নগরসজ্জা: ‘ক্যারিকেচার অফ আ সিটি অ্যান্ড আদার ইমেজেস’ প্রদর্শনীতে শিল্পী সুমন চৌধুরীর কাজ। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে
কলকাতার বাস্তব রূপটি দেখেছেন দীর্ঘ কাল। কল্লোলিনী তিলোত্তমার এক অদ্ভুত ধ্বংসপ্রায় ভাঙাচোরা সৌন্দর্যের মধ্যেও তাঁর আশ্চর্য অন্বেষণ ছিল এই শহরকে দ্বিমাত্রিকতার সাদা পটে ফেলে পোস্টমর্টেম করে— শেষে তুলে আনা রং-রেখার দুর্নিবার ক্যারিকেচার। ‘স্মৃতির শহর’-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবেই জানিয়েছেন, ‘আমরা যারা এই শহরে হুড়মুড় করে বেড়ে উঠেছি/আমরা যারা ইট চাপা হলুদ ঘাসের মতোন/ একদিন ইট ঠেলে মাথা তুলেছি আকাশের দিকে...’’ তিলোত্তমা এ শহরের প্রতি মুহূর্তের বদলে যাওয়া, সংকুচিত হয়ে আসা, কুঁকড়ে যাওয়া এক কালো অন্ধকারের দিকে চলে যাওয়া সেই সব সরকারি কোয়ার্টার, পুরনো বাড়ির আহামরি স্থাপত্যের ধ্বংসাত্মক শরীর, লক্ষাধিক কেব্ল লাইনের সমূহ অত্যাচার... এমন আরও অনেক কিছু নিয়েই সুমন চৌধুরীর প্রদর্শনী ‘ক্যারিকেচার অফ আ সিটি অ্যান্ড আদার ইমেজেস’ শেষ হল অ্যাকাডেমিতে।
কালি, তুলি, পেন, জল রং, সাদা রেখা ও সামান্য মিশ্র মাধ্যমে শহরের সুন্দরী শরীর কী ভাবে নষ্ট হয়েছে, তা স্পষ্ট দেখিয়েছেন। প্রতিটি কাজেই লক্ষ করা যায়— শহরটা যেন কোথাও কোথাও বেঁকেচুরে একটা ফর্মে চলে যাচ্ছে, যেখানে এ পার ও পার জুড়ে লক্ষাধিক কেব্ল ও বিদ্যুৎবাহী তার স্থাপত্যের শেষ সৌন্দর্যকেও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে, সে এক ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। আর এ তারেরই অ-বিপজ্জনক অংশে আবার অজস্র কাকের মজলিস চলে সারা দিন!
এই শহরে মানুষের শেষ আশ্রয়টুকুও আর আকাশের দেখা পাচ্ছে না। ঘাড়ের উপরেই আরও ঘরবাড়ি, যেন প্রোমোটার-রাজের পাল্লায় পড়া এ শহর নাড়ির স্পন্দনও হারিয়ে ফেলেছে। নগরসজ্জা-উত্তর পর্বের এ এক নির্লজ্জ উদাহরণ!
অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে শিল্পী সুমন চৌধুরীর কাজ।
কোথাও রং ঘষে, আপাত-হালকা অংশে সাদা বা কালো রেখায় সেই সব ঘুপচি ঘরদোরের, জানালার, অসংখ্য তারের অত্যাচারিত অবস্থাকে যে ভাবে উপস্থাপনা করেছেন, মনে পড়ে দীনেশ দাসের ‘ডাস্টবিন’। ‘আজ যে পথে আবর্জনার স্বৈরিতা/ মহাপ্রভু! বণিক প্রভু! সবই তোমার তৈরি তা।/ দেখছি বসে দূরবিনে/ তোমায় শেষে আসতে হবে তোমার গড়া ডাস্টবিনে’। এ লেখা পড়ে নিশ্চিত সুমন ছবি আঁকেননি। বরং কলকাতার ধ্বস্ত চেহারাখানাই ধরতে চেয়েছেন তিনি। কারখানার ধোঁয়া-জর্জরিত দূষণ-সহ!
কুমিরের মতো হাঁ করে গিলে খেতে আসা শহরের এমন কম্পোজ়িশনের মধ্যে সুমন দেখিয়েছেন বাড়িঘরের বর্তমান দুর্দশাগ্রস্ত দিক। কোথায় মানুষ? কোথায় দূষণহীন স্বস্তিকর পরিবেশ? শিশু-কিশোরের খেলার মাঠ উধাও। এক চিলতে জমি লোপাট। ইট-কাঠ, লোহা-লক্কড়, কংক্রিট-পাথরের উপরে উঠে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। ছোট হয়ে আসা কলকাতার কোথাও আগুন লাগলে অনিবার্য মৃত্যু! কালো ধোঁয়ায় পরিসরহীন এই ভয়ংকর শহর আমার নয়! সুমন এ ভাবনাতেই জটিল শহরের ছবি এঁকেছেন। অসাধারণ। অনেক প্রতীকের মাধ্যমে কলকাতার যন্ত্রণাময় বিষবিদ্ধ চিত্র ছাড়াও আরও ছবি ছিল প্রদর্শনীর আকর্ষণ।
কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে যেমন তাঁর কালি, কলম, তুলির ক্ষিপ্র গতি, তেমনই কোমল রেখাঙ্কনে ও নম্র টানটোনে এঁকেছেন শান্তিনিকেতনী নিসর্গ। ছোট আকারের গাছপালা, জলা, জমি, মেঘ নেমে আসা অন্ধকার ও তাতে শুকনো ডালপালা মেলা গাছ মিলেমিশে এত ছায়াময়! উজ্জ্বল দিনের ছবিও অনেক। তারের জটিল ডিজ়াইনের উপরে বসা অজস্র একাকী কাক। এমনকি কালি-তুলির অনবদ্য ড্রয়িংয়ে একাকী বকেরও বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি! তেমনই দ্রুত ব্রাশিংয়ে একরঙা মানুষের দাঁড়ানোর ভঙ্গি আর একগুচ্ছ বেড়াল— যারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে, রাজকীয় ভাবে পটের মধ্যিখানে বিরাজ করছে!
চিত্রকর হিসেবে ওঁর ব্যঙ্গচিত্র বা সচিত্রকরণ দেখার মতো। কিন্তু শিল্পী হিসেবে যখন অন্য ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তিনি, ঠিক তখনই আগের পরিচ্ছদ খুলে রেখে নিজেকে প্রদর্শিত করেছেন পৃথক ভাবে। যেখানে সচিত্রকরণ নয়, তাঁর ছোট ছোট ড্রয়িংগুলিকে বিষয় হিসেবে দেখিয়েছেন। ওঁর সবাক কালিকলমের দক্ষতা তাই প্রশ্নাতীত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy