Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Art exhibition

শ্রদ্ধাঞ্জলির ৫১টি চিত্র-ভাস্কর্য

দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০টি এচিংয়ের সবই ডিজিটাল প্রিন্ট। তাঁর প্রিয় বিষয় তন্ত্রের বিভিন্ন রকম প্রতীকী তাৎপর্য ও সাঙ্কেতিক অনুষঙ্গের ব্যবহার ছাপচিত্রকে মহার্ঘ করেছে।

ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ: অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রদর্শনী।

ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ: অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রদর্শনী।

অতনু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২২ ০৭:২৯
Share: Save:

সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস-এর চার জন প্রয়াত শিল্পী-ভাস্করের সৃষ্টি নিয়ে বিড়লা অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’র প্রদর্শনীটি ছিল মুগ্ধতায় আলাদা রকম। সুনীলকুমার দাস, সুকান্ত বসু, দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক তালুকদারের মোট ৫১টি কাজ ছিল।

সুকান্ত বসু নিসর্গের ৭টি অতি আধুনিক ঝোড়ো আবহের ছবি এঁকেছেন অ্যাক্রিলিকে ক্যানভাসে। বর্ণের ঔজ্জ্বল্যকে রেখে আবার অন্য বর্ণের ঘনত্বের সঙ্গে মানানসই করে বহু বা একক বর্ণের মিশ্রণে তাঁর ওই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ প্রকৃতির পেন্টিং কোয়ালিটি মুগ্ধ করে। ব্রাশিংয়ের দ্রুততায় ক্যানভাসে ঝড় তোলা স্টাইল, কখনও স্প্যাচুলার সঙ্গে যুগলবন্দি হয়ে একটা আশ্চর্য মেলোডি আন্দোলনের রূপ পায়। কোথাও হঠাৎ তৈরি হওয়া রূপবন্ধের আভাস যেন ছবির পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট। তাঁর এই ধরনের ইয়োরোপীয় ছবির ধাঁচ কোথাও যেন সূক্ষ্ম ভাবে ইম্প্রেশনিস্ট। এমনকি এক্সপ্রেশনিজ়মকেও মনে পড়ায়। ঔজ্জ্বল্য ও ঘনান্ধকারের গাঢ়ত্ব, কখনও আপাতধূসর আবহ ছবিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। আকাশ ও দিগন্তবিস্তৃত নীলিমায় যেন ভয়ঙ্কর ভাঙচুর! রং ও ব্রাশিংয়ের মারাত্মক অভিঘাত ক্যানভাসে এত দুরন্ত বিমূর্ততা তৈরি করেছে যে, যতটুকু স্পেস তৈরি হয়েছে, তার নৈঃশব্দ্য ও কোলাহলমুখরতার মধ্যেও আরও এক দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্পেস ছবিকে নিয়ে যাচ্ছে দিকচিহ্নহীন দূরত্বে কিংবা এনে দিচ্ছে খুব কাছে। এই অনুভূতিই তাঁর পেন্টিংয়ের অন্যতম গুণ।

দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০টি এচিংয়ের সবই ডিজিটাল প্রিন্ট। তাঁর প্রিয় বিষয় তন্ত্রের বিভিন্ন রকম প্রতীকী তাৎপর্য ও সাঙ্কেতিক অনুষঙ্গের ব্যবহার ছাপচিত্রকে মহার্ঘ করেছে। একটা সীমাবদ্ধ স্পেস তৈরি করে উল্লম্ব, আনুভূমিক ও সরলরেখার সমন্বয়ে কম্পোজ়িশনটিকে আবদ্ধ রাখেন। প্রধান লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে রূপবন্ধ ও সাঙ্কেতিক, প্রতীক চিহ্নের বিভিন্ন অনুষঙ্গময় রূপের। ছাপচিত্রের টেকনিক বিন্যস্ত হয়। টেক্সচার কেন্দ্রিক ও গভীর ডিজ়াইন আলাদা সাংগঠনিক সংযোজনে ভারসাম্যের অবস্থাটিকে প্রখর বাস্তবতায় উন্নীত করে। তন্ত্রের ধর্মীয় অনুশাসন মানা রূপ ও চিহ্ন, সিম্বল, বিভিন্ন বর্ণের বিভাজনে এক-একটি আলাদা টুকরো হয়েও গোটা রচনার সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায়। দেবদেবী ও তাঁদের পদচিহ্নের ব্যবহারও আছে ছবিতে। তন্ত্র থেকে সরে এসে কখনও তিনি কিছু বিমূর্ত রচনায় রূপবন্ধগুলিকে প্রখর চৈতন্যবোধে বিবর্তিত করে, কম্পোজ়িশনের মধ্যে প্রতীকায়িত করেন। এই নিষ্ঠা ও নিখুঁত পর্যবেক্ষণ চিত্রের নিরীক্ষামূলক নিবিড় অনুসন্ধানকে উজ্জীবিত করে। বর্তুল, ত্রিভুজাকৃতি, আয়তাকার, বর্গক্ষেত্রীয় ও কৌণিক রেখান্বিত রূপ, সলিড ফর্ম ও রেখা-বিভাজিত জায়গাগুলিকে বেঁধে রাখে ওই প্রতীক ও তন্ত্র-সমন্বিত চিহ্নগুলি।

চিত্র প্রদর্শনী।

চিত্র প্রদর্শনী।

ভাস্কর্যে ছন্দোময় মুহূর্তকেই প্রাধান্য দিতেন মানিক তালুকদার। বেশির ভাগই উল্লম্ব নারীশরীরের রূপ ও তাকে জড়িয়ে থাকা পত্রপল্লবিত, পুষ্পশোভিত নকশা ও অন্যান্য অনুষঙ্গ। সে তাঁর বিমূর্ত ও রিয়েলিস্টিক যে কোনও কাজেই। তিনি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থেমে যান। ওই স্থানটি থেকেই তৈরি হয় কৌতূহল, মনে হয় যেন এখানেই আর একটু কাজ হত। আসলে ওই জায়গার অবস্থাটুকুই যেন ভাস্কর্যের মূল সুরটিকে প্রতিপন্ন করে। এই ছান্দসিকতা ১২টি ব্রোঞ্জ-উড-ফাইবার গ্লাসের কাজেই অনুভূত হয়। দু’-তিন ধরনের কাঠ, ভিন্ন বর্ণ ও টেক্সচারের মাধ্যমে মানিক অতি পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিনন্দন একটি মাত্রা এনেছেন। আলাদা এক শিল্পগুণ ওই মসৃণতা ও প্রয়োজনীয় রুক্ষতার মধ্যে প্রাণবন্ত হয়েছে। ডিজ়াইন-সর্বস্ব রূপ, ছন্দের অতি সরলীকরণের কাব্যিক আকার ভাস্কর্যগুলিকে মহিমান্বিত করেছে।

সুনীলকুমার দাস তাঁর ভাস্কর্যে মিডিয়ামের ক্যারেক্টার, মেটিরিয়াল ভ্যালুজ়, টেক্সচারাল কোয়ালিটি, ভলিউম, ওয়েট... এগুলি নিয়েই ভাবনাচিন্তা করতেন। মিশ্রমাধ্যম ছিল তাঁর পছন্দের। প্রদর্শনীতে ১২টির মধ্যে চারটি ব্রোঞ্জ, বাকিগুলি ব্রোঞ্জ-মার্বেল, ব্রোঞ্জ-আয়রন, ব্রোঞ্জ-উডের সমন্বয়। দু’টি বসে থাকা উট ছাড়া সবই লম্বা ধরনের কাজ। তাঁর ভাস্কর্যে কখনও একটি মেক্সিকান প্রত্ন-ভাস্কর্যের আভাস পাওয়া যায়। লোকায়ত শিল্পের অনুষঙ্গে মিশে যাওয়া আদিবাসী ঘরানার কোনও রূপের ঝলকও লক্ষ করা যায়। প্রয়োজনে তিনি রূপের অনেকটা অংশ স্ফীতকায় বা কিছুটা ভলিউম-সর্বস্ব ফর্মেশনে গড়েন, হঠাৎ সেখান থেকেই অন্য কোনও প্রত্যঙ্গ বা ফর্ম সমুন্নত গুণকে অক্ষুণ্ণ রেখে, চমৎকার ভাবে প্রকাশিত হয়। এই জায়গাগুলি লক্ষ করার মতো। তাঁর ভাস্কর্যের মানুষেরা অতি নীরব, নৈঃশব্দ্যের প্রতীক হয়েও খুবই বাঙ্ময়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Art exhibition Academy of Fine Arts
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE