Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
GST

অজুহাত কোভিড, রাজ্যগুলির প্রাপ্য দিচ্ছে না কেন্দ্র, ভুগছে নাগরিক

রাজনীতির খেলাটাই হল প্রতিশ্রুতির। কারণ এটা রাখার দায় থাকে না। আর এই খেলার সব থেকে বড় মাঠ হল উন্নয়ন প্রকল্প। যেখানে আর্থিক দায় থাকে।

কোভিডের আগেও কি কেন্দ্র রাজ্যগুলির প্রতি প্রতিশ্রুত দায় মেটাচ্ছিল? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কোভিডের আগেও কি কেন্দ্র রাজ্যগুলির প্রতি প্রতিশ্রুত দায় মেটাচ্ছিল? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২০ ১৮:০৯
Share: Save:

এ বার জিএসটি বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিল কেন্দ্র। দায় চাপল কোভিড বাবদ বাজারের হালের ঘাড়ে। মানতেই হবে যে বাজারের অবস্থা খারাপ। নাগরিক তার নিজের আয়ের জায়গা থেকেই তা বুঝতে পারছেন। কিন্তু কোভিডের আগেও কি কেন্দ্র রাজ্যগুলির প্রতি প্রতিশ্রুত দায় মেটাচ্ছিল?

রাজনীতির খেলাটাই হল প্রতিশ্রুতির। কারণ এটা রাখার দায় থাকে না। আর এই খেলার সব থেকে বড় মাঠ হল উন্নয়ন প্রকল্প। যেখানে আর্থিক দায় থাকে। ধরুন না, এই রাজ্যগুলিকে জিএসটি বাবদ প্রাপ্য দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রের হাত তুলে দেওয়ার ঘটনাটাই। আমরা কি ভেবেছি যে এর ফলে রাজ্যগুলির কী হাল হবে? অথবা রাজ্যের প্রাপ্য না মেটানোর চাপ কী ভাবে আমাদের ঘাড়েই বর্তাবে!

কিন্তু রাজনীতি জানে যে আজকের আমপানের কান্না কাল কোভিডে ঢাকা পড়ে যাবে। আর বাজেটের খাতা বলে যাবে কেন্দ্রের তৈরি প্রকল্পগুলিতে রাজ্যের আর্থিক দায়ের কথা।

নেওয়া যাক ২০১৫ সালের বাজেটের কথাই। ওই বছরের বাজেটেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে— রাজ্যে যে সব কেন্দ্রীয় উন্নয়ন প্রকল্প চলছে তাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ছাঁটা হবে। রাজ্যগুলিকে গণতান্ত্রিক ভাবে সেই সব প্রকল্পকে স্থানীয় প্রয়োজন মেটাতে নিজের মতো সাজিয়ে নিতে দেওয়া হবে। কিন্তু বর্ধিত খরচের দায় নিতে হবে রাজ্যগুলোকেই।

অর্থাৎ, কেন্দ্র প্রকল্প গড়বে কিন্তু তার আর্থিক দায়ের বড় অংশই চাপবে রাজ্যের ঘাড়ে। প্রকল্প বাবদ হাততালি কিন্তু কেন্দ্রই পাবে। এর পরে কী হল? ২০১৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যদি হিসাব নিতে থাকি তা হলে দেখব— রাজ্যগুলির প্রাপ্তি কমছে আর উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের দায় বেড়েই চলেছে। তার চাপ কিন্তু শেষে গিয়ে বর্তাচ্ছে নাগরিকের ঘাড়েই। হিসাব বলছে, গত আর্থিক বছরে বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ রাজ্যগুলির দায় বেড়ে ৬৪ শতাংশে দাঁড়াবে। ২০১৪-১৫ সালে যা ছিল ৪৬ শতাংশে! আর আয়? তা কমছেই।

আরও পড়ুন: জল্পনা উস্কে দেওয়া কি আসলে সুচিন্তিত পদক্ষেপ

জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের কারণে কেন্দ্রীয় কোষাগারের উপর চাপ বেড়েছে। আর এই কারণ দেখিয়ে অর্থ কমিশন রাজ্যগুলির প্রাপ্য থেকে এক শতাংশ ছেঁটে দিয়েছে। অর্থাৎ এক দিকে রাজ্যগুলির খরচের দায় বাড়ছে, আর অন্য দিকে কমছে আয়। এর ফলে রাজ্যগুলি সম্পদ তৈরি থেকে সরে গিয়ে কোনও রকমে দৈনন্দিন দায় মেটাতে বাধ্য হচ্ছে। তার উপর এই কোভিডের চাপ। আগের প্রাপ্য আয়ের একটা অংশ তো কেন্দ্র মিটিয়েই উঠতে পারেনি, তার উপর এখন এই কোভিডের চাপে আসল নাভিশ্বাস উঠছে কিন্তু রাজ্যগুলিরই, এবং তার সঙ্গে নাগরিকদের।

নেওয়া যাক আয়ুষ্মান ভারতের কথা। সরকার পরিচালিত এই স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পটিতে যে রাজ্যগুলি আছে, তাদের প্রিমিয়ামের ৪০ শতাংশ দেওয়ার কথা। অর্থাৎ এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের দায় ৪০ শতাংশই। কিন্তু বাকি যে ৬০ শতাংশ টাকা কেন্দ্রের দেওয়ার কথা, তা নিয়মিত দিয়ে উঠতে পারছে না বলে অভিযোগ। এবং তা কোভিডের চাপের আগেই। ২০১৯ সালে কোভিড ছিল না। কিন্তু তখনও কেন্দ্র এই প্রকল্পে প্রতিশ্রুতি মেনে প্রিমিয়াম বাবদ নিজের দায় নিয়মিত মিটিয়ে উঠতে পারেনি। এই প্রকল্পে ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেও তা ছেঁটে ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছিল কেন্দ্র।

আরও পড়ুন: চটজলদি গবেষণাপত্র ছাপানোর প্রবণতা মস্ত বিপদ ডাকছে

এর ফল? তামিলনাড়ুর উদাহরণ নেওয়া যাক। কেন্দ্রের হয়ে এই প্রকল্পে ৩৬০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে, কেন্দ্রের কাছ থেকে ২৫ কোটির মতো পেয়েছিল রাজ্যটি। এ বছরের অবস্থা এখনও স্পষ্ট নয়। আর্থিক ব্যবস্থা পরিচালনার ধরন নিয়ে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ তাঁদের সংশয় প্রকাশ করেই চলেছেন। আজ কোভিডকে অজুহাত হিসাবে দেখানো হলেও, পরিস্থিতি কিন্তু সুবিধার ছিল না কোভিডের আগেও। উদয় প্রকল্প খাতে যে খরচের বোঝা রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপবে তাতে কিন্তু রাজ্যগুলির কোষাগারের হাল আরও খারাপ বই ভাল হবে না।

জিএসটি বাবদ ক্ষতিপূরণ দিতে সরকার যে জেরবার হয়ে যাবে, তা কিন্তু কোভিডের আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে যে সেস চাপানো হয়, তার আদায়ের বৃদ্ধির হার গত বছরে ২১ শতাংশের মতো ধরা হলেও, ক্ষতিপূরণের বৃদ্ধির হার কিন্তু ৫০ শতাংশের উপর ছিল। জিএসটি-র প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জমি ঠিক মতো তৈরি না করে এই কর ব্যবস্থার পথে হাঁটায়, বড় দায় আসলে নাগরিকের ঘাড়েই চাপছে।

সরকারের দায় নাগরিকের স্বার্থে রাজ্যের স্থায়ী সম্পদ বৃদ্ধি করা। রাস্তাঘাট থেকে হাসপাতাল। ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বা মূলধনী খরচ। স্থায়ী সম্পদ। আজ যদি দেশ জুড়ে সরকারি হাসপাতাল যথেষ্ট সংখ্যায় থাকত এবং তা ঠিকঠাক পরিচালিত হত, তা হলে কোভিড যুদ্ধ আরও সহজ হয়ে যেত।

কিন্তু দেশের রাজস্ব ও তার বণ্টন নিয়ে সংশয়ের জায়গা বোঝা যায় যখন দেখি, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে রাজ্যগুলি বাজেটে মূলধনী বাবদ বরাদ্দ থেকে ১৪ শতাংশ কম খরচ করেছে। কারণ আয় তো কমছেই। কেন্দ্রায়ন হচ্ছে রাজস্বের, কিন্তু খরচের দায় বর্তাচ্ছে রাজ্যের উপর। তাই স্ট্যাম্প ডিউটি বা পেট্রোল-ডিজেলের মতো যে কয়েকটি জায়গায় রাজ্যগুলি কর চাপাতে পারে, তার উপর করের বোঝা বাড়ছে। ডিজেল কিনতে হচ্ছে ৭৫ টাকার উপর লিটার পিছু দাম দিয়ে।

দোষ নাকি রাজ্যগুলিরই। কারণ তারা প্রকল্প শেষ করে না। আর হাততালি শুধুই কেন্দ্রের। সেটাই তো রাজনীতি। কিন্তু যদি সাধারণ নাগরিক তার বলি হয়ে যায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE