Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

আশার দিশা, এড্স-মুক্ত ‘লন্ডন রোগী’

এড্‌স আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় এক কোটি মানুষকে আশার আলো দেখালেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের একদল চিকিৎসক-গবেষক।

‘বার্লিন পেশেন্ট’: টিমোথি রে

‘বার্লিন পেশেন্ট’: টিমোথি রে

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৫:১৫
Share: Save:

বারো বছর পরে আবার!

এড্‌স আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় এক কোটি মানুষকে আশার আলো দেখালেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের একদল চিকিৎসক-গবেষক। এড্‌স এবং রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত এক রোগীর অস্থিমজ্জা (স্টেম সেল) প্রতিস্থাপন করেছিলেন ওই চিকিৎসক-গবেষকেরা। তিন বছর ধরে ওই রোগীকে ক্রমাগত পরীক্ষা করে তাঁরা দাবি করেছেন, লন্ডনের ওই রোগী এখন সম্পূর্ণ ভাবে এড্‌স-মুক্ত। তাঁদের গবেষণাপত্রটি মঙ্গলবার ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

ঠিক বারো বছর আগে বার্লিনের একটি হাসপাতালেও একই ভাবে চিকিৎসক-গবেষকেরা মার্কিন বংশোদ্ভূত বার্লিনের বাসিন্দা টিমোথি রে ব্রাউনের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে তার ফল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ‘লন্ডন পেশেন্ট’-এর মতো ‘বার্লিন পেশেন্ট’ নামে পরিচিত টিমোথি ১৯৯৫ সালে এড্‌স-এ আক্রান্ত হন। ২০০২ সালে তাঁর রক্তের ক্যানসার ধরা পড়ে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পরে দেখা যায়, এড্‌স আর ব্লাড ক্যানসার দু’টি রোগ থেকেই তিনি মুক্ত। টিমোথি এখনও বেঁচে।

কী ভাবে সম্ভব হল

• কোষে যে কোনও ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়া ঢুকতে গেলে তাকে বাহকের সাহায্য নিতে হয়
• ওই সব বাহককে বলে রিসেপটর
• প্রতিটি ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়ার জন্য আলাদা আলাদা রিসেপটর থাকে
• এড্‌সের ভাইরাসের রিসেপটরের নাম সিসিআরফাইভ
• অনেক মানুষের শরীরে এই সিসিআরফাইভের জিনগত পরিবর্তন (মিউটেশন) হয়
• ওই সব ব্যক্তির স্টেম সেল যদি এড্স রোগীর শরীরে ঢোকে সেক্ষেত্রে দেহে বিপ্লব ঘটে
• এড্স রোগীর শরীরে সিসিআরফাইভের জিনগত পরিবর্তন ঘটে
• নতুন সিসিআরফাইভ এইচআইভি-কে চিনতেই পারে না
• ফলে এড্‌সের ভাইরাস কোষের মধ্যে ঢুকতেই পারে না
• এড্স রোগীর শরীরে নতুন করে সংক্রমিত হতে পারে না ভাইরাস
• রোগী ধীরে ধীরে ভাল হয়ে ওঠেন

‘লন্ডন পেশেন্ট’-এর নাম, ঠিকানা, তিনি কোন দেশের নাগরিক, তা অবশ্য গোপন রেখেছেন গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পরে ওই রোগীর রক্তের ক্যানসার সেরে গিয়েছিল। এ বার তিনি এড্স থেকেও মুক্তি পেলেন।

বার্লিনের গবেষণার পরে পৃথিবীর নানা দেশে চিকিৎসক-গবেষকেরা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এড্‌স নিরাময়ের কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু কোনওটাই সফল হয়নি। এমনকি এড্‌স-এর টীকা তৈরির প্রক্রিয়াও সফল হয়নি। তবু হাল ছাড়েননি কেউ। বার্লিনের সাফল্য নিয়ে আরও গবেষণা চালানোর জন্য ইউরোপে একটি গবেষক গোষ্ঠী তৈরি হয়, যাঁরা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এড্‌স নিরাময়ের জন্য প্রচেষ্টা নিরন্তর চালিয়ে আসছিলেন। ওই দলের এক গবেষক অ্যানমেরি ওয়েসিং-এর দাবি, তাঁরা আলাদা করে ৩৮ জন এডস রোগীর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। লন্ডনের ওই রোগী ছিলেন ৩৬ নম্বরে। এই সাফল্য বাকিদেরও আশান্বিত করছে। ১৯ নম্বর রোগীও উন্নতির ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তবে তাঁর ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত বলার সময় আসেনি বলে সংবাদমাধ্যমে জানান ওয়েসিং। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, লন্ডনের সাফল্য প্রমাণ করে দিল বার্লিন কোনও মিরাকল ছিল না। কোন পথে এগোলে এডস জয় করা সম্ভব, তার একটা দিশা এ বারে পাওয়া গেল।

কী রকম? লন্ডন-এর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় বংশোদ্ভুত গবেষক রবীন্দ্র গুপ্তও সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘বারো বছর আগে এবং এ ক্ষেত্রে যে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, দু’টিতেই এইচআইভি-র রিসেপটর-এর জিনগত পরিবর্তন (মিউটেশন) হয়েছে। তাই তারা আর এইচআইভি ব্যাক্টিরিয়াকে খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে কোষের মধ্যে ঢুকতেই পারছে না।’’

গবেষক রবীন্দ্র গুপ্ত

১২ বছর আগে

• বার্লিনের এক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল টিমোথি রে ব্রাউনের
• তাঁর শরীরে প্রথমে এড্‌সের সংক্রমণ হয়, পরে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি
• কেমোথেরাপিতে কাজ না হওয়ায় তাঁর অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়

• টিমোথির শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছিল যে চিকিৎসকেরা তাঁর বাঁচার আশা ত্যাগ করেছিলেন
• কিন্তু অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে
নতুন স্টেম সেল শরীরে যাওয়ার পরে অবাক
হন চিকিৎসকেরা
• টিমোথির ব্লাড ক্যান্সারের পাশাপাশি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে থাকে
• চিকিৎসকেরা এড্‌সের ওষুধ কিছু দিনের জন্য বন্ধ করে দেন
• এর পরেও দেখা যায় রক্তে এড্‌সের ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে না
• পুরো সুস্থ হয়ে যান টিমোথি, ১২ বছর পরে তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ

এইচআইভি হল সেই ভাইরাস, যা থেকে এডস হয়। রিসেপটর হল, কোষের সেই অংশ, যাতে এইচআইভি যুক্ত হয়। রবীন্দ্র বলেন, ‘‘কোনও ভাবে ‘সিসিআর৫’ নামে ওই রিসেপটরটির জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারলেই আমরা এডস রুখে দিতে পারব। কী ভাবে তা সম্ভব, খুঁজে বের করাই আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য,’’ বলেন ওই জীববিজ্ঞানী। তাঁর দাবি, ‘বার্লিন পেশেন্ট’ টিমোথির মতো তাঁদের ‘লন্ডন পেশেন্ট’ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন।

কলকাতার গবেষকরাও ‘লন্ডন পেশেন্ট’-এর অগ্রগতির দিকে অধীর আগ্রহে নজর রেখেছেন। এই সাফল্যের পরে তাঁরা বলছেন, ‘‘একদিন না একদিন পৃথিবীকে এডস-মুক্ত করার স্বপ্ন দেখি আমরা। সেই স্বপ্ন অনেকটা হাতের নাগালে এল।’’ তবে কিছু কিছু প্রশ্নও সামনে এসেছে। কলকাতা কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেজ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তী যেমন বলেন, ‘‘এটা যে যুগান্তকারী কাজ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানবদেহে সিসিআর৫-এর আরও কাজ রয়েছে। তার জিনগত পরিবর্তনের সময়ে গবেষকেরা সেটাও নিশ্চয় দেখবেন। তা ছাড়া স্টেম সেল প্রতিস্থাপন অতি ব্যয়বহুল। ভারতের মতো দেশে তা কী ভাবে সাধারণের নাগালে আনা যাবে সেটাও দেখা দরকার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

AIDS HIV London
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE