’৭৮-এর সেই বড় ম্যাচ অবশেষে শুরু। রেফারির সঙ্গে সুরজিৎ-প্রসূন
তো ওই ঘটনার আশপাশে আমার একটা সাংবাদিক সম্মেলন। আর তার তিরিশ বছরেরও পর দু’হাজারের গোড়ায় আমি যখন বড় ক্লাব বা ইন্ডিয়া টিমে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলামটিলাম, তখন আর একবার। ওই সময় কোচ হিসেবে আমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল। দু’টো সাংবাদিক সম্মেলনেই আরতি এক্স ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দিয়েছিল আমার জীবনে।
দু’টো প্রেসমিটই মনে হয় প্রেস ক্লাবে। প্রথমবার আরতি বলল, তুমি আজ একা যেও না। আমি সঙ্গে যাব। আজ মনে হচ্ছে, তোমার দিকে গোলাগুলি ছুটবে মিডিয়া থেকে। কিন্তু জানো তো, আমি কোনও অবস্থায়ই তোমাকে ডিফিটেড দেখতে চাই না!
আর পরেরটায় আরতি তখন যথেষ্ট অসুস্থ। আমার বড় মেয়ে সে দিনই ট্রেনে করে (এখন মনে নেই ঠিক কোথা থেকে যেন) কলকাতা ফিরছে। আরতি আমাকে না জানিয়ে পলাকে ট্রেনে মোবাইলে ধরে বলে দিয়েছিল, তুই সোজা স্টেশন থেকে প্রেস ক্লাবে চলে যাবি বাবার প্রেস কনফারেন্সে। আমার শরীর ভাল থাকলে আমিই যেতাম। পারব না বলে তোকে বলছি। কিছুতেই ও যেন একা মিডিয়াকে আজ মিট না করে। সে দিনও সাংবাদিকদের আমাকে কড়া-কড়া প্রশ্ন করার সম্ভাবনা ছিল।
দুটো ক্ষেত্রেই কেন জানি না, যতটা ভাবা গিয়েছিল আমাকে ততটা মিডিয়ার আক্রমণের সামনে পড়তে হয়নি। এটাও তো এক্স ফ্যাক্টর।
যে কোনও পেশাতেই সফল মানুষের জীবনে এক্স ফ্যাক্টরের একটা অবদান থাকে। সেটা তার স্ত্রী হতে পারে। পরিবার হতে পারে। তাবিজ-আংটি-মালাটালা হতে পারে।
তবে এখানে একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই। খেলোয়াড় কিংবা কোচ— কোনও অবস্থাতেই আমি কোনও দিন তুকতাকের আশ্রয় নিইনি। নিজের টিমের ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে গোপনে মাঠে প্রসাদী ফুল রেখে আসিনি কোনও বিশেষ গোলপোস্টের ধারে বা কোনও বিশেষ সাইডে!
তবে হ্যা।ঁ ঈশ্বরের কাছে মানত করেছি দু’-একবার। পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের সামনে যখন টানা ছ’বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিরল রেকর্ড গড়ার সুযোগ, টিমের কোচ হিসেবে মানত করেছিলাম দল রেকর্ড করলে ঠাকুরের সামনে নিজের বুক চিরে রক্ত দেব। সে বার লিগের পর তারকেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে ঠিক সেটা করেওছিলাম।
আবার পরের বছর যখন মোহনবাগানের দায়িত্ব নিলাম, আমার নতুন টিম লিগ জেতার পর আরতি বলল, তোমার কাছে তো সব ধর্ম সমান। তা হলে ইস্টবেঙ্গলে রেকর্ড গড়ার পর যেমন নিজের বুক চিরে মন্দিরে রক্ত দিয়েছিলে, তেমনি মোহনবাগানকে প্রথমবারই লিগ জিতিয়ে কেন সে রকমটা করবে না? সে জন্য ছিয়াত্তরে লিগের পরেও আমি তারকেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে নিজের বুক চিরে রক্ত দিয়েছিলাম।
তবে বিশ্বাস করুন, এগুলোর সঙ্গে কোনও তুকতাকের সম্পর্ক নেই।
বরং আটাত্তরে লিগের বড় ম্যাচে ইডেনে আগে ইস্টবেঙ্গল টিম ঢুকবে, না কি মোহনবাগান আগে ঢুকবে— তা নিয়ে আধঘণ্টারও বেশি ড্রেসিংরুমে দু’দলে কাজিয়া চলার পিছনে আমি যত না তুকতাক, তার চেয়ে ঢের বেশি মনস্তাত্ত্বিক অ্যাডভান্টেজের কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। এখনও পাচ্ছি প্রসঙ্গটা বলতে বসে।
সে বার ওই বড় ম্যাচের আগে লিগ টেবিলে আমার মোহনবাগান আগে ছিল ইস্টবেঙ্গলের থেকে। মোহনবাগানের সে মরসুমে ক্যাপ্টেন প্রসূন। ইস্টবেঙ্গলের সুরজিৎ। মাঠের বাইরে দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অথচ সে দিন নিজেদের দলের আগে-পরে মাঠে নামা নিয়ে ওদের দু’জনের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি মতভেদ ঘটেছিল।
আমাদের যুক্তি ছিল সে দিন—যে-হেতু পয়েন্ট টেবিলে আমরা মানে মোহনবাগান ওই মুহূর্তে আগে, সে জন্য আমাদের দল মাঠে পরে নামার সুযোগ পাক।
আসলে যে ম্যাচে মনস্তাত্ত্বিক ফ্যাক্টরটা খুব বেশি, সে রকম ম্যাচে বিপক্ষের পরে নিজের দলের মাঠে নামা মানে তোমার হাজার হাজার সমর্থকদের শব্দব্রহ্ম সহ্য করতে হবে অপোনেন্টকে। অথচ তোমার বিপক্ষ আগে মাঠে নামায় গ্যালারিতে তাদের বিশাল সমর্থক বাহিনীর চিলচিৎকার তোমাকে আর মাঠের ভেতরে থেকে সহ্য করতে হল না। তুমি তো পরে নামায় সেই সময় ড্রেসিংরুমের ভেতর কাটাচ্ছ!
ইস্ট-মোহনের মতো কঠিন যুদ্ধ শুরুর কয়েক মিনিট মাত্র আগে এ রকম কিছু ব্যাপারস্যাপার অবশ্যই দলের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ভাবে প্রভাব ফেলে। একটু হলেও ফেলে।
সে দিন কিন্তু মোহনবাগান শেষমেশ মাঠে ইস্টবেঙ্গলের পরে নেমেছিল আর শ্যাম থাপার সেই দুর্দান্ত ব্যাকভলি গোলে বড় ম্যাচ জিতেওছিল। মজার ব্যাপার, তার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ফুটবলে নিয়ম হয়ে যায়, দু’টো দলই একসঙ্গে রেফারি-লাইন্সম্যানকে সামনে রেখে মাঠে নামবে।
আবার অনেক ম্যাচে এক জন ফুটবলারকে নামাব একেবারে ঠিক করে ফেলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে অন্য প্লেয়ার নামিয়েছি। তাতে ক্লাবকর্তারা গজগজ করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দিনের শেষে দেখা গিয়েছে, আমার সেই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনই ম্যাচের নায়ক!
পিন্টুকে (সমরেশ চৌধুরী) শেষ মুহূর্তে বসিয়ে মোহন সিংহকে নামিয়েছি। মোহনই ইস্টবেঙ্গলের উইনিং গোল করেছে সেই ম্যাচে!
সুব্রত ভট্টাচার্যকে কত ম্যাচে যে শেষের দিকে স্টপার থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ডে তুলে এনে মোহনবাগানে গোল পেয়েছি!
কৃশানুকে গুরুত্বপূর্ণ মহমেডান ম্যাচে প্রথম দলে না রেখে এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় হাফটাইমের পরে নামিয়ে ওর প্রথম তিনটে পাস থেকেই দু’টো গোল তুলে নিয়েছি ইস্টবেঙ্গলে।
আরারাত ম্যাচে সবাইকে অবাক করে বিদেশকে পরে নামিয়ে শিল্ড ফাইনালে প্রচণ্ড শক্তিশালী রাশিয়ান টিমের সঙ্গে মোহনবাগানকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন করেছি।
এমনকী এশিয়াডে চন্দ্রেশ্বর প্রসাদকে বসিয়ে সুধীরকে অনভ্যস্ত স্টপারে খেলিয়ে ব্রোঞ্জ-ম্যাচ জিতেছি জাপানের বিরুদ্ধে।
কিন্তু সবগুলোর পিছনেই যে একশো ভাগ ফুটবলীয় চিন্তাভাবনা ছিল আমার, সত্যি বলতে কী দাবি করব না আজ। সেটা মিথ্যে বলা হবে। বরং কোথাও নিজের একটা ‘গাট ফিলিং’ হয়েছে। যার কোনও কারণ অথবা ব্যাখ্যা সে দিন খুঁজে পাইনি। আজও পাই না। এক্স ফ্যাক্টর!
তবে আমার কোচিং জীবনে আরতি-ফ্যাক্টর বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক্স ফ্যাক্টর।
কত-কত বছর ধরে যে নিঃশব্দে আমার জয়-রথের সারথি ছিল ও!
কত বার যে সকালের প্র্যাকটিসের পর পনেরো-ষোলো জন ফুটবলার নিয়ে সটান বাড়িতে এসে আরতিকে অর্ডার করেছি, সবাই লাঞ্চ করব। রান্না করো। কিংবা হঠাৎ করে কোনও সন্ধেয় আমার টিমের দশ-বারো জন প্লেয়ার বাড়িতে এসে আব্দার জুড়েছে— বৌদি, আজ ডিনার করে ফিরব কিন্তু! প্রতিবার আরতি এক-দেড় ঘণ্টার ভেতর লাঞ্চ বা ডিনার টেবিল রেডি করে আমাদের খেতে ডাকত।