মান্না দে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, “গানের প্রতিটি শব্দকে যথাযথ উচ্চারণ না করতে পারলে, কখনও সে গান প্রাণ পেতে পারে না। সঙ্গীত মানে শুধু ‘সুর’ নয়৷ সুর ও ভাষার একটি সঠিক সংমিশ্রণ। তাই যদি ভাষাটাই ঠিকমতো বোঝা না যায়, তাহলে কী করে একটা সত্যিকারের সঙ্গীত হয়ে উঠবে?” এই কথাগুলি কতখানি সত্য, তার উপলব্ধি হল সম্প্রতি কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) নিবেদিত ‘গানে গানে জয়তী’ অনুষ্ঠানে, সঙ্গীতশিল্পী জয়তী চক্রবর্তীর একক অনুষ্ঠান। শিল্পীর কণ্ঠমাধুর্য, গায়কি এবং দরদ সে দিন ভরিয়ে দিয়েছিল প্রেক্ষাগৃহ। রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, লোকগীতি, গজ়ল... সব শ্রেণির গানে তার দক্ষতা এ দিন তিনি রেখে গেলেন।
মাতৃবন্দনা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। সুরমূর্ছনায় ভরে গেল প্রেক্ষাগৃহ। উপস্থাপনার গুণে এক অপূর্ব বাতাবরণের সৃষ্টি হল। এই গানটির সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার শ্রোতাদের আবিষ্ট করে। শিল্পীর আধ্যাত্মিক চেতনা তাঁর গান নির্বাচনেই পরিলক্ষিত হল। পরের পরিবেশনা, রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’। তার পরের গানে নিবেদিত হল ভাল থাকার ও ভাল রাখার প্রার্থনা। শিল্পী গাইলেন ‘সংশয় তিমির মাঝে না হেরি গতি হে’। সুন্দর পরিবেশনা। এর পরের গানটিও ছিল উত্তরণের গান। ইদম শাহের গান ‘কাঁদিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পারে’। লোকগানেও শিল্পীর স্বাচ্ছন্দ্য প্রমাণ করল তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনা ও কণ্ঠশৈলী। বিশেষ করে গানের শেষ পঙ্ক্তি ‘মন কাঁদে কে বা তার তরে’। কী অপূর্ব অনুভূতি! শ্রোতারা আবিষ্ট হয়ে শুনলেন।
এই অনুষ্ঠানটি যে প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আয়োজিত হয়েছিল, সেখানে একটি ঘরোয়া আবহের সৃষ্টি হয়েছিল। তার ফলে শিল্পীর সঙ্গে শ্রোতাদের অনুরোধের আদানপ্রদানও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছিল। শ্রোতাদের অনুরোধে শিল্পী বেশ কয়েকটি গান শোনালেন। গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপিত ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার রচিত বিখ্যাত গান ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’। বাংলা আধুনিক গানেও তাঁর সাবলীল বিচরণ ভাল লাগল। এর পরে শিল্পী আবার ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথের গানে। পরিবেশন করলেন ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ ও ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। গানের আর্তি দু’টি পরিবেশনাতেই পরিস্ফুট হয়ে উঠল। শ্রোতাদের অনুরোধে জয়তী গাইলেন ‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে’। গানটির শেষের দিকে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার সক্রিয় অংশগ্রহণ মনে রাখার মতো।
শ্রোতাদের অনুরোধে শিল্পী পরিবেশন করলেন বাংলার লোকগীতি ‘রাই জাগো’। গানটির শেষ ভাগে ‘গোবিন্দ রাধে রাধে’ ও সবশেষে হরিধ্বনি দিয়ে গানটি শেষ করার জন্য প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় চলে গিয়েছিল। এই গানেরই রেশ নিয়ে পরিবেশিত হল ‘সুরধ্বনির কিনারায় সোনার নূপুর দিয়া পায়ে’। এই গানে শিল্পীর আবেদন মূর্ত হয়ে উঠল। জয়তী চক্রবর্তী যে বিভিন্ন ধরনের গানে পারদর্শী, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর সুললিত কণ্ঠে পরিবেশিত বিখ্যাত গজ়ল ‘পেয়ার কা পহেলা খত লিখনে মে ওয়ক্ত তো লগতা হ্যায়’-তে। অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে শ্রোতাদের অনুরোধে শিল্পী শোনালেন ‘পাখি আমার নীড়ের পাখি অধীর হল কেন জানি’ ও রাধারমণ দত্ত রচিত বিচ্ছেদের গান ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’। অনুষ্ঠান শেষ হল আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের চতুর্থ স্তবক ‘ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে’ দিয়ে।
এই অনুষ্ঠানে যন্ত্রসঙ্গীতে সহযোগিতা করেছেন সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (গিটার), সুব্রত ভট্টাচার্য (বেস গিটার), সুবীর চক্রবর্তী (তালবাদ্য), কুণাল চক্রবর্তী (কিবোর্ড), কমল চট্টোপাধ্যায় (অক্টোপ্যাড), শুভ্রজিৎ (ধ্বনি)। এমন একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান পরিকল্পনার জন্য আয়োজকদেরও ধন্যবাদ অবশ্য প্রাপ্য।
অনুষ্ঠান
তিন দিন ধরে দুর্গাপুর রম্যবীণার পরিচালনায় রবীন্দ্র জন্মোৎসব অনুষ্ঠিত হল স্থানীয় দেশবন্ধু ভবনের প্রেক্ষাগৃহে। ইস্পাতনগরীর এই রবীন্দ্রস্মরণ অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত, সুমিতা রাহুত, ঋতুকণা ভৌমিক, সৌমী বন্দ্যোপাধ্যায়, বুলু সাহা, আত্রেয়ী ঘোষ, রিয়া সিংহ, সুদীপ্তা দাস জানা, ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, রিমা ঘোষ, অনিন্দিতা সেনগুপ্ত, বাণী চট্টোপাধ্যায়, উত্তম লাহা, সোমনাথ অধিকারী, শিশুশিল্পী অর্চিষা লাহা, সমৃদ্ধা নায়ক, সৌমাল্য চক্রবর্তী প্রমুখ। আবৃত্তি পরিবেশনে অংশ নেন বিপ্লব মুখোপাধ্যায়, গৌতম চক্রবর্তী, হৃদয় সাঁই, শ্রাবন্তী সাহা, মিতা চৌধুরী, সঞ্চিতা ঘোষ। নৃত্য পরিবেশন করেন জিনিয়া ঘোষ ও অ্যাঞ্জেলিনা। যন্ত্রসঙ্গীত সহযোগিতায় ছিলেন সমীর রায়, বুদ্ধদেব দাস, প্রেমাংশু সেন, বিশ্বায়ন রায় এবং প্রদীপ প্রামাণিক।

অনুষ্ঠানের মুহূর্ত।
এ বছর রবীন্দ্রমেলা ১০ থেকে ১৭ মে রবীন্দ্রসদনে মূলমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চে আটদিনব্যাপী রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন করে। জেলার প্রায় ৫০০ শিল্পী ও ১৩২টি বিদ্যালয়, সংস্থা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ১০ মে রবীন্দ্রমেলার ৫২জন শিল্পী একটি সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এর পর সভাপতি মৃণাল চক্রবর্তী বক্তব্য রাখেন। রোজ আবৃত্তি, নৃত্য, সঙ্গীত, আলেখ্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, শ্রুতিনাটক পরিবেশিত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে মণিমালা চক্রবর্তী ও অরুণাভ চৌধুরী অভিনীত শ্রুতিনাটক ‘রক্তকরবী’ (অংশবিশেষ), রবীন্দ্রমেলার নিজস্ব দু’টি প্রযোজনা ‘ধ্রুপদ এ ধামারে’ এবং নৃত্যালেখ্য ‘উত্তরণ’ উল্লেখযোগ্য। প্রথমটির দায়িত্বে ছিলেন পাপিয়া বসাক ও নৃত্যনাট্যর পরিচালক সুকান্ত দাস। এপ্রিলে তিন দিন রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হয়। প্রায় ৮০০ প্রতিযোগী যোগদান করেন। আবৃত্তি, গান, নাচ, কুইজ়, অঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)