Advertisement
E-Paper

শিলং যাত্রীর চিঠি

দুর্যোগের পর দুর্যোগ। রবীন্দ্রনাথের শিলং-যাত্রার বর্ণনা পেলেন শুভাশিস চক্রবর্তীদুর্যোগের পর দুর্যোগ। রবীন্দ্রনাথের শিলং-যাত্রার বর্ণনা পেলেন শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭ ০১:০৪

নৌকার মাল্লার কোল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঝপাস করে পড়ে গেলেন এক-কোমর কাদায়। মাল্লাটিও পড়ল তাঁর ঘাড়ে। রাত এগারোটায় হাওড়ায় গঙ্গার ঘাটে সে এক রোমহর্ষক দৃশ্য! শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ সদলবল আসছেন কলকাতায়। সেখানে দু’তিন দিন থেকে যাবেন শিলংয়ে।

১৯১৯। অক্টোবর মাস। তখনও আজকের রবীন্দ্র সেতু তৈরি হয়নি। কলকাতা আর হাওড়ার মধ্যে যোগাযোগের জন্য ছিল পন্টুন ব্রিজ। বাংলায় যাকে বলে নৌকা-সেতু। কিন্তু বড় বড় জাহাজগুলো যখন উত্তর দিকে যেত, সেতুর মাঝের কয়েকখানা নৌকা সরিয়ে নেওয়া হত। সে সময় সেতুর উপর চলাচল বন্ধ, লোকে সরকারি স্টিমার বা ভাড়া নৌকায় গঙ্গা পারাপার করত। রবীন্দ্রনাথ ভাড়া নৌকায় গঙ্গা পার হওয়ার জন্য ঘাটে এলেন। তার পরের ঘটনা রানুকে লিখছেন তিনি, ‘‘একটা মাল্লা এসে আমাকে আড়কোলা করে তুলে নিয়ে চলল। নৌকার কাছাকাছি এসে আমাকে সুদ্ধ ঝপাস করে পড়ে গেল।’’

এর চার দিন পর লক্ষ্মীপুজোর বিকেলে কলকাতা থেকে শিলং পাহাড়ের পথে রওনা দিলেন। সঙ্গে অনেকে। কবি লিখছেন, ‘‘সান্তাহার স্টেশনে আসাম মেলে চড়লুম, এমনি কষে ঝাঁকানি দিতে লাগল যে, দেহের রস–রক্ত যদি হত দই, তাহলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রাণটা তার থেকে মাখন হয়ে ছেড়ে বেরিয়ে আসত।’’

ব্রহ্মপুত্র নদের এ পারের স্টেশন আমিনগাঁও। সেখানেই নামতে হল। নদী পার হওয়ার জন্য আবার তাঁরা সদলবল নৌকায় উঠলেন।

এ দিকে হয়েছে আর এক কাণ্ড!

রথীন্দ্রনাথ তাঁদের পুরনো মিনার্ভা গাড়িটি বিক্রি করে ক’দিন আগেই কিনেছিলেন একটি নতুন গাড়ি। তাঁরা যে দিন ট্রেনে গৌহাটি রওনা দিলেন, তার দু’দিন আগে বনমালী পাড়ুই আর অন্য একজন ভৃত্য সেই গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন গৌহাটির উদ্দেশে। কবির ইচ্ছে, সেই গাড়িতে করে শিলং পাহাড়ে চড়বেন। কিন্তু গৌহাটিতে পৌঁছে তাঁদের অপেক্ষা করতেই হল, কারণ, ‘শুনি, ব্রহ্মপুত্রে বন্যা এসেচে বলে এখনো ঘাটে মোটর নামাতে পারেনি।’

এ দিকে দুপুর দুটোর পর গৌহাটি থেকে মোটর ছাড়তে দেবে না। অথচ তাঁদের গাড়ি এসে পৌঁছাল আড়াইটায়। বেলা গড়িয়ে যায়। স্নানাহার করতে হবে। বিশেষ করে স্নান। তীরের কাছে একটা শূন্য জাহাজ বাঁধা ছিল। তাতে উঠে মুটের সাহায্যে কয়েক বালতি ব্রহ্মপুত্রের জল তুলিয়ে আনা হল।

তার বর্ণনা কবির কলমে, ‘‘ভূগোলে পড়া গেচে পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল, কিন্তু বন্যার ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা স্রোতে সেদিন তিন ভাগ স্থল এক ভাগ জল। তাতে দেহ স্নিগ্ধ হল বটে কিন্তু নির্মল হল বলতে পারিনে।’’

এ বার লক্ষ্য গৌহাটি শহর। নতুন গাড়িতে। কিছু দূর গিয়ে সে গাড়ি নড়েও না, চড়েও না। বিকল্প ব্যবস্থা করে শহরে পৌঁছলেন। একটা ডাকবাংলোয় গিয়ে দেখেন, সেখানে লোকের ভিড়। একটা মাত্র ঘর খালি। তাতেই থাকতে হবে এই পাঁচজনকে। তাই থাকলেন। রাতটা এক রকম কেটে গেল।

পরদিন সকাল পৌনে আটটার সময় অতি কষ্টে জোগাড় করা একটা ভাড়ার গাড়িতে তাঁরা শিলংয়ে রওনা দিলেন। কবি জানাচ্ছেন, ‘‘রথী গিয়ে নানা লোকের কাছে কাকুতি মিনতি করে সেটা ঠিক করে এসেচেন। ভাড়া লাগবে একশো পঁচিশ টাকা যা আমাদের হাতি কেনার চেয়ে বেশী।’’

যাওয়ার সময় চোখে পড়ল রাস্তার পাশে তাঁদের মোটরগাড়িটি খারাপ হয়ে পড়ে আছে। সেই গাড়িতেই রয়ে গিয়েছে গরম পোশাকসহ দরকারি জিনিসপত্র। রাণুকে লিখছেন কবি, ‘‘জিনিস রইল পড়ে। আমরা এগিয়ে চললুম। বিদেশে, বিশেষত শীতের দেশে, জিনিসে–মানুষে বিচ্ছেদ সুখকর নয়। যা হোক, শিলঙ পাহাড়ে এসে দেখি, পাহাড়টা ঠিক আছে, আমাদের গ্রহ বৈগুণ্যে বাঁকেনি চোরেনি, নড়ে যায়নি, দেখে
আশ্চর্য বোধ হল, এখনও পাহাড়টা ঠিক আছে।’’

ঋণ: রবীন্দ্রনাথ এবং শৈলাবাস শিলঙ (মালবিকা বিশারদ)

Rabindranath Tagore Letter from Shillong
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy