Advertisement
E-Paper

সমৃদ্ধির পথে অনন্য যাত্রা

কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজের ’৯৬ সালের ব্যাচের এটি সপ্তম বার্ষিক প্রদর্শনী। ছিয়ানব্বই সালের ব্যাচ বলেই তাঁরা মজা করে গ্রুপের নাম দিয়েছিলেন ‘নয়ছয়’।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৮

নতুন ধারণার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ করে দেয় কিছু দলগত প্রদর্শনী। এনে দেয় সচেতনতা। বিশেষ করে সেই প্রদর্শনীর ভাবনার নেপথ্যে যদি থাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা চর্চার অভিজ্ঞতা। তবে দল মানেই সমবেত কাজ। সেখানে সকলের কাজই যে উন্নত মানের হবে, তা নয়। তবে সামগ্রিক ভাবে প্রদর্শনী দেখার অনুভব তাৎক্ষণিক হলেও কখনও তা হয়ে উঠতে পারে একটি আস্ত শিক্ষায়তন। মার্চের প্রথমে এ রকমই একটি প্রদর্শনী হল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের চারটি কক্ষ জুড়ে। নিবেদক, আমরা নয়ছয় শিল্পীদল।

কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজের ’৯৬ সালের ব্যাচের এটি সপ্তম বার্ষিক প্রদর্শনী। ছিয়ানব্বই সালের ব্যাচ বলেই তাঁরা মজা করে গ্রুপের নাম দিয়েছিলেন ‘নয়ছয়’। আক্ষরিক অর্থ নেতিবাচক হলেও দলের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই তা নয়। এই নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে তাঁদের একত্রিত হয়ে শিল্পজগৎকে নাড়িয়ে দেওয়া, নয়ছয় করার ভাবনা।

পেশাগত দিকের বিভিন্ন শাখা থেকে এসে মিলিত হয়ে ২৯ বছর পরে আবার ছাত্রজীবনের সেই উদ্যম, উল্লাস এই শিল্পীদলের। প্রাণবন্ত রং, লোভনীয় টেক্সচার তো আছেই। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে সহপাঠীদের সঙ্গে পুনর্মিলনের তাগিদ। সব মিলিয়ে গমগমিয়ে উঠেছিল গ্যালারির পরিসর। কাজগুলি খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, তাতে পরিশ্রম ও সাধনার ছাপ রেখেছেন ২৩জন শিল্পী।

গ্যালারিতে ঢুকে প্রথমেই চোখ টেনে নেয় শিল্পী নির্মল কুমার মল্লিকের ইনস্টলেশন। চারটি স্তরে রাখা সন্নিবিষ্ট নারীর অবতার। সহাবস্থানে উঠে এসেছে কিছু বিরোধী-মুখ। তাদের জড়ো করা মুঠোর পাশে ছুরির ফলা। নির্বিশেষে জেগে উঠেছে প্রতিমার মুখ— হলুদবর্ণা দুর্গা। আর একটিতে ভেসে ওঠা ক্ষতবিক্ষত মুখ। ব্যালান্সের জন্য করা হয়েছে কিছু বাক্যহারা ফিগার। গত বছরের প্রতিমা বিসর্জনের কথা মনে করিয়ে দেয় এই স্থাপত্য। অসাধারণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় মেলানো একটি মেধাবী কাজ।

কাঠের নিজস্ব গুণে যে কোনও ভিন্নধর্মী সৃষ্টিই ভাল লাগা তৈরি করে। ভাস্কর রামকৃষ্ণ রাজবংশী সে রকমই একটি উদাহরণ রাখলেন তাঁর ‘ফিনিক্স’ এবং ‘ভেনগ্লোরি’র দু’টি নির্মাণে। কৌশিক দাসের ইনস্টলেশন একটি সরল উপস্থাপনা। পায়ে চালানো সেলাই মেশিনের উপরিতলে নির্মিত ঘরের আংশিক গৃহসজ্জা। বেশ লাগে কাজটি।

একজন বোধসম্পন্ন শিল্পী হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন অঞ্জন দাস। মিশ্র মাধ্যমের ভূমিতে ড্রয়িং, সেখানে মোচড়ানো দেহের বার্তায় উঠে আসে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির হাহাকার। প্লাস্টিকময় জীবনের এক ধারাবাহিক চিত্রকর্ম। যেখানে অস্তিত্বের প্রতিটি অংশে দূষণ প্রবেশ করে চলেছে। ‘ইন আওয়ার লাইফ’-এ জটপাকানো কাঠামোটি একটি দূষিত মাংসপিণ্ড বলে মনে হয়। পরাবাস্তববাদের ভাষায় ফুটে ওঠে ক্ষয়প্রাপ্ত সত্যের সুর। আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রকৃষ্টতম কাজ দীপঙ্কর রায়ের সিরিজ় ‘রিভার গঙ্গা’। বিস্তৃত রণভূমির মতোই উত্তপ্ত রঙের তীব্র ভূমিকা সেখানে। ক্রেনের মাধ্যমে চলেছে নিথর দেহ। জীবনরেখার নিভৃত কাহিনি। নদীর গর্ভ ও তীর যেন তারই সাক্ষ্যের অপেক্ষায়।

শিল্পী কাঞ্চন রায় কাঞ্জিলাল শৈশবে মনসামঙ্গলের মাধ্যমে গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই লোকশিল্প এবং দেব-দেবীর আখ্যান প্রতিফলিত হয় শিল্পীর কাজে। যেমন, ক্যানভাসের উপরে লালচে-হলুদ ও কালো রং মিশ্রিত অ্যাক্রিলিকের কাজ ‘মনসা চালি’, যা পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির কাজের আদলে তৈরি। আধ্যাত্মবাদের স্থাপত্য, সাদা রঙের সহযোগে আলট্রামেরিন ব্লু, ভারমিলিয়ন ও ইয়েলো অকারে এক আখ্যান তৈরি হয় দীপঙ্কর চন্দর চিত্রকর্মে। শিল্পী বেলি সরকারের ‘নেচার’ কাজটি মৌলিক পাতার সরাসরি ছাপে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। হলুদ, কমলা ও সবুজের সংঘর্ষে সুমিতাভ রায়চৌধুরীর কাজে তৈরি হয়েছে বিমূর্ত আবেদন।

শিল্পী শুভজিৎ তলাপাত্র ব্রাশিংয়ের সৌকর্যে গড়ে তুলেছেন গাছের সুন্দর এস্থেটিক ফর্ম, যে রূপ বর্তমানে প্রায় বিরল। বিমূর্ত উপায়ে নিজের কাজে জলরঙের মিথষ্ক্রিয়া ছড়িয়ে দিলেন শিল্পী শেখর বসু। প্রাকৃতিক জগতের সারাংশ, তরল আকর্ষণে যেন অনুপ্রাণিত করে দর্শককে। শেখর ঘোষের ‘দ্য সিটি অব রিমোর্স’ যেন ভূমিকণার ‘কংক্রিট’ এক উদাহরণ তুলে ধরে। ফ্যান্টাসির প্রতীকে অনুশোচনা রূপক হয়ে ওঠে। শিল্প ও কারুশিল্পের মিশ্র উদ্ভাবনে আগ্রহী শিল্পী সুচরিতা পোদ্দার। টেক্সটাইল ডিজ়াইনের গুরুত্বে তাঁর দেবদেবীর কাজ বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। সুপরিচিত শিল্পী সুদেষ্ণা হালদার বরাবরই কাজ করেন ক্যানভাসের চাহিদা অনুযায়ী। প্রকৃতি ও নারীর সম্পর্ক বস্তুগত হয়েও তাঁর কাজে স্বল্প রঙের সাহচর্যে তৈরি হয় সুররিয়্যালিজ়মের প্রবেশপথ। সন্দীপ বাজপেয়ীর ‘অনামা’ চিহ্নিত ভঙ্গিতে ড্রয়িং কথা বলে ওঠে। অঙ্গবিন্যাস নির্দেশে বাদামির আলোছায়া ছবির ভারসাম্য রক্ষা করে দক্ষ কৌশলে।

গ্রামীণ গাথার নমুনায় যথাযথ মিতা রায়ের কাজ। সাধনা বর্মনের স্বপ্নের প্রকৃতি মন্দ নয়। চক্রাকারের আবর্তে ডেস্টিনির পথ দেখিয়েছেন তন্ময় চক্রবর্তী। অভিজিৎ সেনগুপ্তের মিশ্র মাধ্যমের তিনটি স্তর ও সুদেষ্ণা মজুমদারের কালি কলমের ‘বন্ডিং’ স্মার্ট পরিবেশন। অন্ধকারভেদী ‘মহাকুম্ভ প্রয়াগরাজ’-এ প্রদীপ চন্দর ইমপ্যাস্টো (অ্যাক্রিলিক) আঁচড় জোরালো ভূমিকায় জেগে ওঠে। এ ছাড়া ‘আর্বান সার্চ’ নিয়ে স্বচ্ছ ব্রাশিংয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন শিল্পী শোভন মুখোপাধ্যায়।

এ ধরনের গ্রুপের প্রতি আস্থা রেখে বলতে হয় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সেই বিখ্যাত লাইন— ‘কতো কী করার আছে বাকি।’ মূলত এই ভাবনা অনুসরণ করেই দলটি তাঁদের যাত্রাপথে নতুন পালক যোগ করতে আগ্রহী।

Art exhibition Academy of Fine Arts
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy