Advertisement
E-Paper

ছবি লেখার কারিগর

বিদেশি পদ্ধতিতে আঁকা শিখে মন ভরেনি। মনেপ্রাণে ভারতীয় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলে সোসাইটি স্থাপন করে প্রাচ্যশিল্প তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে।বিদেশি পদ্ধতিতে আঁকা শিখে মন ভরেনি। মনেপ্রাণে ভারতীয় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলে সোসাইটি স্থাপন করে প্রাচ্যশিল্প তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে।

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২৮

রোগশয্যায় রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, উৎসব করে পালিত হোক অবনীন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জন্মদিন। সে দিন দেশের সকলে শিল্পগুরুকে সম্মান জানাক, এমনই ছিল আকাঙ্ক্ষা। তবে যাঁর জন্মদিন, গোল বাধল তাঁকে নিয়েই। দেশের লোক জন্মদিন পালন করবেন, কিন্তু তিনি যদি বেঁকে বসেন? সুতরাং পয়লা কাজ অনুমতি আদায়। উৎসবে অবনীন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি সম্পর্কে সকলেই অবগত, কাজেই প্রস্তাব নিয়ে এগোতে চাইলেন না কেউ। শেষে দু’-এক জন সাহসে ভর করে যেই কথা বলার জন্য সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন, প্রায় তেড়ে এলেন অবনীন্দ্রনাথ। স্পষ্ট কথা— ‘‘আগে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামো, তার পরে তোমাদের কথা শুনব।’’ অতঃপর শান্তিনিকেতন থেকে নন্দলাল বসুকে জোড়াসাঁকো পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ বারান্দায় কৌচে বসে কুটুম-কাটাম গড়ছেন, মুখে চুরুট। ততক্ষণে ওটা কিন্তু নিভে গিয়েছে। তবে কাজ করলে ওটা মুখেই ধরা থাকত। নন্দলাল অনেকটা দূরে নিচু মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন। অবনীন্দ্রনাথ চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁকে দেখেই মতলব বুঝলেন। ধরা পড়ে গিয়েছেন, বুঝলেন নন্দলালও। তাই মাথা তুলে তাকালেন, আবার মুখ নামিয়ে নিলেন। খানিক পরে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে গুরুকে প্রণাম জানিয়ে চলেই গেলেন। যাওয়ার সময়ে পাশে বসা রানী চন্দকে বললেন, ‘‘আমি পারব না বলতে, যা বলবার তুমিই বোলো।’’ নন্দলাল চলে যেতেই অবনীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘‘কিছু বলতেই দিলুম না নন্দলালকে!’’ রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে আয়োজনের ব্যাপারে খোঁজ নিলেন। রানী চন্দ বিপদটা জানালেন। সকালবেলা অবনীন্দ্রনাথ যখন রবিকা-কে দেখতে এলেন তখন শুরু হল ধমক— ‘‘তোমার এতে আপত্তির মানে কী? দেশের লোক যদি চায় কিছু করতে— তোমার তো তাতে হাত নেই কোনো।’’ অবনীন্দ্রনাথ মাথা চুলকে বললেন, ‘‘তা আদেশ যখন করছ— মালাচন্দন পরব, ফোঁটানাটা কাটব— আর কোথাও যেতে পারব না কিন্তু—’’ এই বলে প্রণাম করেই একদৌড়! পাছে আরও কিছু আদেশ আসে। রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘‘পাগলা বেগতিক দেখে পালালো।’’

আসলে বড় তেজি ছিলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ। এতটাই যে, বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথও তাঁর সামনে দাঁড়ানোর সাহস পেতেন না। এক দিন চৌরঙ্গির আর্ট স্কুলের বাড়িতে ছবি আঁকছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সকলে বিস্মিত হয়ে দেখছেন। অবনীন্দ্রনাথকে সে ছবি দেখানোর জন্য অনেক সাধ্যসাধনা করে নিয়ে এসেছেন গগনেন্দ্রনাথ। ছবি দেখেই ভাইয়ের হুঙ্কার— ‘‘এ কী এঁকেছ? এ কি ছবি হয়েছে?’’ কখনও হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচাও মারতেন ছবিতে। গগনেন্দ্রনাথও কম রাগী নন, তবে তখন কাঁচুমাচু। রানী চন্দ লিখছেন— ‘‘অবনীন্দ্রনাথকে খুব ভয় পেতাম আমি। শুধু আমি কেন, সকলেই তাঁকে খুব ভয় পায় দেখতাম।’’ কেবল রবিকা-র কাছেই বোধ হয় একটু জব্দ ছিলেন তিনি!

***

১২৭৮ সালের ২৩ শ্রাবণ ঠাকুরবাড়িতে জন্ম অবনীন্দ্রনাথের। বাড়ির রীতি অনুসারে তাঁর জন্য ছিল এক জন দাসী: পদ্মদাসী। তার কাছেই দুধ খাওয়া, খেলাধুলো, গান শুনতে শুনতে ঘুমোনো। তেজি ছেলেটা ছেলেবেলায় ছিল দুরন্ত। পদে পদে অপ্রস্তুত হত পদ্মদাসী। প্রবল শীতের দিনে জানালার শার্সি বন্ধ করার পরেও ঠান্ডা কমছে না দেখে তুলোর পর্দা ঝোলানোর বন্দোবস্ত হয়েছিল বাড়িতে। পাতলা ওয়াড়ে মোড়া শালুর লেপের ভিতর বাড়ির ছোটরা সকলে একসঙ্গে গুটিসুটি মেরে ঘুমোত। যদি একটু শীত কমে! সকালে সবাই লেপ ছেড়ে বেরোল। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথকে আর পাওয়া গেল না। ‘ছেলে কোথা গো’ বলে কান্না জুড়ল পদ্মদাসী। শোরগোলের মধ্যে অবশেষে আবিষ্কৃত হল, ওয়াড়ের ভিতর ঢুকে ঘুমোচ্ছেন তিনি। সারা গা তুলোয় মাখামাখি!

‘সেয়ানা’ হয়ে ওঠার পরে দাসীর কোল থেকে চলে যেতে হত চাকরের জিম্মায়। অন্দরমহল থেকে বাহিরমহল। অবনীন্দ্রনাথ গিয়ে পড়লেন রামলাল চাকরের কাছে। এ বার আর দুষ্টুমিটা সহজ হল না। অবনীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, ‘‘ছোটোকর্তা ছিলেন রামলালের সামনে মস্ত আদর্শ, কাজেই একালের মতো না ক’রে অনেকটা সেকেলে ছাঁচে ফেল্‌লো সে আমাকে— দ্বিতীয় এক ছোটোকর্তা করে তোলবার মতলবে। ছোটোকর্তা ছুরি-কাঁটাতে খেতেন, কাজেই আমাকেও রামলাল মাছের কাঁটাতে ভাতের মণ্ড গেঁথে খাইয়ে সাহেবি দস্তুরে পাকা করতে চল্‌লো; জাহাজে করে বিলেত যাওয়ার দরকার হ’তেও পারে, সেজন্যে সাধ্যমত রামলাল ইংরিজির তালিম দিতে লাগলো,— ইয়েস, নো, বেরি ওয়েল, টেক্ না টেক্— ইত্যাদি নানা মজার কথা।’’

অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত পেন্টিং ‘দ্য ট্র্যাভেলার অ্যান্ড দ্য লোটাস’

তবে দস্যিপনা কি আর বাগ মানে! এক দিন দেউড়ির দারোয়ান বুড়ো মনোহর সিংহের দাড়িতে হাত দিয়ে দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ব্যস, বেজায় বিপদ— বকাঝকা নয়, একেবারে হুঙ্কার। ভয়ের চোটে পলায়ন। তবে তাতেও লাভ হল না। মনোহর সিংহের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে তবে নিষ্কৃতি।

দুষ্টুমির ‘খ্যাতি’ ছড়িয়েছিল স্কুলেও। নর্মাল স্কুলে লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত নামে প্রচণ্ড রাগী এক ইংরেজির মাস্টার ছিলেন। তিনি ক্লাসে পড়াতে গিয়ে খাবারের নাম বললেন ‘পাডিং’। অবনীন্দ্রনাথ বলে বসলেন, ‘‘রোজ বাড়িতে পুডিং খাই, আমি জানি না!’’ মাস্টার ধমকালেন, ‘‘বল্, পাডিং।’’ ছাত্র আবার বলল, ‘‘না, ওটা পুডিং।’’ শাস্তি হিসেবে ছুটির পরে এক ঘণ্টা ‘কনফাইন’-এর নিদান হল। ‘পুডিং’ তবু ‘পাডিং’ হল না। টানাপাখার দড়িতে হাত বেঁধে পিঠে সপাসপ বেত। ফল মিলল না তা-ও। তবে ঠাকুরবাড়ি সেই তেজ বুঝেছিল। অবনীন্দ্রনাথকে স্কুলে যেতে বারণ করলেন বাবামশায় গুণেন্দ্রনাথ। নাম কাটা গেলে বাড়িতেই শুরু হল লেখাপড়া।

হয়তো ভালই হল, কারণ ছবি আঁকার হাতেখড়িও এই পর্বেই। ছোটবেলা থেকেই খুব ছবি দেখতে ভালবাসতেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর ছোটপিসিমার ঘরে ঝোলানো থাকত দেবদেবীর পট আর অয়েল পেন্টিং। অবাক হয়ে দেখতেন ‘শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ’, ‘শকুন্তলা’, ‘মদনভস্ম’, ‘কাদম্বরী’।

এক দিন সে রকম সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই আঁকতে শুরু করলেন। ছোট পিসেমশাই একখানা হাঁসের ছবি দিয়েছিলেন, সেটাই প্রথম কপি করলেন অবনীন্দ্রনাথ। পরে একটা ঘষা কাচের ট্রেসিং স্লেটও কিনে দিয়েছিলেন তিনি। আর গুণেন্দ্রনাথের টেবিলে সব সময়ই লাল-নীল পেনসিল পড়ে থাকত। সেই পেনসিল দিয়ে কিংবা হলুদ গুলে ছবি রং করার কাজ শুরু হল।

অবনীন্দ্রনাথের বয়স যখন নয় কি দশ, তখন কিছু দিনের জন্য সপরিবার এক বাগানবাড়িতে গেলেন তাঁরা। কলকাতা থেকে মাইল পনেরো দূরে গঙ্গার তীরে কোনও এক জায়গা। ফুল-ফলের গাছের সারি; চড়ে বেড়াত হরিণ, ময়ূর, বক। কারুকার্যখচিত আসবাবে সাজানো ঘরগুলি। এ সব দেখেই কাগজ-কলম-তুলি-পেনসিল নিয়ে বসে পড়লেন অবনীন্দ্রনাথ। কলসি কাঁখে মেয়েরা নদীর ঘাটে যাচ্ছে, রাখাল গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে, নদীর বুকে ভেসে যাচ্ছে পালতোলা নৌকো— দেখলেন আর আঁকলেন। আসলে, ছবি আঁকার আবহ তাঁর বাড়িতেই ছিল। গুণেন্দ্রনাথের আঁকার শখ ছিল। গগনেন্দ্রনাথ আঁকা শিখতেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। পোর্ট্রেট আঁকতেন কাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। হাতির দাঁতের কারুকাজে ঝোঁক ছিল দাদা সমরেন্দ্রনাথের।

অবনীন্দ্রনাথের প্রথাগত অঙ্কনশিক্ষার শুরু পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে, গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল গিলার্ডি সাহেবের বাড়িতেই তাঁর আঁকা শেখার ব্যবস্থা হল। প্রথমে লাইন ড্রয়িং, পরে প্যাস্টেল, তেলরঙের কাজ শিখলেন, শিখলেন প্রতিকৃতি অঙ্কনও— সবই বিদেশি পদ্ধতিতে। গিলার্ডি সাহেবের কাছে যখন আঁকা শিখছেন, সেই সময়েই কলকাতায় এলেন বিখ্যাত ইংরেজ আর্টিস্ট সিএল পামার। তাঁর কাছে জলরং আর তেলরঙের কাজ শিখলেন। তখন অবনীন্দ্রনাথ নাকি এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন যে, দু’ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আবক্ষ প্রতিকৃতি এঁকে ফেলতে পারতেন। দক্ষ শিল্পীকে পামার সাহেব এ বার অ্যানাটমি শেখাতে বসলেন। আঁকার জন্য এনে দিলেন একটা মড়ার খুলি! অবনীন্দ্রনাথের শরীর খারাপ লাগতে থাকল। সাহেব জানালেন, যা-ই হোক, আঁকতেই হবে। শিক্ষকের আদেশ অমান্য করলেন না। তবে বাড়ি ফিরে ধুম জ্বর এল। ১০৬ ডিগ্রি। বেশ কিছু দিন পামার সাহেবের বাড়ি যাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।

তবে এ সবই হল ইউরোপীয় শিল্প। এতে অবনীন্দ্রনাথের মন ভরেনি। অতৃপ্তির শূন্যস্থান পূরণের সুলুকসন্ধান মিলল প্রপিতামহ দ্বারকানাথের গ্রন্থশালায়। হাতে পেলেন মুঘল যুগের প্রাচীন চিত্রের পুঁথি। এর পরই তাঁর ভগ্নীপতি শেষেন্দু উপহার দিলেন এক পার্সি ছবির বই। সেখানে ছিল দিল্লির ইন্দ্রসভার অপূর্ব নকশা। আবার এ সময়েই ছোট দাদামশাই নগেন্দ্রনাথের বন্ধু মিসেস মার্টিনডেল পাঠিয়েছিলেন ‘ইলিউমিনেটেড’ কবিতার বই। বইয়ের পাতাকে নকশা দিয়ে সুন্দর করে তোলার অঙ্কনপদ্ধতিকে বলে ইলিউমিনেশন করা। অবনীন্দ্রনাথের চোখের সামনে খুলে যেতে লাগল এক নতুন জগৎ। মুঘল যুগের ইতিহাস নিয়ে গড়ে উঠল তাঁর অমর সব সৃষ্টি— শাহজাহানের স্বপ্ন, শাহজাহানের মৃত্যু, আলমগীর, ঔরঙ্গজেব ও দারার ছিন্নমুণ্ড।

আবার চণ্ডীদাসের অভিসারের বৈষ্ণব পদ ‘পৌখলী রজনী পবন বহে মন্দ।/ চৌদিকে হিমকর, হিম করু বন্দ।।’ অনুসারে অবনীন্দ্রনাথ ছবি আঁকলেন। কিন্তু রাধিকাকে পছন্দ হল না। তাঁর মনে হল ‘মেমসাহেবকে শাড়ি পরিয়ে শীতের রাত্রে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে’! ভাবলেন, দেশি টেকনিক শেখা দরকার। বলছেন, ‘‘তখনকার দিনে রাজেন্দ্র-মল্লিকের বাড়িতে এক মিস্ত্রি ফ্রেমের কাজ করে। লোকটির নাম পবন, আমার নাম অবন। তাকে ডেকে বল্লুম— ওহে সাঙাত, পবনে অবনে মিলে গেছে, শিখিয়ে দাও এবার সোনা লাগায় কি-ক’রে। সে বল্লে— সে কি বাবু, আপনি ও কাজ শিখে কি করবেন। আমাকে বলবেন, আমি ক’রে দেবো।’’ অবনের জেদ চাপল— নিজের ছবিতে নিজেই সোনা লাগাবেন। বৈষ্ণব পদাবলির ছবিতে সোনা-রুপোর তবক লাগিয়ে এঁকে ফেললেন।

আসলে ছবি আঁকা বিষয়টা তাঁর প্রাণের ভীষণ কাছাকাছি ছিল। ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ প্রসঙ্গে তাঁর লেখায় সে পরিচয় পাওয়া যায়— ‘‘এ ছবিটি এত ভালো হয়েছে কি সাধে? মেয়ের মৃত্যুতে যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। ‘শাজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষা’তে যত আমার বুকের ব্যথা সব উজাড় করে ঢেলে দিলুম।’’ নিকটজনদের সঙ্গে খুব জড়িয়ে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ১৮৮৯ সালে সুহাসিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর। এক পুত্র অলোকেন্দ্রনাথ। দুই কন্যা সুরূপা আর উমা। তবে তাঁর আত্মীয়তার পরিসরটি যেন আরও বড় ছিল। রবিকা কিংবা রানী চন্দের সঙ্গে তাঁর সখ্যের গল্পে তা বোঝা যায়।

নিকটজনদের অভিজ্ঞতা থেকেও অবনীন্দ্রনাথের এই মনটি বোঝা যায়। বিখ্যাত ‘ভারতমাতা’ দেখে ভগিনী নিবেদিতা ‘প্রবাসী’ (ভাদ্র ১৩১৩) পত্রিকায় লিখেছিলেন— ‘‘এই ছবিখানি ভারতীয় চিত্র-শিল্পে এক নবযুগের প্রারম্ভ সূচনা করিবে বোধ হয়... চিত্রপটে তৎকর্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শটি খাঁটি ভারতের জিনিস; আকার-প্রকারও ভারতীয়।’’ এই ভালবাসা আর একাগ্রতা ছিল গোড়ার দিনগুলো থেকেই। এক বার ঠাকুবাড়িতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী রবি বর্মা। অবনীন্দ্রনাথের স্টুডিয়ো দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করে শিল্পী বলেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।

পরবর্তী কালে ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়ে ওঠার পরেও তিনি ছিলেন ঠিক সেই রকমই। এক দিন এক শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের কাছে হাজির হয়ে বললেন, আঁকা শিখবেন। শিল্পগুরু বললেন, ‘‘তা তো শিখবে, কিন্তু কিছু এঁকেছো কি? দেখাও না।’’ তিনি একটি দুর্গার ছবি দেখালেন। অবনীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘‘তা দুর্গা যে আঁকলে, কি ক’রে আঁকলে শুনি?’’ শিল্পী বললেন, ‘‘ধ্যানে ব’সে একটা রূপ ঠিক ক’রে নিয়েছিলুম। পরে তাই আঁকলুম।’’ সহাস্য জবাব— ‘‘তা হবে না। ধ্যানে দেখলে চলবে না, চোখ খুলে দেখতে শেখো, তবেই ছবি আঁকতে পারবে। যোগীর ধ্যান আর শিল্পীর ধ্যানে এইখানে তফাৎ।’’ আঁকা-শেখানো পর্বে ছড়িয়ে আছে এমনই সব মজার গল্প। যা রসেরও, শেখারও। তিনি ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শৈলেন্দ্রনাথ দে, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেন কর, মুকুল দে-র মতো ছাত্রদের মধ্যে। প্রসঙ্গত, ১৯০৫ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯০৬ সালে হন অধ্যক্ষ।

ছবি আঁকা হোক বা লেখালেখি, মনেপ্রাণে ভারতীয় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ভারতীয় শিল্প এবং প্রাচ্যশিল্প যাতে বিশ্বের দরবারে সমাদর পায়, সেই জন্য প্রবল পরিশ্রম করেছিলেন। ১৯০৭ সালে তাঁর এবং গগনেন্দ্রনাথের উৎসাহ-উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস। অবনীন্দ্রনাথের কথায়— ‘‘আমরা করেছিলুম এমন একটা সোসায়েটি। যেখানে দেশী-বিদেশী নির্বিশেষে সবাই একত্র হয়ে আর্টের উন্নতির জন্য ভাববে। শুধু ভারতীয় শিল্পই নয়, প্রাচ্যশিল্পের সবকিছু জিনিস দেখানো হবে লোকেদের।’’ লর্ড কারমাইকেল, লর্ড রোনাল্ডসে, এডউইন মন্টেগু, মিস কার্প্লে, ভবানীচরণ লাহার মতো শিল্পানুরাগীরা এর আজীবন সদস্য হয়েছিলেন। সোসাইটিই হয়ে উঠেছিল অবনীন্দ্রনাথের ধ্যানজ্ঞান। ১৯১৫ সালে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে সোসাইটির কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেন। মনে পড়তে পারে, রামলাল চাকরের ইংরেজি শেখানো। সেটা স্রেফ মাঠে মারা গিয়েছিল। বহু আমন্ত্রণ সত্ত্বেও কোনও দিন দেশের বাইরে যাননি অবনীন্দ্রনাথ।

আর একটা জরুরি কথা হল, ছবি আঁকার ক্ষেত্রে এক এক সময় এক এক পথে হেঁটেছেন অবন। কাগজ, কাপড়, কাঠ— ব্যবহার করেছেন হরেক মিডিয়াম। হাতের কাজ তো ছিলই। বলা ভাল, পুতুল খেলা। সেই পুতুল তাঁর নিজেরই বানানো। পথ চলতে চলতে জড়ো করতেন টুকরো কাঠ, বাঁশের গাঁট, নারকেলের মালা, সুপুরিগাছের খোলা। সে সব দিয়েই তৈরি হয়ে উঠত চিল, বাঘ, কুকুর, হরিণ, উট, কুটির, সৈনিক, এমনকি রবীন্দ্রনাথও। নাম ‘কুটুম-কাটাম’। কিছু কেটেকুটে গড়ে নেওয়ার ব্যাপার ছিল না। শিল্পী খুঁজে বেড়াতেন, কোন গাছের গুঁড়ি কুকুরের মুখের মতো দেখতে কিংবা কোন বাঁশের গাঁট দিয়ে সারসের ঠোঁটের আদল তৈরি হতে পারে। তার পরে সেগুলো কুড়িয়ে এনে কিছু একটার উপরে বসিয়ে সাজানো। ব্যস, পুতুল তৈরি!

এক দিনের গল্প বললে পদ্ধতিটা আর একটু বিস্তারে বোঝা যাবে। আমগাছের একটা মোটা ডাল ভেঙে পড়ল মাটিতে। অবনীন্দ্রনাথ দেখলেন, সেটা দেখতে বেশ বড় পাখির মতো। কুড়িয়ে নিলেন। অন্য ক’টা ডাল দিয়ে বানালেন একটা স্ট্যান্ড। এক কোণে মোটা ডালের অংশটাকে বসিয়ে দিলেন। পিছন ফিরে রইল সেটি। দূর থেকে দেখে মনে হল, একটা চিল গাছের ডালে পিছন ফিরে বসে আছে। কল্পনাকে খেলানোর জন্য অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েই হল সৃষ্টি।

অবনীন্দ্রনাথের সামনে যে কাঠের টেবিলটা থাকত, তার উপরে ছড়ানো থাকত এই সব গুচ্ছের কাঠকুটো। রাজার মুকুটের জন্য সিগারেটের রাংতা, বিয়ের কনের নোলকের জন্য কাচের পুঁতি— এই রকম সব জিনিস। সঙ্গে করাত, ছুরি, লোহার কাঁটা, হাতুড়ি-বাটালি। কিছু জোড়া দিতে গেলে কাজে লাগত সেগুলো। ‘কুটুম-কাটাম’ প্রসঙ্গে ‘ঘরোয়া’তে লিখেছিলেন, ‘‘সেদিন আমার পুরোনো চাকরটা এসে বল্‌লে, বাবু, আপনি এ-সব ফেলে দিন। দিনরাত কাঠকুটো নিয়ে কী যে করেন, সবাই বলে আপনার ভীমরতি হয়েছে। আমি বললুম, ভীমরতি নয়, বাহাত্তুরে বল্‌তে পারিস, দুদিন বাদে তো তাই হবে। তাকে বোঝালুম, দেখ্, ছেলেবেলায় যখন প্রথম মায়ের কোলে এসেছিলুম তখন এই ইট কাঠ ঢেলা নিয়েই খেলেছি, আবার ঐ মায়ের কোলেই ফিরে যাবার বয়স হয়েছে কিনা, তাই আবার সেই ইট কাঠ ঢেলা নিয়েই খেলা করছি।’’

***

অবনীন্দ্রনাথ ছবি লিখতেন আর কথা আঁকতেন— কথাটা সাহিত্য-সমালোচক মহলে পরিচিত। সেই অপরূপ গদ্যের শুরুর দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিকা তাঁকে এক দিন বলেছিলেন, ‘‘অবন, তুমি লেখো-না,—যেমন ক’রে মুখে মুখে গল্প ক’রে শোনাও, তেমনি ক’রেই লেখো।’’ সাহসে কুলোয়নি প্রথমটায়। রবিকা ভরসা দিলেন— ‘‘তুমি লিখে যাও, আমি তো আছিই। ভাষার কোনও দোষ হ’লে তার ভার আমার ওপরেই না-হয় ছেড়ে দিয়ো, শুধ্‌রে দেবো।’’ উৎসাহ পেয়ে লিখে ফেললেন ‘শকুন্তলা’। ‘‘এক নিবিড় অরণ্য ছিল। তা’তে ছিল বড় বড় বট, সারি সারি তাল তমাল, পাহাড় পর্ব্বত, আর ছিল— ছোট নদী মালিনী।’’ অনাবিল গল্প বয়ে চলল এ ভাবেই। রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া পড়লেন। কিচ্ছু কাটলেন না। অবনীন্দ্রনাথ বল পেলেন— ‘‘আমিও তাহ’লে গল্প লিখতে পারি।’’ একে একে লিখলেন ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূতপত্‌রীর দেশে’।

ছোটদের জন্য লিখতেন সরল মধুর ভাষায়। আবার বড়দের জন্য লিখেছিলেন ‘বাংলার ব্রত’, ‘কথিকা’, ‘আপন কথা’র মতো প্রবন্ধ। সে লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ঘরোয়া’র ভূমিকায় লিখেছিলেন— ‘‘আমার জীবনের প্রান্তভাগে যখন মনে করি সমস্ত দেশের হয়ে কাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া যেতে পারে তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের নাম। তিনি দেশকে উদ্ধার করেছেন আত্মনিন্দা থেকে, আত্মগ্লানি থেকে তাকে নিষ্কৃতি দান করে তার সম্মানের পদবী উদ্ধার করেছেন। তাকে বিশ্বজনের আত্ম-উপলব্ধিতে সমান অধিকার দিয়েছেন।’’ (১৩ জুলাই ১৯৪১) তার আগে এর পাণ্ডুলিপি পড়ে চিঠিও দিয়েছিলেন ভাইপোকে— ‘‘অবন, কী চমৎকার— তোমার বিবরণ শুনতে শুনতে আমার মনের মধ্যে মরা গাঙে বান ডেকে উঠল। বোধ হয় আজকের দিনে আর দ্বিতীয় কোনো লোক নেই যার স্মৃতি-চিত্রশালায় সেদিনকার যুগ এমন প্রতিভার আলোকে প্রাণে প্রদীপ্ত হয়ে দেখা দিতে পারে— এ তো ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্য নয়, এ যে সৃষ্টি— সাহিত্যে এ পরম দুর্লভ।’’ অবনও সেই কথাটা বারবার জানিয়ে এসেছেন— ‘‘গল্প লেখা আমার আসতো না। রবিকা-ই আমার গল্প-লেখার বাতিকটা ধরিয়েছিলেন।’’ তবে রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন তিনি। সে যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে এই গুণ বিরল। অবনীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন নিজস্ব ভাষা।

ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও এই যোগটা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রাঙ্গদা’ শেষ করে অবনকে বললেন, ‘‘অবন, তোমায় ছবি দিতে হবে চিত্রাঙ্গদার জন্যে।’’ অবনীন্দ্রনাথের বাড়িতেই স্টুডিয়ো। চিত্রাঙ্গদার ছবি কেমন হবে, দেখিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের উপরে ভরসা ছিল সম্পূর্ণ। আসলে ছবি নিয়ে এত প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য আর কারই বা ছিল? কারই বা ছিল এমন ভালবাসা?

বস্তুত, অনুরাগীরা যখন তাঁকে ভালবেসে ডাকতেন ‘শিল্পগুরু’, অবনীন্দ্রনাথ নিজে বলতেন, ‘‘নামের আগে কতগুলো বিশেষণ জুড়ে দিলেই কি খুব বড়ো হয়ে যাবো!’’

ভালবাসা থেকেই সব কাজ করতেন। তাই হয়তো জীবনের প্রান্তভাগে পৌঁছে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আঁকার কাজ এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কাজ করার অনুরোধ করেছিলেন। শিল্পগুরুর জবাব ছিল, ‘‘মনে আর রং ধরে না।’’ এমন ভালবাসা না থাকলে সৃষ্টি কি চিরন্তন হয়?

ঋণ: অবনীন্দ্রনাথ: মনোজিৎ বসু শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ: রানী চন্দ অবনীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)

Painting Abanindranath Tagore অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy