‘ভাগ্যচক্র’ ছায়াছবির রেকর্ডিং-এ আরতি মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পাশে উৎপলা, সতীনাথ।
নইলে রেডিয়োয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গিটার শোনামাত্র কী দায় পড়েছিল উৎপলার খুঁজেপেতে তাঁকে এইচএমভি-তে নিয়ে যাওয়ার। সেই তো সুনীলের রেকর্ডিং-এর শুরু।
চল্লিশের দশক। হুগলি মহসিন কলেজে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। গোলকিপিং করছে যে ছেলেটি, সে মাঝে মাঝেই গুন গুন করে গান গায়। উপস্থিত দর্শক সতীনাথের কানে গেল। খেলা শেষে ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে ভাল গান শেখার পরামর্শ দিলেন। সে দিনের সেই গোলকিপার, পরবর্তী কালের শ্যামল মিত্র।
শোনা যায়, বাংলা-হিন্দি গানের এক কিংবদন্তি এক সময় বিপাকে পড়ে অর্থাভাবে অদ্ভুত উপায়ে রোজগার করতেন। ধনী মানুষ, যাঁদের রাতে ঘুম আসে না, তাঁদের তিনি বাড়ি গিয়ে গিয়ে গান শোনাতেন। বিনিময়ে কিছু অর্থ পেতেন। উৎপলা সেন জানতে পেরে তাঁরও পাশে দাঁড়ান।
নিউ থিয়েটার্সে এক সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইবার সুযোগ পেতেন না। অভিযোগ ছিল, তাঁর গলা পঙ্কজ মল্লিকের মতো। স্বভাবতই তার জেরে বেকায়দায় পড়েন তিনি। উৎপলার জন্যই আবার তাঁর ওখানে গাওয়ার সুযোগ ঘটে।
গান তো ছিলই, গানের বাইরেও ওঁদের প্রতি অন্যদের কোথাও একটা আলাদা সম্ভ্রমবোধ কাজ করত।
সতীনাথের সুরে ‘এ বার তা হলে আমি যাই’ গানটি তুলতে বসে মহম্মদ রফি সুরকারকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার আসল জায়গা হল বম্বে, এখানেই চলে আসুন।’’
ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গাইতে এসে কিশোরকুমার উৎপলা সেনের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে বলেন, ‘‘দিদি, আপনার ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’ গানটা আমার পার্সোনাল লাইব্রেরির কালেকশনে আছে।’’
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে উৎপলা সেনকে ফোন করে উত্তমকুমার বলতেন, ‘‘প্লিজ একবার তোমার ‘আমি তোমায় ছাড়া আর কিছু হায় ভাবতে পারি না’ গানটা একটু শোনাবে?’’
এ ধরনের উচ্চারণ কি নিছকই গানের জন্য?
গীতা দত্তর কথা বলা যাক। তখন উৎপলা থাকেন ২ নম্বর কেয়াতলা রোডের বাড়িতে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে জলসা আয়োজন করতেন তিনি। কে না আসতেন সেখানে! ক্লাবের সদস্যরা সে বার বললেন, ‘‘গীতা দত্তকে বলে দেখুন না, যদি আসেন।’’
গীতা দত্ত তখন সুপারহিট। তাঁকে দেবার মতো টাকা কোথায়! উৎপলা ফোনে ধরলেন। বললেন, ‘‘আমরা তো টাকাপয়সা তোমায় দিতে পারব না, প্লেন ভাড়াটা দিতে পারি।’’ ও পাশ থেকে উত্তর এল, ‘‘তুমি বলছ যেতে, তোমার কাছ থেকে প্লেন ফেয়ার নেব? কী বলছ!’’ ষষ্ঠীর দিন কলকাতায় চলে এসেছিলেন গীতা দত্ত।
গুরু দত্ত যখন মারা যান, খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন গীতা দত্ত। তখন বারবার দেখা করতে চাইতেন সতীনাথের সঙ্গে। গীতা দত্তর ভাই কানু রায় তাঁকে নিয়ে যান নার্সিংহোমে। সতীনাথ তখন বেনিয়ান কাটের শেরওয়ানি পরতেন। ঘরে ঢুকতে অসুস্থ শরীরে চমকে উঠে বসেন গীতা দত্ত। সতীনাথকে নাকি হুবহু গুরু দত্তর মতো লেগেছিল ওঁর!
লতা মঙ্গেশকর। সতীনাথের সুরে তাঁর প্রথম বাংলা আধুনিক ‘কত নিশি গেছে নিদ হারা’ আর ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ এক বার শুনেই তাঁর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সম্পর্কে গাঢ়ত্বের শুরু বোধ হয় তখনই। সে-নৈকট্য কোথায় পৌঁছয়, বোঝাতে একটা ঘটনা বলাই যথেষ্ট।
ভূপেন হাজরিকার সুরে ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবির ‘আবার নতুন সকাল হবে’ গানের রেকর্ডিং। উৎপলা গেলেন বম্বে। লতা মঙ্গেশকর ওঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন জুহু বিচে। গল্প, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সব হল।
হঠাৎ রেকর্ডিং-এর আগের রাতে খুব জ্বর উৎপলার। গলা বসে গিয়েছিল। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট মিনু কাতরাক বললেন, ‘‘উৎপলাদি, আপনি ফিসফিস করে গান। আমি ঠিক টেক করে নেব।’’ তখন ওখানে যা মেশিনপত্তর, কথাটা নিশ্চয়ই ‘স্তোক’ ছিল না। বিশেষ করে ওঁর মতো নামী রেকর্ডিস্টের কাছে। লতা মঙ্গেশকর তা সত্ত্বেও ঠায় বসেছিলেন স্টুডিয়োয়। উৎপলার শরীর খারাপ না!
সে বার অসুস্থ উৎপলাকে মুম্বই থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে এসকর্ট করে এসেছিলেন মালা সিনহা।
মালার সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক বহুকালের। সতীনাথ যখন ১এ, একডালিয়া প্লেসে থাকতেন, তখন মালা সিনহার বাবা অ্যালবার্ট সিনহা মেয়েকে নিয়ে টানা দু’তিন বছর গান শেখাতে সেখানে আনতেন।
তবে উৎপলা-সতীনাথের ভাগ্যে এক এক সময় যা জুটেছে, তেমনটা বোধ হয় ওঁদের প্রাপ্য ছিল না।
’৪২ সালে সতীনাথ প্রথম রেকর্ড করলেন নজরুলগীতির।— ‘ভুল করে যদি ভাল বেসে থাকি’। তুমুল সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু পরের গানের রেকর্ড ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘এ জীবনে যেন আজ কিছু ভাল লাগে না’ যখন বেরোল, তত দিনে পেরিয়ে গেছে দশটি বছর! বলা হত, ‘ওঁর তো পাতলা গলা। তালাত মামুদকে নকল করে।’
‘সপ্তপদী’-তে গান গাওয়ার অনুরোধ করলেন সুচিত্রা সেন।— ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। এক বিখ্যাত গীতিকার ভুল বোঝালেন উৎপলাকে, ‘‘আরে, এ গান তুমি গাইবে কেন? এ তো শুধু লা-লা-লা করে সুর।’’ গাওয়া হল না।
একটি রেকর্ড কোম্পানিতে কোনও এক জন শিল্পীকে রেকর্ড করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবাদে সে কোম্পানিই ছেড়ে দিলেন উৎপলা-সতীনাথ দু’জনেই। পরে দেখলেন, যাঁর জন্য কোম্পানি ছাড়লেন, তিনি রয়ে গেলেন বহাল তবিয়তে।
রেডিয়ো স্টেশনে গাইবার জন্য সতীনাথের মতো শিল্পীকে বারো বার অডিশন দিতে হয়। এগারো বার কৃতকার্য না হয়ে সোজা চলে যান স্টেশন ডিরেক্টর অশোক সেনের কাছে। এর পর স্টেশন ডিরেক্টর নিজে কারণ-অনুসন্ধান করতে নামেন। তখন ছাড়পত্র মেলে সতীনাথের।
’৯১ সাল। উৎপলার ইন্টেস্টিনাল ভলভুলাস ধরা পড়ল। জটিল রোগ। অপারেশন হল। ওই সময় থেকেই খুব দুশ্চিন্তা করতেন সতীনাথ। কী যে হল তাঁর প্রাণভোমরা রোশনির!
সম্পর্ক তো এক-আধ বছরের নয়, উৎপলা যখন বেণু সেনের ঘরণি, তখন থেকে। তিন জনের বন্ধুতা, হৃদ্যতা কখনও যে টাল খায়নি একটি বারের জন্যও।
১৯৬৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেণু সেনের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর মায়েরই উদ্যোগে সতীনাথ বিয়ে করেন উৎপলাকে। তার পর জীবন চলেছে নানা বাঁক পেরিয়ে। হঠাৎ একটা অঘোষিত টাইফুন কোত্থেকে ধেয়ে এসে সব যেন উপড়ে ফেলে দিল।
হার্টের সমস্যা দেখা দিল সতীনাথের। তবু কাউকে বুঝতে দিতেন না শরীরের কষ্ট। নিজে নিজেই ওষুধ খেতেন। বুকে অসহ্য ব্যথা নিয়ে ভর্তি হলেন পিজি-তে। আর বাড়ি ফেরা হল না। ১৯৯২-এর ১৩ ডিসেম্বর ওঁর চলে যাওয়ার পর খাটের জাজিম তুলে বাড়ির লোকজন পেয়েছিলেন গুচ্ছ গুচ্ছ সরবিট্রেটের খালি কৌটো!
২০০০ সালে কোলন ক্যানসার হল উৎপলার। আবার অপারেশন। বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু দিনে দিনে বন্দি হয়ে পড়লেন বিছানায়। তবু শুয়ে শুয়েই ঘরকন্নার তদারকি করতেন। আর শেষের বছরটা জড়িয়ে বাঁচতেন সদ্যোজাত নাতিকে নিয়ে। নামও রাখলেন নিজেই— সূর্য। ওই অতটুকু শিশুর কানে সুর ঢেলে দিতেন যখনতখন! আর শিশুর মা পারমিতাকে বলতেন, ‘‘বল তো, ও ক’বে হাঁটতে পারবে? আমি দেখে যেতে পারব?’’
২০০৫-এ হাসপাতালে কোমার মধ্যেই চলে গেলেন উৎপলা সেন।
আর কী অদ্ভুত, বেণু সেন আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার দিনটির মতো সে দিনও ছিল ১৩ তারিখ!
পরপারেও কী আশ্চর্য বাঁধনে জড়িয়ে রইলেন ওঁরা তিন জন!
লখনউ, চুঁচুড়া, কলকাতা
|
ঠাকুরদা নাতির গান বন্ধ করতে শর্ত দিয়েছিলেন, প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। তাই-ই হতেন সতীনাথ। এক বার শুধু পারেননি। সে বছর আর গান শেখা হয়নি। এমনিতে বাড়িতে গানবাজনা বলতে, ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন। বাবা তারকচন্দ্র গান গাইতেন। তবে কেউই প্রফেশনাল ছিলেন না। এঁরা দু’জনেই চাইতেন, মেধাবী ছাত্র সতীনাথ মন দিয়ে পড়াশুনোটাই করুক। এ দিকে ছোট্ট সতীনাথের গানের এমনই নেশা যে উপনয়নে পাওয়া টাকায় লখনউ থেকে তানপুরা কিনে আনল ট্রেনে করে। তা’ও কী, সারা রাত বাজনা আগলে টান টান জেগে বসে। যদি ভেঙে যায়! বাপ-ঠাকুরদার কাজের সূত্রে লখনউতে জন্ম হলেও ছেলেবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। বিএ পাশ করেন ডিস্টিংশনে। এর পর বাড়ির চাপ এমএ পড়ার। পড়তে হবে কলকাতায়। তত দিনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা ওঁকে বুঁদ করে ফেলেছে। নামেই কলকাতা এলেন পড়তে। পড়া শিকেয় তুলে ছুটতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। এ দিকে বাড়ির লোক জানে, ছেলে এমএ পড়ছে। তালিম নিতে নিতে এক-এক দিন এত রাত হয়ে যেত, হাওড়ার স্টেশনেই থাকতে হত। শেষে ধরা পড়ে গেলেন বাড়িতে। চাকরি নিতে হল এজি বেঙ্গলে।
|
হিরণবালা, মা আনন্দময়ী, উৎপলা
|
গুরুজির সাধের গুচ্ছ বেড়ালের জন্য মাগুর মাছ রেঁধে দিতেন। চুল আঁচড়ে তাদের টিপ পরাতেন। তত ক্ষণে হয়তো গুরুজির দিবানিদ্রা হয়ে যেত। ছাত্রী উৎপলা অপেক্ষা করত। জানত মুড না এলে গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তী গান শেখাতে পারেন না। ঢাকার মেয়ে উৎপলার বাবা রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার ঘোষ গানবাজনা জানতেন না। তবে মা হিরণবালা হারমোনিয়াম তো বাজাতেনই, বাঁশি, এসরাজ, সেতার খঞ্জনিও বাজাতে পারতেন। মায়ের কাছেই গান শেখার শুরু উৎপলার। তারপর তো অনেক শিক্ষাগুরু। এমনকী আনন্দময়ী মায়ের কাছেও গান শিখেছেন। অল্প বয়েস থেকে ঢাকা রেডিয়োয় নানা ধরনের গান গাইতেন। এমনকী কবিতা পাঠ, নাটকও। রায়বাহাদুর বাবার এ সব সহ্য হত না। কিন্তু যে দিন দেখেন কলকাতার এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে ছবি সমেত মেয়ের গানের প্রশংসা বেরিয়েছে, সে দিন বোধহয় তাঁর মন ঘোরে।
|
তথ্য সহায়তা: পারমিতা সেন ও আশিস সেন