Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

লগ্নি টানায় মমতার বাংলা শেষের পাঁচে

ঘটা করে শিল্প সম্মেলন। দেশের থেকেও রাজ্যের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বেশি বলে দাবি। বিনিয়োগকারীদের লাল কার্পেট পেতে আমন্ত্রণ। ঝুড়ি ঝুড়ি ঘোষণা। বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যবাসীর করের টাকায় তরুণ শিল্পপতিদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছকে দেওয়া ‘রিয়েলিটি শো’।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

ঘটা করে শিল্প সম্মেলন। দেশের থেকেও রাজ্যের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বেশি বলে দাবি। বিনিয়োগকারীদের লাল কার্পেট পেতে আমন্ত্রণ। ঝুড়ি ঝুড়ি ঘোষণা। বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যবাসীর করের টাকায় তরুণ শিল্পপতিদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছকে দেওয়া ‘রিয়েলিটি শো’। কিন্তু রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রের বাস্তবতা যে একেবারেই অন্য রকম, আরও এক বার তা প্রমাণিত হল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, গত আর্থিক বছরে লগ্নির হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে শেষ সারিতে। আরও স্পষ্ট করে বললে, লগ্নির হিসেবে শেষ পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে ঠাঁই পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

দেশে এক বছরে যে লগ্নি এসেছে, তার মাত্র ১.৩ শতাংশ জুটেছে রাজ্যের ভাগ্যে। প্রত্যাশা মতোই প্রথম সারিতে রয়েছে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি। তবে প্রকল্পের সংখ্যা কম হলেও বড় মাপের লগ্নি এনে সকলকে পিছনে ফেলে দিয়েছে নবীন পট্টনায়কের ওড়িশা।

জমির জটই হোক বা সিন্ডিকেট-রাজ, পশ্চিমবঙ্গে যে লগ্নি আসছে না, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই রিপোর্টই তার প্রমাণ বলে মনে করছে শিল্প মহল। বিধানসভা ভোটের আগে জানুয়ারি মাসে রাজ্য সরকার ফের ‘গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর আয়োজন করছে কলকাতায়। তার প্রচারে এসে গত সপ্তাহে রাজ্যের অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র দাবি করে গিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর গত চার বছরে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার লগ্নি এসেছে। এই সাফল্যের জন্য রাজ্যের শিল্পবান্ধব নীতির কথাও প্রচার করেছিলেন তিনি। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট সেই প্রচারের বেলুন চুপসে দিল।

পশ্চিমবঙ্গে যে বড় কোনও বিনিয়োগ সাম্প্রতিক কালে আসেনি, এটা তারও প্রমাণ। দিল্লির বণিকসভার এক শীর্ষকর্তা বললেন, ‘‘বড় বিনিয়োগ না আসার কারণ জমির সমস্যা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, রাজ্য জমির বন্দোবস্ত করবে না। কিন্তু যে রাজ্যে জমির মালিকানা বহু ভাগে বিভক্ত, সেখানে বড় মাপের জমি কিনতে গেলে কেউ না কেউ বেঁকে বসবেন। ফলে গোটা প্রকল্পই আটকে যাবে।’’ আর এক শিল্পকর্তার বক্তব্য, জমি কেনার পরে তার সীমানা বরাবর পাঁচিল দিতে গেলেও শাসক দলের মদতপুষ্ট সিন্ডিকেট উদয় হচ্ছে। বড় জমির অভাব বলে রাজ্য সরকারই ছোট ও মাঝারি শিল্পে গুরুত্ব দিয়েছিল। তাতেও লাভ কিছু হয়নি। অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, বড় শিল্প হলে সেই শিল্পের কাঁচামাল জোগানের জন্যই বহু ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে বড় শিল্প হচ্ছে না। তাই ছোট ও মাঝারি শিল্পই বা কেন হবে!

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, প্রথম সারির রাজ্যগুলি বাজি মারছে বড় বিনিয়োগ এনেই। যেমন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের প্রকল্পগুলি গিয়েছে মূলত ছত্তীসগঢ় ও উত্তরপ্রদেশে। গুজরাত ও মহারাষ্ট্র টেনে নিয়েছে বস্ত্র শিল্পের বড় বিনিয়োগ। ধাতু শিল্পে লগ্নি পেয়েছে ওড়িশা ও মহারাষ্ট্র। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪-’১৫ আর্থিক বছরে গোটা দেশে ৮৩০টি সংস্থা ১,৪৫,৯০০ কোটি টাকা লগ্নির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আগের আটকে থাকা যে সব প্রকল্প ওই বছরে রূপায়ণ হয়েছে, সেই হিসেব ধরলে মোট লগ্নি হয়েছে ১,৯৩,৩০০ কোটি টাকা। ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গুজরাত, অন্ধ্র ও ছত্তীসগঢ়—এই ছ’টি রাজ্য মিলেই ৬৬.৮ শতাংশ লগ্নি টেনে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা বা হলদিয়ায় শিল্প সম্মেলন করলেও বা মুম্বই গিয়ে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করলেও লাভের লাভ কিছু হয়নি।

কোন রাজ্যে কত লগ্নি হচ্ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার হিসেব কষে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্যের হিসেবে। ফলে এই পরিসংখ্যানকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন অর্থনীতিবিদরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, শুধু গত অর্থ বছর নয়। গত পাঁচ বছর ধরেই, অর্থাৎ ২০১০-’১১ থেকে ২০১৪-’১৫-র হিসেব করলেও লগ্নির বেশির ভাগটা গিয়েছে ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যে। উল্টো দিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকেছে পিছনের সারিতেই। তিন বছর ধরেই গোটা দেশের মোট লগ্নির সামান্যই জুটছে পশ্চিমবঙ্গের ঝুলিতে। যার পরিমাণ ১ শতাংশ বা তার সামান্য কিছু বেশি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE