গত ডিসেম্বরের শেষে বৈতানিক-এর বার্ষিক অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হল। উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন স্মিতা সিংহ, ঋতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমিতা মল্লিকের মতো গুণিজনেরা। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীমতী ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বৈতানিক রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার এক ঐতিহ্যময় প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ দিন ধরেই এই প্রতিষ্ঠান রীতি মেনে তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এ বারও তার ব্যতিক্রম হল না।
পাঁচ দিনের এই অনুষ্ঠানে উদ্বোধনের পরের দিন শুরুতেই ছিল ‘মল্লার’ গোষ্ঠীর গান। সুমধুর সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের সূচনা হল। পরবর্তীতে একক সঙ্গীত পরিবেশনায় ছিলেন বৈতানিকের কর্ণধার বনানী দে। ভিন্ন ধরনের সাতটি রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করলেন বনানী, প্রত্যেকটিতেই অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ তিনি। কখনও তা ‘বিপুল তরঙ্গ রে’, কখনও ‘মরি লো মরি’ কিংবা ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’... ভিন্ন ধরনের সঙ্গীত চয়ন মনে রাখার মতো। শিল্পীর গাওয়া ‘চোখের জলে’ গানটির সঙ্গতে প্রীতম চক্রবর্তীর অসাধারণ এসরাজ বাদন গানটিকে আলাদা মাত্রায় পৌঁছে দেয়। বনানীর প্রতিটি গানেই তাঁর শিক্ষক সত্তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর সব গানেই অনুশীলনের ছাপ স্পষ্ট। শিল্পীর গান শুনতে শুনতে ভরসা জাগে, এঁদের হাতেই ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীরা তৈরি হচ্ছেন। যথোপযুক্ত মর্যাদায় রক্ষিত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে বৈতানিক-এর ঐতিহ্য।
বিশ্বভারতীর অধ্যাপক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় এই উদ্যাপনে উপস্থিত ছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাটকের গানের নাটক’ পরিবেশন করলেন তিনি। অসাধারণ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে রইলেন শ্রোতারা। তাঁর পরিবেশনায় ছিল ‘দেখা-শোনার গান’। কখনও অভিনয়সমেত ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র বিলিতি সুরের গান পরিবেশন করলেন তিনি, কখনও বা বাল্মীকির ভাবান্তরের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করলেন উপস্থিত শ্রোতাদের। কখনও শ্লোক পাঠ, কখনও আবার কাহিনি ছেড়ে সরস্বতীর কাছে আশ্রয় নেওয়ার গান... সব মিলিয়ে মনোজ্ঞ এক পরিবেশনা ধরা পড়ল অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়ের গানে।
অমর্ত্যর কণ্ঠেই ‘রাজা ও রানী’ নাটকের গান শুনলেন শ্রোতারা। মুক্ত অঙ্গনে শিক্ষার বাতাবরণ তৈরি ও শিক্ষার মুক্তি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা যায় এ ধরনের পরিবেশনার ফলে। ‘শারদোৎসব’-এর ঠাকুরদার গান ও অভিনয় শ্রোতাদের মুগ্ধ করল। মঞ্চ মেতে উঠল কখনও ‘ফাল্গুনী’র যুবকদলের গানে, কখনও আবার বিশু পাগলের আবেদনে। ধনঞ্জয় বৈরাগী যখন ধনকে জয় করে বৈরাগী হয়ে বলেন, “যা কিছু আছে সব কাড়ো, কাড়ো”— সেই আত্মনিবেদনের গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। অমর্ত্যের গান, নাটক, নাচ সবই ছিল একে অপরের পরিপূরক। ছোট মঞ্চে তবলা ও হারমোনিয়ামের সাহায্যে শিল্পী পলকেই এক নাটক থেকে অন্য নাটকে, এক ভাব থেকে ভাবান্তরে নিয়ে যাচ্ছিলেন শ্রোতাদের। তাঁর উপস্থাপনা-শেষে যেন আরও শোনার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হল শ্রোতাদের মনে। অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করলেন সৌমশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। সবশেষে পরিবেশিত হয় দীপ্তাংশু ও গার্গী পালের পরিচালনায় ‘ভানু সিংহের পদাবলী’।
রবীন্দ্রনাথকে ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন রূপে ধরার এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল এই অনুষ্ঠান। বৈতানিক-এর এই পরিপূর্ণ আয়োজন সব অর্থে সমৃদ্ধ করেছিল শ্রোতাদের। এই ধরনের অনুষ্ঠান আরও একবার প্রমাণ করে, এই প্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষা আজও সৌমেন্দ্রনাথ ও শ্রীমতী ঠাকুরের শিক্ষা ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)