Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মুখ-ঢাকা টিউমার কেটে আঁধারমুক্তি

কোনও তুলনাই হয় না দু’জনের। গান্ধাররাজ অরুণেশ্বর আর জামশেদপুরের হতদরিদ্র গ্রামবাসী মিথিলেশকুমার যাদবের মধ্যে তবু আশ্চর্য মিল। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘শাপমোচন’ জানাচ্ছে, তালবিকৃতির অপরাধে গন্ধর্ব সৌরসেন সুরসভার শাপে বিকৃত দেহ নিয়ে অরুণেশ্বর নামে জন্মেছিলেন গান্ধাররাজের প্রাসাদে।

অস্ত্রোপচারের আগে। অস্ত্রোপচারের পরে। — নিজস্ব চিত্র।

অস্ত্রোপচারের আগে। অস্ত্রোপচারের পরে। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৯
Share: Save:

কোনও তুলনাই হয় না দু’জনের। গান্ধাররাজ অরুণেশ্বর আর জামশেদপুরের হতদরিদ্র গ্রামবাসী মিথিলেশকুমার যাদবের মধ্যে তবু আশ্চর্য মিল।

রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘শাপমোচন’ জানাচ্ছে, তালবিকৃতির অপরাধে গন্ধর্ব সৌরসেন সুরসভার শাপে বিকৃত দেহ নিয়ে অরুণেশ্বর নামে জন্মেছিলেন গান্ধাররাজের প্রাসাদে। আর গরিব গ্রামবাসী মিথিলেশের মুখ বিকৃত করে দিয়েছিল অতিকায় এক টিউমার। আশ্রয় হিসেবে দু’জনেই অন্ধকারের আড়াল বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজা হয়েও রাজপুরীর অন্ধকার গৃহে দিন কাটত অরুণেশ্বরের। আর টিউমার মিথিলেশকে এমনই ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল যে, গামছায় মুখ ঢেকে তিনি বসে থাকতেন জীর্ণ গৃহের অন্ধকার কোণে। মুক্তিতেও মিল দু’জনের। অরুণেশ্বরের মুক্তির আলো হয়ে এসেছিল জন্মজন্মান্তরের প্রেম। আর মিথিলেশকে মুক্তি দিয়েছে আধুনিক শল্যচিকিৎসার কল্যাণ।

শাপমুক্তির জন্য অরুণেশ্বরকে যৌবনবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর কুড়ি কুড়ি বছর না-হোক, মিথিলেশকে অন্তত এক কুড়ি বছর জীবন কাটাতে হয়েছে গামছার আড়ালে মুখ ঢেকে। মিথিলেশের বাড়ি জামশেদপুরের কাছে এক গ্রামে। হতদরিদ্র পরিবার। বছর পাঁচেক যখন বয়স, তখনই টিউমার দেখা দেয় তাঁর বাঁ গালে। ক্রমশ তা বেড়ে মুখের পুরো বাঁ দিক ঢেকে দেয়। সেই টিউমারের চাপে গলে গিয়েছে তাঁর বাঁ চোখের মণি। ঠোঁট এমন ভাবে বেঁকে গিয়েছিল যে, শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। শ্বাসও নিতে পারতেন না ভাল করে। ওই বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখের জন্য কেউ তাঁকে কাজও দিতেন না। ফলে গায়ে-গতরে খেটে রুজিরোজগারের রাস্তাও ছিল বন্ধ। টাকাপয়সার অভাবে অস্ত্রোপচার করাতে পারেননি। মুখ ঢেকে ঘরের অন্ধকারে বসে থাকাটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের একটা অংশ চলে গিয়েছে সেই অন্ধকারের গর্ভে।

বিয়ের সূত্রে অরুণেশ্বরের মুক্তি হয়ে এসেছিলেন তাঁর পূর্বজন্মের প্রেয়সী মধুশ্রী। কমলিকা নামে মদ্ররাজকুলে জন্ম নিয়ে জন্মান্তরের প্রেমিককে প্রেমস্পর্শেই শাপমুক্ত করেছিলেন তিনি। মিথিলেশের মুক্তি হয়ে এসেছিলেন বাড়ির কাছেই এক স্বাস্থ্য শিবিরের চিকিৎসকেরা। তাঁদের পরামর্শেই হাওড়ার নারায়ণ সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে চলে আসেন জামশেদপুরের ওই যুবক। সম্প্রতি সেখানে অস্ত্রোপচার করে তাঁর বছর কুড়ির প্রায় এক কিলোগ্রাম ওজনের টিউমারটি কেটে বাদ দিয়েছেন তাঁরাই। জীবনটাই বদলে গিয়েছে মিথিলেশের। বিয়ের পরে শাপমুক্ত হয়েছিলেন অরুণেশ্বর। টিউমার-মুক্ত হয়ে মিথিলেশও ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর। বলছেন, ‘‘এখন আমি সংসার করতে পারব। কাজকর্মও করতে পারব।’’

কতটা সুস্থ হয়েছেন মিথিলেশ?

সার্জন রাজদীপ গুহ জানান, এই ধরনের টিউমারকে ‘অস্টিওব্লাস্টোমা’ বলা হয়। সেটা কেটে বাদ দেওয়ায় যুবকটি এখন সুস্থ। তবে আবার অস্ত্রোপচার দরকার। কেননা তাঁর মাড়িতে একটা ইনপ্ল্যান্ট বসাতে হবে। লাগাতে হবে নকল চোখ। বাঁ গালের হাড় প্রতিস্থাপন করতে হবে। এই অস্ত্রোপচারও হবে নিখরচায়।

তবে এই সব প্রত্যঙ্গ ‘ইমপ্ল্যান্ট’-এর জন্য প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা দরকার। সেই টাকা তোলার জন্য বিভিন্ন সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তির কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

national news tumour surgery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE