Advertisement
E-Paper

মাধবীবিতান

তিনি গান শিখেছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে। তাঁর নাট্যগুরু ছিলেন শিশির ভাদুড়ী, ছবি বিশ্বাস। শ্রেষ্ঠ তিন পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের ছবির তিনি নায়িকা। মাধবী মুখোপাধ্যায়। লেক গার্ডেনসে নিজের নিভৃত ঘরে বসে, ফিরে দেখলেন অভিনয় জীবনের সাত দশক তিনি গান শিখেছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে। তাঁর নাট্যগুরু ছিলেন শিশির ভাদুড়ী, ছবি বিশ্বাস। শ্রেষ্ঠ তিন পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের ছবির তিনি নায়িকা। মাধবী মুখোপাধ্যায়। লেক গার্ডেনসে নিজের নিভৃত ঘরে বসে, ফিরে দেখলেন অভিনয় জীবনের সাত দশক

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৭ ১২:৪০

আমার মাতামহ ছিলেন শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, সে কালের পাশ করা ডাক্তার। স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। কিন্তু কখনও প্র্যাকটিস করেননি। সাদার্ন পার্কের বাড়িতে বসে ছবি আঁকতেন, ডল-ডামির ব্যবসাও ছিল। আমার জন্ম কলকাতায়, ওই দাদুর বাড়িতেই। মায়ের নাম লীলা, বাবা শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ছোটমাসি নাম দিয়েছিল, টুকটুক। মা বোধহয় চেয়েছিল দিদির পরে একটি ছেলে হোক। সেই জন্য আমাকে সব সময় শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে রাখত। সেই দেখে একদিন দাদু বললেন, ‘ও মা, এ টুকটুক কোথায়, এ তো টুকানবাবু!’

দাদুর বাড়ি ছিল আনন্দপুরীর মতো। সবাই খুব আনন্দে ছিল। উনি ছোটদের খুব ভালবাসতেন। সন্ধেবেলা খুব গল্প হত। চমৎকার সব দিন ছিল। ঢাকুরিয়াতে ভাড়ার বাড়িতে খুব ছোটবেলা কেটেছে আমার। কেবলই ব্যাগ নিয়ে ‘দাদুর বাড়ি চললাম’ বলে বেরিয়ে পড়তাম। মায়ের কাছে শুনেছি, খুব দুষ্টু ছিলাম। ধরে রাখা কঠিন ছিল। বাড়ির চারধারে প্রচুর গাছ-গাছালি আর সাপের উপদ্রব ছিল। মা সেই জন্য অ্যাসিড ছড়িয়ে দিতেন। একদিন হল কী... আমার তো স্নান করার খুব বাতিক ছিল... একদিন অ্যাসিড দিয়েই স্নান করেছি!

মা গো, কী জ্বালা! সব পুড়ে গেল! কে যেন বলল, ডিমের সাদা অংশ চাই। অমনি সকলে দৌড় দিল ডিমের জন্য। কাছাকাছি কোনও দোকানে সে দিন আর ডিম ছিল না আমার, এত ডিম মাখানো হয়েছিল আমার পোড়া হাতে!

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে

একটু বড় হতেই আমাদের ঠিকানা বদল হয়ে গেল।

আমরা উঠে গেলাম রাজাবাজারে, মুসলিম মহল্লার মাঝখানে এক ভাড়াবাড়িতে। বাবা-মা, আমরা দুই বোন। মানে, আমি আর দিদি মঞ্জরী। বাবা উকিল ছিলেন। সারা দিন বাইরেই কাটত তাঁর। মা-ও বেরিয়ে যেতেন। টাইপ শিখতে। বাবা-মা বাইরে গেলেই দিদি বলত, ‘চিৎকার করে কাঁদ।’ আমি কিছুক্ষণ কেঁদে চুপ করে যেতাম। নিজের খেলায় মেতে উঠতাম। বন্ধ ঘরের খড়খড়ি দিয়ে কান্না শুনে এক-একজন এসে বলত, ‘ইস, তোমাদের বুঝি আটকে রেখে দিয়ে গেছে!’ দিদি তত বলত, ‘টুকান জোরে জোরে কাঁদ। খুব জোরে!’

দেশ ভাগ হল। তার কিছু দিন আগেই আমাদের ছোট সংসারটাও দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। বাবার সঙ্গে মায়ের সেপারেশন। তখন চারদিকে গোলমাল। ছেচল্লিশের দাঙ্গা। চতুর্দিকে খুন, রক্ত। দুই বোন খুব ছোট, সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি। একদিন এক বস্ত্রে বেরিয়ে যেতে হল আমাদের মহল্লা ছেড়ে। এর বাড়ি, ওর বাড়ি করে দিন কেটেছে। সংসারে আয় বলতে ছিল মায়ের গানের টিউশন। মা খুব ভাল গান গাইতে পারত।

এর পরে দেশ স্বাধীন হল। শ্রীরঙ্গমে গান গাওয়ার জন্য মা আমন্ত্রণ পেল। দুই বোন মায়ের সঙ্গে সে দিন ‘বন্দেমাতরম’ গাইতে গেলাম। সব মনে পড়ে যাচ্ছে, মনে হয় এই তো সে দিন!

পাঁচ কি ছ’ বছর বয়স, সেই বয়সে শিশির ভাদুড়ীর মতো মানুষকে পেয়েছি নাট্যশালায়। পেয়েছি প্রভাদেবী, সরযূবালাদেবীকে।

‘সীতা’ নাটকের কথা মনে পড়ছে। আমার চরিত্র ছিল আশ্রমবালিকা আত্রেয়ীর।

কত সংলাপ স্মৃতিতে, ‘বারবার দুঃখের আঘাতে মস্তিষ্ক বিকৃতিই বুঝি ঘটিল মাতার/ শান্ত হও, শান্ত হও জননী আমার...’

‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’ কথাটা সেই বয়সে কিছুতেই আর উচ্চারণ হয় না। সেই শুনে বড়বাবু বললেন, ‘এত পুঁচকে মেয়ে, এ করবে অভিনয়! দেখো...’ বড়বাবু মানে শিশির ভাদুড়ী।

প্রম্পটার ছিলেন মণিবাবু। তিনি কাছে ডেকে শেখালেন। আজ এত বয়স হয়ে গিয়েছে। তবু সব কথা মনে পড়ছে। এখনও। যে দিন মঞ্চে অভিনয় হল ‘সীতা’র, বড়বাবু আনন্দে বললেন, ‘বাহ! বেড়ে বলছে তো মেয়েটা।’ কিন্তু, ওই যে মহলার সময় বলেছিলেন, এ মেয়ে কি পারবে? তাতে আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল। কিছুতেই আর শ্রীরঙ্গমে কাজ করলাম না। মিনার্ভায় চলে গিয়েছিলাম। প্রভাদেবী মা-কে বললেন, ‘আমি মিনার্ভায় যাচ্ছি। লীলা, তোমার ছোট মেয়েকে যদি আমাকে দাও... আমি নিয়ে যাব।’

সেই আমার মিনার্ভায় পা রাখা, ঠিক যে ভাবে অভিনয় জগতে প্রবেশ।

দশ বছর ছিলাম। মা আর দিদি শ্রীরঙ্গমে কাজ করেছে। নাটক দেখতে যেতাম। কখনও-সখনও নিজেও কাজ করেছি ছোট রোলে। তবে নাগাড়ে কাজ মিনার্ভাতেই করেছি। ওখানে অভিনয় করলাম প্রথমে ‘দুই পুরুষ’, পরে ‘ধাত্রী পান্না’ নাটকে।

সেও কত স্মৃতি। পঁচিশ টাকা মাইনের কাজ। কথায় কথায় সব কেমন মনে পড়ে যাচ্ছে আজ! আমার শিক্ষাগুরু যদি কাউকে বলতে হয়, তিনি ছবি বিশ্বাস। সেই প্রথম কাজ ওঁর সঙ্গে। প্রথম দিন ভুল দিয়ে শুরু। মহলা চলছে। কম্বিনেশন নাইট হল একদিন। ‘দুই পুরুষ’ নাটকে আমার সংলাপ ছিল, ‘রাত্রে বলিদান হবে, বাবুদের বাড়িতে থিয়েটার হবে। ম্যারাপ বাঁধছে। একটু পরেই কিন্তু ছুটি দিতে হবে।’ মঞ্চে ছবিবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অমনি সব পার্ট ভুলে গেলাম!

ব্যাপার দেখে উনি বললেন, ‘কী বাবুদের বাড়িতে থিয়েটার হবে?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, থিয়েটার হবে। ম্যারাপ বাঁধছে।’

উনি ফের বললেন, ‘কী চাই? ছুটি?’

বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ছুটি চাই। ছুটি দিতে হবে।’ এই করে নাটক শেষ হল। তখন এ সব নিয়ে খুব মজা হত। কত রাত হয়ে যেত মহলায়। ঘুম পেত খুব। মহলা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ছবিবাবু আমার জন্য নকুড়ের সরের সন্দেশ এনে রাখতেন। ঘুম পেলেই বলতেন, ‘নাও খেয়ে নাও। ঘুম চলে যাবে।’ আবার উঠে রিহার্সাল দিতাম। আর ছবিবাবু তো রাতে খুব একটা ঘুমোতেন না। সেই নিয়ে অনেক গল্প আছে।

ওঁর এক কাজের লোক ছিল মালকা। একদিন মহলার ফাঁকে বললেন, ‘মালকা, পান নিয়ে আয়।’

মালকা দেখল, বাবু যতক্ষণ থাকবেন, ছুটি নেই। চারটে পান আনব না। সে দুটো পান নিয়ে এল। পান খেয়ে উনি মালকাকে বললেন, ‘মালকা, তুই আজ আমার সঙ্গে যাবি।’ নিজে ড্রাইভ করে মালকাকে নিয়ে গেলেন। পরে শুনেছি, ছবিবাবু ওঁকে নাকি কবরস্থানের কাছে নামিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এখানে নাম।’ মালকা তো ভয়ে অস্থির। এত রাত! ছবিবাবু কোনও কথাই না শুনে বাড়ি চলে যান। ফের শেষরাতে ফিরে এসে দেখেন মালকা দাঁড়িয়ে আছে। উনি বললেন, ‘মালকা, গাড়িতে ওঠ। এখন থেকে ক’টা পান দিবি?’

মালকা বলে, ‘চারটেই দেব। দুটো আর কখনও দেব না। কান ধরছি বাবু। আমার সারা রাত কেটেছে ভূতের ভয়ে।’

এমন সব নানা মিঠে স্মৃতি ছবিবাবুকে ঘিরে। খুব মজা করতেন সকলের সঙ্গে। একবার তমলুক গেলাম সকলে ‘ধাত্রী পান্না’-র অভিনয় করতে। তখন এমন ফ্যান ছিল না। যে ঘরে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল, টানা পাখা ছিল। খুব মজা পেলাম আমি। শুধু টানছি আর টানছি। বড়রা সবাই খুব বকাবকি করছেন। খাওয়ার সময় যত ভাল মাংস পড়েছে পাতে, ছবিবাবু আমাকে তুলে দিলেন। উনি বললেন, ‘না, এগুলো মাধু খাবে।’

শিশির ভাদুড়ী, ছবিবাবু, অহীন্দ্র চৌধুরীর ভালবাসার সেই দিনকাল স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও যত্নে তুলে রাখা।

আমি আর নির্মল

অভিনয় না জুটলে নাটকে নাচ, গান এ সব করতে করতেই একদিন ছবির জগতেও ঢুকে পড়লাম।

সে সময় ‘আত্মদর্শন’ নামে একটা নাটক করেছিলাম। শ্যাম লাহা ‘লোভ’ চরিত্রে অভিনয় করতেন। আর আমি ছিলাম ওঁর ছেলে ‘মাৎসর্য্য’-র ভূমিকায়। নাটকের ডিরেক্টর ছিলেন নরেশ মিত্র। তিনি একদিন বললেন, ‘চল আমার সঙ্গে। একটা ভাল জামা পরে যাবি।’ জায়গাটা কোথায় যেন টেকনিশিয়ান... না, ইস্টার্ন টকিজ স্টুডিয়ো মনে হয়। কাজ চলছে ‘দুই বেয়াই’ ছবির। প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালক। তাঁর তখন খুব নামডাক। আমি তো ভাল জামা মানে ফ্রক পড়ে গিয়েছি। উনি বললেন, ‘না, এ জামা হবে না। ছেঁড়া জামা পরতে হবে।’ মনটা খারাপ হয়ে গেল, ছেঁড়া জামা!

ছবিতে আমার চরিত্র ছোট একটি মেয়ের। ‘মহানগর’ ছবিতে যিনি আমার শাশুড়ির চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেই তাঁর মেয়ে আমি। শুটিং শুরু হতেই সঙ্গে যার অভিনয় ছিল, সে বারবার সংলাপ ভুল করছে। আমি প্রম্পট করে দিচ্ছি। নাটকে এ সব তো হামেশাই হত, আমার সেই অভ্যেস। ও মা, প্রম্পট করতেই সঙ্গে সঙ্গে কাট হয়ে যাচ্ছে। প্রেমেনবাবু আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘শোনো, এটা তো থিয়েটার নয়। সিনেমা। এখানে সব রেকর্ডিং হয়ে যায়। সাউন্ডও।’

বললাম, ‘কী করে হয়!’

উনি বললেন, ‘উপরে তাকিয়ে দ্যাখো। ওটাকে বুম বলে। যা বলবে সব রেকর্ড হয়ে যাবে। ও ভুল করলে, আমি কাট করব। তোমাকে প্রম্পট করতে হবে না।’ তার পর সেই দৃশ্য ফাইনাল টেক হল। শিশুশিল্পী হিসেবে ১৯৫০ সালে ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’-কে অনেকে বলেন আমার প্রথম ছবি। তা কিন্তু নয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ওই ‘দুই বেয়াই’-ই আমার প্রথম ছবি। ওঁর ‘সেতু’ ছবিতেও কাজ করি।

অভিনয় করলাম অন্যদের ছবিতেও। ‘কর্ণার্জুন’, ‘মেজদিদি’, ‘অসবর্ণা’, ‘মেঘমুক্তি’... একটু একটু করে কানন দেবী, অসিতবরণ, সন্ধ্যারাণীদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। নাটকের মতো সিনেমার জীবনও ‘দুই বেয়াই’-এর ভুল দিয়েই শুরু হল।

সেলুলয়েডে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও আমি

তখন বাগবাজার স্ট্রিটে থাকি আমরা। একে একে ছবিতে ডাক এল। একটা ছবির কথা মনে পড়ছে, সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমার ছিলেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’। সে ছবিতে সুচিত্রা সেনের ছোটবেলা করার জন্য ডাকা হল। বাতিলও হলাম। কেন? খুব রোগা ছিলাম। সেটাই কারণ। কত পরিচালকের সঙ্গে যে কাজ করলাম! নাটকও চলছে। ছবির কাজও করছি। তবে শাড়ি পরে প্রথম কাজ করলাম বোধহয় ‘টনসিল’ ছবিতে। মজার কথা, রোগা চেহারার জন্যই এই ছবিতে কাজ পাই। সঙ্গে অভিনয় করেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম নায়িকা হওয়া তপন সিংহের এই ‘টনসিল’ ছবিতেই। সে সময় কোনও ছবি ভানুদাকে বাদ দিয়ে হত না। কত স্মৃতি ওঁকে নিয়ে।

এর পর আমার অভিনয়জীবনে তিন জন পরিচালক এলেন বেশ কিছু সময় পর পর।

মৃণাল সেন, ঋত্বিকদা এবং সত্যজিৎ রায়। ১৯৬০-‌এ মৃণালবাবুর ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ কাজ করলাম। এর পর ঋত্বিকদা’র সঙ্গে করি ‘সুবর্ণরেখা।’ আর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রায় পরপর ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ।’

মৃণাল সেন ডেকে পাঠালেন এক দিন। ছবির বেশ কয়েক জন প্রোডিউসার ছিলেন। ভোলাবাবু, বিজয়বাবু... আর নাম মনে পড়ছে না। বিজয় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ধানবাদে আমি নাটক করেছিলাম। নাটকের নাম ‘উল্কা’ মনে হয়। মৃণালবাবু নতুন মুখ খুঁজছিলেন, বিজয়বাবুই বোধহয় আমার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তখন আমার ঠিকানা কোথায় পাবেন! মৃণালবাবু অনুপদাকে, মানে অনুপকুমারকে বলেন। উনি গীতাদিকে বলেন। গীতাদি তখন আমার ঠিকানা দেন। সেই ডাক এল। মৃণাল সেনের সঙ্গে প্রথম দেখা।

উনি বললেন, ‘তুমি ঘর মুছতে পারো?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘বাসন মাজতে?’

‘হ্যাঁ, পারি।’

উনি যেটাই বলছেন, সেটাই বলছি ‘হ্যাঁ পারি’। এগুলো তো ঘরের কাজ। একটু পরে উনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঘুঁটে দিতে পারি কি না। তখন আমি ভাবছি, ঘুঁটে তো কখনও দিইনি। পাশে ছিলেন গীতাদি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘এ আর এমন কী! হাতে গোল্লা নেবে। আর দেওয়ালে মারবে।’ খারাপ লাগছে, গীতাদি আর নেই! উনি কত সাহায্য করতেন আমাকে। সেই ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতেই বিজয়বাবু আর ভোলাবাবু আমার নাম বদলে দেন। মাধুরী থেকে বদলে নতুন নাম হল আমার। মাধবী। লেখা হল ‘নবাগতা মাধবী’।

এর পর আর একজন ছবিতে কাজ করার জন্য ডাক পাঠালেন। তিনি ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিকদা’র সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আর কারও সঙ্গে মেলেনি। মিলবেও না। ফ্লোরে সবার সামনে আমাকে বললেন, ‘তোকে নিয়ে বিপদে পড়েছি। ক্লোজে ভাল লাগে না। লং শটে মনে হয় সূতিকাগ্রস্ত।’ হঠাৎ করে ‘আপনি’ বলতেন। কখনও ‘তুই’। ঋত্বিকদা কী করবেন না করবেন, আগে থেকে কিছুই বোঝা যেত না।

ডাকলেন ‘কোমল গান্ধার’ ছবির জন্য। প্রথম দিন শুনলাম। পরে আবার ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘শোনো, এ চরিত্র তোমাকে দেওয়া যাবে না। ডিস্ট্রিবিউটর চাইছেন সুপ্রিয়া করুক। অন্য একটি চরিত্র রয়েছে। সেটা তুমি করো।’ আমি করিনি। ফিরে চলে এলাম। সত্যি কথা বলতে কী, তখন ঋত্বিক ঘটককে চিনতাম না। সেই জন্য কাজ করিনি। পরে যখন ‘সুবর্ণরেখা’ করলাম, উনি ডাকলেন। ডেকে বললেন, ‘যে আমাকে রিফিউজ করে, তাকে আমি ডাকি না। কিন্তু তোমাকে ডাকলাম।’ কোনও উত্তর দিইনি আমি!

মনে আছে, ইন্দোরে শুটিং চলছে। উনি ড্রিঙ্ক করে আছেন। সারা রাত শুটিং। উনি ‘প্যাক আপ’ বলছেন না। তখন আমাদের ক্যামেরাম্যান দিলীপ মুখার্জি গিয়ে বললেন, ‘দাদা, আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে।’ ঋত্বিকদা বললেন, ‘ও... তা হলে প্যাক আপ।’ তবে বেশির ভাগ সময় দেখতাম, কাজের মাঝে ড্রিঙ্ক করতেন না।

সুবর্ণরেখায়

এত ছবি, এত বড় মাপের সব পরিচালক, প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি, কার কথা বাদ দিই!

তখন কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটে থাকি। সেখানে অরোরা স্টুডিয়োর মালিকদের বাড়ি ছিল। ওঁরা পুজোর সময় ওঁদের ছবিগুলো দেখাত। আমার প্রথম ‘জলসাঘর’ দেখা ওখানেই। সে খোলা আকাশের নীচে। বহু লোক একসঙ্গে বসে দেখত। কোনও টাকাপয়সা লাগত না। তো একবার সত্যজিতের প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিল চৌধুরী আর দুর্গাবাবু আমার সঙ্গে এসে দেখা করলেন। বললেন, সত্যজিৎবাবু বাড়িতে ডেকেছেন। ঠিকানা লিখে দিয়ে গেলেন। ৩ লেক টেম্পল রোড। ওরা চলে গেলে মা বলল, ‘কী রে, যাবি?’

আমি বললাম, ‘না।’

‘কেন?’

‘নর্থ থেকে সাউথ, এর ট্যাক্সি ভাড়া কম নয়। আর আমাকে পছন্দ করার মতো কিছু নেই।’

মা বলল, ‘সে কী! উনি ডেকেছেন যখন, একবার যাওয়া উচিত।’

বললাম, ‘সব উচিত কি আর মানা যায়!’

এই কথোপকথন যখন হচ্ছে, তখন ওঁরা ঘুরে এলেন। বললেন, ‘আপনি ট্যাক্সিভাড়াটা রেখে দিন।’ খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। কোনও কথাই ওঁরা শুনলেন না। ভাড়া রেখে গেলেন। একদিন দেখা করতে গেলাম। উনি কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। দু’-একটা সাধারণ কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখন উনি ‘অভিযান’ করছেন। বললেন,

‘পরে জানাব।’

বুঝতে পারলাম, কাজ হল না আমার। কিন্তু ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটল। ফের ডাকলেন সত্যজিৎ রায়। স্ক্রিপ্ট শোনালেন। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কেননা, তার আগে যত ছবিতে কাজ করেছি, নায়কপ্রধান। ওঁর এই ছবিটি নায়িকাপ্রধান। ভাবছি, এটা আমি করব! তার পর উনি স্ক্রিপ্ট হাতে দিলেন। শুরু হল ‘মহানগর’ ছবির শুটিং। নাগাড়ে ১৮ দিন। ছবি শেষ হল আলিপুরের আউটডোরে। সে দিন উনি বললেন, ‘আবার কবে তোমার সঙ্গে কাজ করব!’ খুব অবাক হলাম। কথাটা তো আমার বলার কথা।

কিছু দিন পর টেলিফোন এল। উনি ‘নষ্টনীড়’ পড়তে বললেন। পড়া আছে জানাতে বললেন, ‘পাঠাচ্ছি, আবার পড়ে নাও।’ এক দিন ‘চারুলতা’ রিলিজ করল। উনি বলেছিলেন, ‘এখন অন্য কোনও ছবিতে কাজ করবে না।’ করিনি। ‘চারুলতা’ প্রচুর সম্মান দিয়েছে আমাকে। উনি ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতেও অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন আমাকে। কিন্তু তখন আমাদের নিয়ে নানা কথা। জেদ করে ‘না’ করে দিলাম।

এত জনের সঙ্গে কাজ করেছি, একটা কথাই মনে হয়েছে, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করা অনেক সহজ। সব জিনিস এত সুন্দর ছকে বাঁধা, আলাদা করে কিছু ভাবতে হয় না। সব সাজিয়ে রাখতেন। কখনও রাশভারী মনে হয়নি ওঁকে। ভয় করেনি। ঢেউ তো বাইরে, সমুদ্রের ভিতর শান্ত। ওঁর মানবিকতার কথা ভোলা যায় না।

একবার ‘সিঁদুরে মেঘ’ ছবির স্পেশ্যাল শো ছিল। ছবি শেষ হল, দর্শকদের ভিড়ে আটকে গিয়েছিলাম। অসহায় লাগছিল।

ভিড় থেকে হাত ধরে টেনে বের করে মানিকদা সে দিন নিজের গাড়িতে নিয়ে গেলেন।

উত্তমকুমার, সৌমিত্রবাবু, বসন্ত চৌধুরী, জহরদা, ভানুদা, লিলিদি, অনুপকুমার, শুভেন্দুবাবু, পূর্ণেন্দু পত্রী... সবার সঙ্গেই কাজ করার এত স্মৃতি!

এক-এক জনের কাজের ধরন আলাদা। মনে পড়ছে, উত্তমকুমারের সঙ্গে বড়দিনে প্রথম দেখার কথা। পার্ক স্ট্রিটে দিদির সঙ্গে খেতে গিয়েছি। ওঁর সঙ্গে দেখা। উনি বললেন, ‘আমি আপনার ‘সুবর্ণরেখা’ দেখেছি। ভাল লেগেছে।’ চুপ করে ছিলাম। কী বলব! তার পর একসঙ্গে কাজ করলাম ‘থানা থেকে আসছি’ ছবিতে। উনি স্টুডিয়োতে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকলেন। আমি বললাম, ‘প্লিজ ও ভাবে বলবেন না, আমাকে মাধবী বলেই ডাকবেন।’

পরে আরও কত স্মৃতি, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘শঙ্খবেলা।’ ম্যাসাঞ্জোরে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ গানের আউটডোর। কত মধুর ঘটনা। সুপ্রিয়াদেবী এত খাওয়াতেন! নিজে রান্না করতেন। তিন জনে একসঙ্গে খেতাম। সুপ্রিয়াদি একদিন আমাকে আর অনুভাদিকে বললেন, ‘উটকো মেয়েরা এত জ্বালায় উত্তমকে, আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে!’

আমি বললাম, ‘এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। যখনই কেউ ওঁর ঘরে বসে গল্প করবে, তুমি গিয়ে বলবে, ‘উত্তম, তোমার খাওয়া হয়েছে?’

সুপ্রিয়াদি বললেন, ‘কী খাওয়া?’

বললাম, ‘বলবে পান!’ সেই থেকে পান কিনে রেখে দিতেন। কেউ এলে, একটা সংলাপ আর একটা পান। বিকেলে সবে ভিতরে গিয়ে বসেছি, উত্তমকুমার শুধু তাকাচ্ছেন আমার দিকে। একটু পরে বললেন, ‘খোকাদা, এই দুটোকে বের করে দিন তো। আমার পার্ট গুলিয়ে যাচ্ছে।’ খুব মজা হয়েছিল সে বার। ওঁকে খুব জ্বালিয়েছি!

জীবনের একটা দীর্ঘ পর্ব ঘুরেছি এক বাসা থেকে অন্য বাসায়। যেমন ইনকাম হয়েছে, তেমন তেমন ঘর ভাড়া নিয়েছি।

মা পিয়ানো বাজাত। তার গান-বাজনার প্রচুর ছাত্রছাত্রী ছিল। এক সময় তারও একটা আলাদা জগৎ হয়ে গেল। বাবার মতো ফের বিয়ে করেছিল মা। সে জগৎ ছেড়ে আসতে চায়নি মা। দিদির বিয়ের বেশ পরে একাই চলে এসেছি আমি। এই যে এত শুটিংয়ের কাজে বাইরে ঘুরতে হয়েছে, সব সময়ই একা। আজ যেমন একা। সে দিনও একাই ছিলাম।

একা একাই সব করতে হয়েছে। নিজের ঘর হল একদিন। লেক গার্ডেনসের এই দোতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এখানেই আছি। যদি আমার পরিবারের কথা বলেন, কোথায় থাকল আর পরিবার!

একটা ছোট্ট ঘর, সেটাও হল না!

সকলের তো সব কিছু হয় না। কখনও অসম্মান সইতে পারি না। তাই হয়তো হয়নি।

বিয়ে হয়েছিল। পঁচিশ বছর সংসার করেছি নির্মলকুমারের সঙ্গে। দুই মেয়ে, মিমি আর নীলাঞ্জনা হল। তারা খুব ভাল আছে। সংসারের দায়িত্ব পালন করেছি। কর্তব্যে কখনও ত্রুটি রাখিনি।

ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে ঘরে-বাইরে কত প্রতিবন্ধকতা এসেছে। শুধু লড়াই করতে হয়েছে। করেছি। নিজের আদর্শকে বিশ্বাস করে এগিয়েছি। জানতাম, কাজ না করে আমার উপায় নেই। এখনও কাজ করছি। সারা দিন নানা কাজে জড়িয়ে রয়েছি।

বই পড়ি। ইলিশ মাছ রান্না করে এখনও খাওয়াতে ভালবাসি। খুব অল্প বয়সে গান শিখেছি কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে। তার পর দুর্গা সেন এবং আরও অনেকের কাছে। সেও কত যুগ আগের কথা! এখনও গান শুনি। রবীন্দ্রনাথের গান। তিনিই আমার একমাত্র ঈশ্বর।

অনুলিখন: আবীর মুখোপাধ্যায়

Celebrity Interview Madhabi Mukherjee মাধবী মুখোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy