলেন। তোমার এই ম্যারাথন শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ৪১ বছর। ১১টি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছ। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হলে ১৯৭৭ সালের পরে সবক’টি নির্বাচনেই তুমি দাঁড়িয়েছ। একমাত্র ১৯৯১ এবং ২০০৪ সালে দল তোমাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর টিকিট দেয়নি। ২৫ বছর বয়স থেকে ইলেকশনের লড়াই শুরু করেছিলে। ৪১ বছর কিন্তু বেশ লম্বা ম্যারাথন।’’
প্রিয়তমা স্ত্রীকে কৌশল এও বলেছিলেন, ‘‘ম্যাডাম গত ৪৬ বছর ধরে তোমার পিছন পিছন দৌড়চ্ছি। আমার বয়স তো আর ১৯-এর কোঠায় নেই। আমিও হাঁফিয়ে যাই আজকাল...’’
কৌশলকে ‘রিলিফ’ দেওয়ার জন্য ভোটে না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বটে শেষ পর্যন্ত।
কিন্তু জীবনের লড়াইটাই যে থামিয়ে দিলেন সুষমা! এই প্রথম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy