Advertisement
১১ অক্টোবর ২০২৪

রান্নাতেও বনফুলের হাত ছিল চমৎকার

শখ ছিল পাখি দেখা। আকাশের তারা চেনাও। সাহিত্যিক ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়-এর জীবনের টুকরো টুকরো গল্পে ভ্রাতুষ্পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়নবজাতককে লোকে মুখে দেয় মধু। বড়জেঠু আমায় দিয়েছিলেন চা! তিনি তখন রীতিমত নামী চিকিৎসক। ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যিক হিসেবেও কেউকেটা নাম— বনফুল!

সাহিত্যিক ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়

সাহিত্যিক ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নবজাতককে লোকে মুখে দেয় মধু। বড়জেঠু আমায় দিয়েছিলেন চা!

তিনি তখন রীতিমত নামী চিকিৎসক। ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যিক হিসেবেও কেউকেটা নাম— বনফুল!

বাবারা ছ’ভাই। বড়জেঠু সবার বড়। আমার বাবা, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, যাঁকে সিনেমাজগতের লোকজন ‘ঢুলুদা’ নামেও চেনেন, ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।

বাবা আর জেঠুর বয়সের ফারাক কুড়ি বছর। বাবা ওঁকে এমনই সম্ভ্রম করতেন যে, কোনও দিন সামনে বসে গল্প করতে দেখিনি। চা খেলেও আড়ালে খেতেন।

বড়জেঠুর স্ত্রী আমার ‘বড়মা’। ওঁরা দু’জনেই এককালে থাকতেন ভাগলপুরে। ১৯৬৮ সালে জেঠু যখন ওখানকার পাট চুকিয়ে লেকটাউনে বাসা নিলেন, বাবা তারই কাছাকাছি সময়ে আমাদের নিয়ে উঠে এসেছেন টালিগঞ্জে।

বড়জেঠু মানেই ভারী চেহারা। ধুতি। পাঞ্জাবি। গম্ভীর চাউনি। তারই মধ্যে সারল্য খেলে বেড়াত মুখেচোখে। গল্প করতেন, মজার মজার গল্প। তার বেশিটাই খাওয়ার টেবিলে।

বড়জেঠুকে নিয়ে আমাদের পরিবারে গল্পের শেষ নেই।

যুবকবেলায় এক সময় তিন নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটের মেসে থাকতেন। তখনই একবার অভিন্নহৃদয় বন্ধু পরিমল গোস্বামীকে সঙ্গী করে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে আসেন। ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত দক্ষিণের বারান্দায় কবির এক দিকে তখন অবনঠাকুর, অন্য দিকে গগনেন্দ্রনাথ।

প্রথম আলাপেই থেমে যাওয়া নয়, সম্পর্ক গড়ায় তার পরেও। জেঠুর উপন্যাস ‘কিছুক্ষণ’ পড়ে উচ্ছ্বসিত কবি উৎসাহ দিয়ে চিঠি পাঠান জেঠুকে। আবার ‘শ্রীমধুসূদন’ নাটক পড়ে কড়া পত্রাঘাতও। এর মধ্যেই একবার কবি জেঠুকে বলেন, ‘‘তুমি আমার কোন জিনিসটি স্মৃতিস্বরূপ রেখে দিতে চাও, বলো।’’

জবাবে কবির একটি জোব্বা চেয়ে বসেন জেঠু। কবি নিজে সেটি তাঁর হাতে তুলে দেন।

‘কিছুক্ষণ’-এর প্রসঙ্গ উঠতে সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মানিকবাবু তখন সবে ‘পথের পাঁচালী’-তে হাত দিয়েছেন। কিছুক্ষণ-এর কাহিনি নিয়ে তিনি ছবি করতে চেয়েছিলেন। তার আগে বাবাও ওই একই কাহিনি চেয়েছিলেন বলে, জেঠু চিত্রস্বত্ব দেন বাবাকেই।

এমনও শোনা যায়, খ্রিষ্টান মুচির মেয়েকে প্রাধান্য দিয়ে মানিকবাবু নাকি ‘কিছুক্ষণ’-এর স্ক্রিপ্ট করেছেন, এই খবর পেয়ে পিছিয়ে যান জেঠু!

ভাগলপুরের বাড়িতে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ছবি। পরিমল গোস্বামী।

জেঠুর কাহিনি ‘ভুবন সোম’ নিয়ে ছবি করার গল্পটি আবার এক্কেবারে অন্য রকম।

‘ভুবন সোম’ যে ছবি হতে পারে, প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি জেঠু। তার ওপর পরিচালকের ওপর প্রযোজকের চাপ ছিল, নায়ক ভুবন সোমের বয়স কমিয়ে চরিত্রটা রোম্যান্টিক-রোম্যান্টিক করতে হবে। রাজি হননি মৃণালকাকুই। তার পরের কাহিনি তো ভারতীয় ছায়াছবির ইতিহাসে মাইলফলক! যেমন মৃণালকাকুর পরিচালনা, তেমন অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত, সুহাসিনী মুলে!

উৎপল দত্ত কী যে শ্রদ্ধা করতেন বনফুলকে! জেঠু যখন পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে এলেন, নতুন থিয়েটার করলেই, জেঠুর বাড়ি বয়ে নেমন্তন্ন করতে যেতেন উৎপল দত্ত নিজে। উদ্দেশ্য, ওঁকে প্রথম শো-তেই দেখানো চাই। টিফিন বাক্সে দিয়ে আসতেন জেঠুর প্রিয় কষা মাংস!

জেঠুর এই মাংসপ্রীতির ব্যাপারটা চাউর ছিল ভালই। অভিনেতা অশোককুমারও জানতেন।

একবারের গল্প বলি। জেঠুরই কাহিনি নিয়ে ‘হাটেবাজারে’ ছবির কাজ চলছে। অশোককুমার সেখানে সদাশিব ডাক্তার। হঠাৎই তিনি খবর পেলেন, তাঁর ‘বলাইদা’ এখন ভাগলপুরে! প্রসঙ্গত, অশোককুমারের মামাবাড়ি আবার ওই ভাগলপুরেই।

খুব ভাল রাঁধতে জানতেন অশোককুমার। সাতসকালে নিজের রাঁধা মাংস নিয়ে সোজা হাজির হয়ে গিয়েছিলেন বনফুলের কাছে!

ভোজনরসিক তো ছিলেনই, কিন্তু বড়জেঠুর নিজের হাতের রান্না?

শীর্ষেন্দুকাকু (মুখোপাধ্যায়) একবার ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এত যে খেতে ভালবাসেন, রান্না করতে জানেন?’’

তাতে জেঠুর জবাবটি শুনুন।— বলেছিলেন, ‘‘জানি মানে! শোনো, রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্টও করি। সেবার আলুর দম করছি, বুঝলে! কী খেয়াল হল, জলের বদলে দুধ ঢেলে দিলাম। আহা, কী স্বাদ হল গো!’’

বেশির ভাগ সময়ই জেঠুকে দেখতাম রাশভারী। কিন্তু এই মানুষটিরই আবার শৈশব ছিল দস্যিপনা আর দুষ্টুমিতে ঠাসা!

আরও পড়ুন: প্রিয়ঙ্কার ‘এক্স হাজব্যান্ড’ রাহুল!

আদি-বাস হুগলির শিয়াখালা হলেও আমাদের দাদু থাকতেন পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে। পেশায় উনিও ডাক্তার। ওখানেই জেঠুর জন্ম। বড় হওয়া।

গঙ্গা আর কোশি নদীর সঙ্গমে ওই জায়গাটিতে পিরবাবার পাহাড়। জঙ্গল। সরু সরু পায়ে চলা পথ। এবড়োখেবড়ো চাষের জমি। একহাতি একটা লাঠি নিয়ে সেই তল্লাটের এ-মুড়ো সে-মুড়ো চষে বেড়াত ছোট্ট বলাই। আর সুযোগ পেলেই লাঠি দিয়ে বাড়ি বসাতো অন্যের পিঠে।

ছোটবেলায় মায়ের বুকের দুধ পায়নি। এক মুসলিম মজদুর চামরুর স্তন পান করে বড় হওয়া। শক্তপোক্ত চেহারা। রাজ্যের জীবজন্তু নাড়াঘাঁটা শখ। সন্ধে হলে পড়া নয়, গানের আসরেই তাকে পাওয়া যেত বেশি। আর বলিহারী স্মরণশক্তি! সে বোধ হয় মায়ের দৌলতেই।

কিশোরবেলায় ‘বিকাশ’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা বের করত। তারই থেকে ক’টি কবিতা নিয়ে এক পরিচিত পাঠিয়ে দিয়েছিল ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায়। ছাপাও হয়ে গেল। সবাই কী খুশি! শুধু চটে গেলেন হেড পণ্ডিতমশাই! এবার উপায়? লেখা তো ছাড়া যাবে না! কিন্তু পণ্ডিতমশাইয়ের গোঁসা সামলাবে কে? অগত্যা ছদ্মনাম ধারণ। সেই থেকে বলাইচাঁদ হয়ে গেলেন ‘বনফুল’!

সুনীলকাকা (গঙ্গোপাধ্যায়) একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘‘লোকে বাংলা ভাষায় তিন ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’-কে এককালের প্রধান সাহিত্যিক ঠাওরায়! তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ! এই তালিকায় বনফুলকে বাদ দেওয়াটা আমার মনে হয় ঠিক নয়।’’

বড়জেঠুর লেখার জনপ্রিয়তা যে কী পর্যায়ের ছিল, ভাবা যায় না!

একবার হন্তদন্ত হয়ে স্টেশনে পৌঁছেছেন, দেখেন হুশ হুশ করে লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে যাচ্ছে।

হা কপাল! এখন বাড়ি ফিরবেন কী করে! মুহূর্তে দেখেন, থেমে গেল ট্রেন। পরে শুনেছিলেন, তাঁকে গাড়ি ধরার জন্য ছুটতে দেখে চলন্ত ট্রেন থামিয়ে দিয়েছিলেন বনফুল-ভক্ত গার্ড ও ট্রেন-চালক!

বনফুলের কাহিনি তো বটেই, ওঁর নাটকেরও প্রচণ্ড প্রশংসা করতেন সুনীলকাকু।

ঠিক যেমন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ী। তিনি যখন একেবারে খ্যাতির মধ্যগগনে, তখনই ঠিক করেন, বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ থিয়েটার করবেন। যে জন্য ভাগলপুরের বাড়ি পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন।

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য সে দিন! শিশিরকুমারকে আসতে দেখে বারান্দায় হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বড়জেঠু। ও দিকে বাগানের গেট খুলে নাট্যাচার্য ঢুকলেন, উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে, ‘‘আজি এসেছি, আজি এসেছি, এসেছি বঁধু হে...’’

লিখতেন। ছবি আঁকতেন। তারা দেখা, পাখি চেনা ছিল শখ। পাখিদের নিয়ে অসাধারণ একটি কাহিনিও লেখেন, ‘ডানা’।

ছিল অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ। যে জন্য পটনা মেডিকেল কলেজে ঢুকে যখন দেখেন, উঠতে-বসতে ওপরওয়ালাদের সেলাম ঠুকতে হবে, ‘ধুত্তোর’ বলে কলেজ ছেড়েছিলেন।

ডাক্তারি পড়তে পড়তেই বিয়ে করতে হয় দাদুর ফরমানে। পাত্রীর নাম লীলাবতী। আমার বড়মা। তিনি তখন বেথুন কলেজে। আইএ-র ছাত্রী। মা সারদার স্নেহধন্যা। শৈশবে তাঁকে চুল পর্যন্ত আঁচড়ে দিতেন সারদাময়ী। কটকট করে করে কথা বলতেন বলে, নাম দিয়েছিলেন ‘কটকটি’।

বড়মা’র বোন সুপ্রিয়াদেবী। শ্যালিকার সিনেমা করা জামাইবাবুর ছিল না-পসন্দ। সেজন্য অনুযোগও করতেন।

তাতে বেণুমাসি সোজাসাপটা বলে দিতেন, ‘‘যাব্বাবা, বনফুলের এত কাহিনি নিয়ে যে ছবি হয়, তার বেলা!’’

সংসারে বড়মা ছিলেন ছায়ার মতো। কঠিন রোগভোগের পর ১৯৭৬ সালে বড়মা যখন চিরকালের জন্য চলে গেলেন, বড়জেঠু খুব ‘একা’ হয়ে গিয়েছিলেন।

দেখলে খুব কষ্ট হত সেই সময়টায়। শেষ বয়সে বহুকালের সঙ্গীকে হারিয়ে তিনি তখন মনে মনে একেবারে নিঃস্ব!

এই একাকী জীবন অবশ্য দীর্ঘকাল সইতে হয়নি ওঁকে। ১৯৭৯-র শ্রীপঞ্চমী। সকালের জলখাবার খেয়ে বিছানা ছেড়ে টেবিলে বসতে গিয়ে হঠাৎই চলচ্ছক্তিহীন হলেন বড়জেঠু। ন’দিন যমে-মানুষে কী টানাটানি! কী টানাটানি!

ফেব্রুয়ারির ৯। সব থেমে গেল।

প্রাণের মানুষ লীলার কাছে লীন হবেন বলে অনন্তের পথে পাড়ি দিলেন সাহিত্যের বনফুল....

অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

Balai Chand Mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE