Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Science News

মাটি খুঁড়ে আগ্নেয়গিরি দেখতে মঙ্গলে নামল নাসার ‘ইনসাইট’

কোন কোন ‘মণি-মাণিক্য’ লুকিয়ে রয়েছে মঙ্গলের অন্দরে, মাটি খুঁড়ে তার তন্নতন্ন তল্লাশ চালাবে নাসার পাঠানো ‘ইনসাইট’ ল্যান্ডার মহাকাশযান। ‘লাল গ্রহ’-এর অন্দরে তরল জলের ধারা এখনও গোপনে বয়ে চলেছে কি না, তা-ও খুঁজে দেখবে নাসার এই ল্যান্ডার।

দু’টি সোলার প্যানেল খুলে মঙ্গলে ইনসাইট। শিল্পীর কল্পনায়। সৌজন্যে: নাসা।

দু’টি সোলার প্যানেল খুলে মঙ্গলে ইনসাইট। শিল্পীর কল্পনায়। সৌজন্যে: নাসা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ১৪:৩০
Share: Save:

মঙ্গলে নেমে পড়ল ‘ইনসাইট’। তাঁর কাঁধে চাপানো হয়েছে গুরুদায়িত্ব। ‘ইনসাইট’-ই প্রথম মানবসভ্যতার পাঠানো কোনও মহাকাশযান, যা ‘লাল গ্রহ’-এর মাটি খুঁড়বে।

কোন কোন ‘মণি-মাণিক্য’ লুকিয়ে রয়েছে মঙ্গলের অন্দরে, মাটি খুঁড়ে তার তন্নতন্ন তল্লাশ চালাবে নাসার পাঠানো ‘ইনসাইট’ ল্যান্ডার মহাকাশযান। লাল গ্রহ-এর অন্দরে তরল জলের ধারা এখনও গোপনে বয়ে চলেছে কি না, তা-ও খুঁজে দেখবে নাসার এই ল্যান্ডার। দেখবে এখনও অগ্ন্যূৎপাত হয় কি না মঙ্গলের পিঠের নীচে, হলে তা কতটা ভয়াবহ। এও দেখবে, কম্পন কতটা তীব্র হয় ‘লাল গ্রহ’-এর শিলাস্তরে (যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘মার্সকোয়েক’)।

উৎক্ষেপণের পর মহাকাশে টানা সাত মাস দৌড়ে সোমবার গভীর রাতে (ভারতীয় সময় রাত ১টা ২৪ মিনিট) মঙ্গলে পা ছুঁইয়েছে নাসার ওই ল্যান্ডার মহাকাশযান। পাঁচ বছর আগে নাসার পাঠানো রোভার ‘মিস কিউরিওসিটি’ এখন যেখানে রয়েছে, তার ধারেকাছেই মঙ্গলের বিষূবরেখায় ‘এলিসিয়াম প্লানিশিয়া’ এলাকায় নেমেছে ইনসাইট। যে এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে বহু কোটি বছর আগে লাল গ্রহ-এর অন্দরের আগ্নেয়গিরিগুলি থেকে বেরিয়ে আসা লাভা স্রোত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে হেতু সেই লাভা স্রোত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, তাই লাভা জমে থাকা ওই এলাকা অনেকটাই সমতল। এবড়োখেবড়ো নয় বলেই বিস্তর হিসেব কষে, বেছে বেছে মঙ্গলের বিষূবরেখার ওই এলাকাতেই ইনসাইট-কে নামিয়েছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। যাতে কোনও ভাবে টাল সামলাতে না পারার জন্য ব্যাঘাত না ঘটে ইনসাইট ল্যান্ডারের কাজকর্মে।

ইনসাইট-এর পাঠানো প্রথম ছবি। মঙ্গলের পিঠ থেকে, ২৬ নভেম্বর রাতে। ‘এলিসিয়াম প্লানিশিয়া’ এলাকায়। ছবি- নাসা

এর আগে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করার জন্য পাঠানো হয়েছে বহু ‘অরবিটার’। পাঠানো হয়েছে লাল গ্রহ-এর পিঠে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি ‘রোভার’ও। নামানো হয়েছে কয়েকটি ‘ল্যান্ডার’ও। কিন্তু তারা কেউই মঙ্গলের মাটি খোঁড়েনি। নজর দেয়নি মঙ্গলের ভিতরে। এই কাজটাই এ বার করবে ইনসাইট।

আরও পড়ুন- মঙ্গলে কী ভাবে শহর গড়ে তুলবে, নকশা বানাল এমআইটি​

আরও পড়ুন- মানুষের জিনেও ছুরি-কাঁচি! বিতর্কের মুখে চিনের গবেষক​

এ বছরের ৫ মে ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যান্ডারবার্গ এয়ার ফোর্স বেস থেকে ইনসাইট-কে রওনা করানো হয়েছিল মহাকাশে। গত সাত মাসে মহাকাশে ৩০ কোটি মাইল বা ৪৫ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছে ইনসাইট। মঙ্গলে ইনসাইট কাজ করবে দু’বছর। ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত।

কেন মঙ্গলে পাঠানো হল ইনসাইট-কে?

‘অপরচুনিটি’, ‘কিউরিওসিটি’-র মতো দু’টি রোভার পাঠানোর পরেও লাল গ্রহ-এ ইনসাইট পাঠানো হয়েছে মূলত, মাটি খোঁড়ার জন্য। মাটি খুঁড়ে মঙ্গলের ভিতরের আগ্নেয়গিরিগুলির সক্রিয়তা বোঝা ও মাপার জন্য। যা আগামী দিনে চাঁদ ও মঙ্গলে মানবসভ্যতার পুনর্বাসনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জিম ব্রিডেনস্টিনের।

এন্ট্রি, ডিসেন্ট, ল্যান্ডিং। যে ভাবে মঙ্গলে নামল ইনসাইট, দেখুন ভিডিয়ো

সোমবার রাতে মঙ্গলের মাটিতে ইনসাইট-এর পা ছোঁয়ানোর কথা নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি (জেপিএল)- বিজ্ঞানীরা প্রথম জানতে পারেন মঙ্গলের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা নাসারই মহাকাশযান ‘মার্স কিউব ওয়ান (মার্কো) কিউবস্যাটস’-এর পাঠানো রেডিও সিগন্যাল থেকে। গত মে মাসে ইনসাইট-এর সঙ্গে একই রকেটে চাপিয়ে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ‘মার্কো’-কে। কক্ষপথে ‘মার্কো’-কে রেখে মঙ্গলের মাটিতে পা ছুঁইয়ে দেওয়ার পরেও ‘মার্কো’র সঙ্গে প্রতিটি পলকে যোগাযোগ রেখে চলেছে ইনসাইট। লাল গ্রহ-এর মাটি ছোঁয়ার পরেই গত কাল রাতে ‘মার্কো’-কে সিগন্যাল পাঠিয়েছিল ইনসাইট। ‘মার্কো’ সেটাই রিলে করে দেয় পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরিতে।

জেপিএল-এ ইনসাইট-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার টম হফম্যান বলেছেন, ‘‘মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ইনসাইট যখন ঢুকছিল, তখন তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২ হাজার ৩০০ মাইল বা ঘণ্টায় ১৯ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। তার পরের সাড়ে ছয় মিনিটে খুব দ্রুত কমিয়ে ফেলা হয় ইনসাইট-এর গতিবেগ। মঙ্গলের মাটি থেকে ইনসাইট যখন ছিল ঠিক এক মাইল উপরে, তখন নাসার ওই ল্যান্ডারের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় মাত্র এক হাজার কিলোমিটার। পরে তা আরও কমানো হয়।’’

কেন খুব দ্রুত কমানো হয়েছিল ইনসাইট-এর গতিবেগ?

নাসার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মূলত, দু’টি কারণে। এক, যে গতিবেগে মহাকাশে দৌড়চ্ছিল ইনসাইট, ঠিক সেই গতিবেগেই মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়লে, বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে গোটা মহাকাশযানটারই পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। লাল গ্রহ-এর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পরেও দ্রুত ইনসাইট-এর গতিবেগ কমিয়ে না আনা হলে মঙ্গলের অভিকর্য বল নাসার ল্যান্ডারটিকে তার পিঠে টেনে নিয়ে গিয়ে আছড়ে নষ্ট করে দিত।

কী ভাবে চলবে ইনসাইট?

নাসার তরফে জানানো হয়েছে, ইনসাইট তার দু’বছরের মেয়াদে যাবতীয় কাজকর্ম করার জন্য শক্তিটা নেবে সূর্যের কাছ থেকে। তার জন্য ইনসাইট-এ রয়েছে সোলার প্যানেল। যেগুলির প্রত্যেকটি চওড়ায় সাত ফুট বা ২.২ মিটার। পৃথিবীর চেয়ে সূর্য থেকে দূরে আছে বলে ইনসাইট-এর ওই দু’টি সোলার প্যানেল সূর্যালোক কম পাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা হবে না তার কাজকর্মে। মেঘমুক্ত আকাশে গিলে ৬০০ থেকে ৭০০ ওয়াট সৌরশক্তি পেলেই ইনসাইট-এর সোলার প্যানেলগুলির প্রয়োজন মিটবে।

মঙ্গলের ধুলোঝড়েও তেমন চিন্তা নেই ইনসাইট-এর

মঙ্গলে প্রায়ই হয় তুমুল ধুলোর ঝড়। আর সেই ঝড় হয়ে উঠলে লাল গ্রহ-এর আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। আর সেটা দীর্ঘ দিন ধরে থাকে। তখন পৃথিবী থেকে আর মঙ্গলের পিঠে নামা রোভার, ল্যান্ডারগুলিকে দেখা যায় না। তাদের সিগন্যাল পাঠানো যায় না। তারাও সিগন্যাল পাঠাতে পারে না। কিছু দিন আগেই ধুলোর ঝড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল নাসার রোভার মহাকাশযান কিউরিওসিটি। নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ইনসাইট-এ এমন ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে সেই বিপদ এড়ানো যায় অনেকটাই। ওই সময় সূর্যালোক থাকে না বলে রোভার, ল্যান্ডারদের সোলার প্যানেলগুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু ইনসাইট-এর সোলার প্যানেলগুলি দিনে ২০০ থেকে ৩০০ ওয়াট সূর্যালোক পেলেই সক্রিয় থাকবে।

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE