বিংশ শতকের প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে স্বদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুণিজনদের সমাগমে সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্পকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নৃত্যের পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতন। সম্প্রতি আকার প্রকার প্রদর্শশালায় আয়োজিত শিল্পী গৌরী ভঞ্জের ‘ক্রাফটিং ভিশনস: দি আর্ট অব গৌরী ভঞ্জ’ প্রদর্শনীটি তেমনই এক গৌরবান্বিত সময়ের সাক্ষ্য বহন করে। শিল্পসমালোচক দেবদত্ত গুপ্ত দ্বারা কিউরেটেড এই মনোজ্ঞ প্রদর্শনীটি তাই শিল্পকর্মের সঙ্গে ঐতিহাসিক তাৎপর্যেও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
বস্তুবিশেষের চাক্ষুষ রূপকে অলঙ্করণের অসাধারণ মোড়কে উপস্থাপনের পুরোধা শিল্পী গৌরী ভঞ্জ। তাঁর বহুমাত্রিক শিল্পকলা, যেমন আলপনা, সূচিশিল্প, বাটিক চিত্রকলা, চামড়ার কাজ ইত্যাদিতে তাই দেখা যায় বাস্তব, কল্পনা ও আলপনা যেন মিলেমিশে এক সুদৃশ্য সৃজনী ক্রীড়াঙ্গনে পরিণত। শিল্পী নন্দলাল বসুর তিন সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা গৌরী ভঞ্জ (১৯০৭-১৯৯৮)। ফলত শিশুকাল থেকেই পিতা নন্দলাল ও মাতা সুধীরা দেবীর শৈল্পিক বাতাবরণে তাঁর বেড়ে ওঠা৷ সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অশেষ স্নেহ ও সান্নিধ্য তাঁর মনোজগতকে এক সৃষ্টিশীল মানবিকতার সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছিল।
ভারতীয় শিল্প আন্দোলনের পটভূমিতে গৌরী ভঞ্জ ছিলেন এক নীরব কর্মী, যিনি শুধু চারু ও কারুকলার মাধ্যমেই নিজেকে সমৃদ্ধ করেননি, বরং তৎকালীন সময়ে নারীদের স্বনির্ভরতা, গৃহসজ্জা, সৃজনশীল বসবাসের ভাবনা, সমবায় সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়গুলিতেও দিগন্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে নিজের প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর পিতার যে মূলমন্ত্র ‘আর্ট ইজ় আ ওয়ে অব লাইফ’— সেই ভাবনার আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়ন করেছিলেন গৌরী, যা কিনা সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথ তাঁর জার্মানি সফরের পরে বাউহস মুভমেন্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতনের দৈনন্দিন জীবনচর্যায় প্রবর্তন করেন। ১৯০৭ সালে তৎকালীন বিহারের মুঙ্গের শহরে জন্মগ্রহণ করেন গৌরী ভঞ্জ। পরবর্তীকালে কলাভবনের প্রথম পর্যায়ের শিক্ষার্থী হিসেবে হয়ে ওঠেন অন্যতম। পারিবারিক সূত্রে শিল্পময় পরিবেশে বেড়ে ওঠায় অল্পকালের মধ্যেই তিনি ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে এক সামঞ্জস্য গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সঙ্গে তাঁর পিতার প্রভাবে ভারতীয় প্রাচীন চিত্ররীতি, অজন্তার ভিত্তিচিত্র ও লৌকিক চিত্রভাবনার সঙ্গেও অনায়াসেই পরিচিত হন। ফলত যে কোনও বস্তুবিশেষকে সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাদের এক রেখাভিত্তিক আলঙ্কারিক রূপ দিতে তিনি যথাসময়ে অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠেন। আমাদের দেশজ পটচিত্র, আলেখ্য, আলপনা শৈলীগুলির পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে তিনি এক নতুন ও অভিনব চিত্রভাষা রচনায় তাই সক্ষম হয়েছিলেন।
এ ছাড়া কারুশিল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী যখন জাভা থেকে ‘বাটিক’ শিল্পের প্রকরণ শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন, তখন গৌরী ভঞ্জ ছিলেন এই নতুন মাধ্যম ও প্রযুক্তির অন্যতম প্রয়োগকারী ও প্রসারক। কলাভবনের পাঠ্যক্রমে তিনি যুক্ত করেন বাটিকের অভিনব এই মাধ্যম, কারণ তাঁর ছাত্রীজীবনের পরে তিনি কলাভবনের অধ্যাপিকা হিসেবে যুক্ত থেকেছেন প্রায় তিন দশকেরও বেশি। তাঁর বাটিক শিল্পে এ জন্যই ভারতীয় মোটিফ ছাড়াও প্রকৃতিনির্ভর বহু রূপ ও জ্যামিতিক আকার-আকৃতি মিশে গিয়ে এক অনন্য শৈলী জন্ম নেয়, যা কিনা সময়ের সঙ্গে ‘শান্তিনিকেতনী শৈলী’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
সেই সময়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধানের মূল পাণ্ডুলিপিটি হাতে লেখা ও চিত্রায়ণের দায়িত্ব বর্তেছিল স্বয়ং নন্দলাল বসুর উপরে। তাই ওই অভিনব পাণ্ডুলিপি অলঙ্করণের জন্য গৌরী ভঞ্জ-সহ আরও কিছু সহযোগী শিল্পী নিয়ে নন্দলাল কাজটি সম্পূর্ণ করেন। এই প্রদর্শনীতে তার দু’-একটি নমুনা আমরা দেখতে পাই। এই অতীব নান্দনিক সংবিধান গড়ে তোলার মাধ্যমে, আজ তাই জাতীয় ইতিহাসে গৌরী ভঞ্জের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়।
শিল্পের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল গভীর ভাবে ধ্যাননিষ্ঠ ও আধ্যাত্মিক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিল্পের মাধ্যমে আত্মবিকাশ ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার লাভ সম্ভবপর। কলাভবনে অধ্যাপনার সুবাদে সেই শিল্পমনস্ক ভাবনায় তাই তিনি বহু ছাত্রছাত্রীকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ভাবেই তিনি ‘আলপনা’কে নিছক ধর্মীয় লোকশিল্পের পর্যায়ে আটকে না রেখে, তার উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন এক আধুনিক নকশাভিত্তিক শিল্পরূপে। আলপনাকে তিনি একটি পরিশীলিত ভিসুয়াল ভাষায় পরিণত করেন। তাই তাঁর আলপনার সুললিত ছন্দোময় রেখাভিত্তিক স্পন্দনে হয়তো বা এক ‘স্থানিক চেতনার রেখাচিত্র’র আভাস পাওয়া যেতে পারে। এই প্রদর্শনীতে সে রকমই পটে আঁকা ছোট-বড় দু’একটি চমৎকার নজির দেখতে পাওয়া যায়।
শিল্পতাত্ত্বিক ভাবনায় আবদ্ধ না থেকে তিনি বরং এক আত্মিক টানের অনুভূতি থেকে শিল্পসৃষ্টি করার ফলে তাঁর কাজগুলি হয়ে ওঠে সাবলীল ও সংবেদনশীল। যেমন ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া’ কাজটি। দীর্ঘায়িত এই স্ক্রোল ছবিটি আষাঢ় মাসের বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি থেকে শুরু করে আশ্বিনের আকাশভরা ছেঁড়া মেঘের ভেলা দিয়ে সমাপ্ত হয়। প্রকৃতির এই অনায়াস ঋতু পরিবর্তন, পাশাপাশি মানুষের সহাবস্থান, তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছবিটিকে প্রাণোচ্ছল ও গতিময় করে তুলেছে। অন্য দিকে, পোস্টকার্ড আকারে চিত্রিত তাঁর বহু প্রকারের ফুল, পাতা, কীট, পতঙ্গের রূপ। জবা, মুচকুন্দ, ফুরুস ইত্যাদি ফুলের বাস্তবিক গঠন ও অলঙ্করণের পারস্পরিক আদান-প্রদানে নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়ে প্রকৃতিপাঠের ছবিগুলি এক অনবদ্য মাত্রা অর্জন করে।
শিল্পী বহু প্রকারের মাধ্যম ও প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। বাটিকের কাপড়ে ছবি এঁকেছেন যেমন, তেমনই আবার চামড়ার উপরে বাটিক করে ব্যাগ বা ফাইল কভারকে এক নান্দনিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সেই যুগে তিনি হলেন প্রথম নারী, যিনি রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্যে নটী রূপে নৃত্য প্রদর্শন করে বহুল প্রশংসিত হন। পরবর্তী সময়ে তাঁর আঁকা ‘নটী’ ছবিতে সেই ভঙ্গিমা প্রকাশ পাচ্ছে ছন্দে, রেখায় ও রঙে। শিল্পের বহুমাত্রিক ধারা তাঁর কাজে তাই সম্পৃক্ত হয়ে, আধুনিকতার বিন্যাসে পুনর্গঠিত করেছে এক মৌলিক শিল্পভাষাকে।
বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রকৃতি, গ্রামীণ জীবন, পুরাণ, মহাকাব্য ইত্যাদি থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন শিল্পী এবং সর্বদাই সহজ, সরল রূপকে প্রকাশ করেছেন। তবে বিষয় যা-ই হোক না কেন, তাঁর সৃষ্টির মূলমন্ত্র ছিল ‘নন্দন চেতনার প্রকাশ’। যেমন প্রদর্শিত ‘কৃষ্ণ গোয়ালিনী’ ছবিটিতে ওড়িশার পরম্পরাগত পটচিত্রের প্রভাব দেখা গেলেও, কাজটি অনুকরণ না হয়ে এক বিশেষ অনুপ্রেরণায় রচিত। তেমনই তাঁর পিতার সহকর্মী হিসাবে হরিপুরা পোস্টার-এর আর এক নমুনা ‘দুই পাখি’। দৃঢ় তুলির টানে আলঙ্কারিক দু’টি পাখির যে রূপ, তা প্রতিফলিত করে এক সুদক্ষ শিল্পীর অস্মিতা। অন্য দিকে ‘রিদম অব দ্য সি’ ছবিটিতে শিল্পী নীল, সাদা রঙের বহুমাত্রিক টোনাল গ্রেডেশনের মাধ্যমে সমুদ্র ও তার বিশালকার ঢেউকে উপস্থাপিত করেছেন। ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে ব্যাপ্তির অনুভূতিকে দৃশ্যায়িত করেছেন। অথচ জাপানি শিল্পী হোকুসাইয়ের ‘ওয়েভস’ থেকে এই সামুদ্রিক ঢেউয়ের চিত্রটি একেবারে আলাদা। কারণ, দেশজ এই ছবিটিতে প্রকাশ পেয়েছে ভারতীয় শিল্পীর চৈতন্যময় সত্তা।
গৌরী ভঞ্জের শিল্পচর্চা শুধু একটি প্রথাগত কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাঁর কাজে নন্দনতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, সামাজিক সচেতনতা, নারীর দৃষ্টিভঙ্গি ও আধ্যাত্মিক চেতনার এক সম্মিলিত রূপ পরিলক্ষিত হয়। তাঁর শিল্পকর্ম তাই লৌকিক ঐতিহ্য ও আধুনিক নান্দনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক অভিনব শিল্পদর্শন নির্মাণে সক্ষম। তাই এই প্রদর্শনীটি প্রমাণ করে যে, গৌরী ভঞ্জের শিল্পভাষা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিশেষ প্রেরণাস্বরূপ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)