সম্প্রতি চিত্রলেখা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট আয়োজিত ‘সনৎ কর আর্কাইভ’ থেকে শিল্পীর সত্তরের দশকের এচিং ও এনগ্ৰেভিং-এর একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, যা যথার্থই তাৎপর্যবাহী। হার্ভার্ট রিডের একটি কথা নিজের স্কেচ খাতায় এক সময়ে উল্লেখ করেছিলেন সনৎ কর। তা হল— ‘দ্য ওয়র্ল্ড অব আর্ট ইজ় আ ওয়র্ল্ড উইদাউট জাস্টিস।’ এই প্রদর্শনী সেই কথা মনে করায়। শিল্পসৃষ্টি তখনই সম্ভব, যখন ধরাছোঁয়ার জগৎটাকে ছাড়িয়ে একটা অতিবাস্তবকে ধরা যায়। সেটিকে অনেকে চরম সৌন্দর্য বা প্রেমও বলে থাকেন। সেই উত্থান থেকে আবার নেমে এসে এ জগতের মুখোমুখি হওয়া। এই দু’টির মাঝামাঝি জায়গাতেই শিল্পের সাফল্য। সেটাই যেন বারবার ফিরে এসেছে সনৎ করের শিল্পকর্মে। এক অনন্য উপলব্ধির ছাপ।
সত্তর দশকের যে কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী, সেই সব কাজের সূত্রপাত তাঁর স্কেচ খাতাগুলি। সেখানকার খসড়া, ড্রয়িং, তার নেপথ্য ভাবনা অচিরেই পূর্ণ রূপ গ্রহণ করে, তাঁর ধাতু-তক্ষণের কাজে। সনৎ কর অবশ্য তাঁর এচিং স্টুডিয়ো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বহু যুগ আগে। তারই সঙ্গে কমিউনিটি গ্রাফিক্স ওয়র্কশপের কাজও চালু রাখেন। একজন ব্লকমেকার তাঁকে সন্ধান দেন ছাপা কালির নাইট্রিক অ্যাসিড সহিষ্ণুতার। তারপর থেকেই নানা ভাবে ছাপচিত্র করতে শুরু করেন তিনি। জিঙ্ক প্লেটে এচিং করার সময়ে তিনি নিজস্ব কিছু পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন, যেমন নাইট্রিক অ্যাসিড রেসিস্ট্যান্ট লেড গ্রাফাইট পেনসিলের ব্যবহার বা প্রিন্টিং ইঙ্কের ব্যবহার। প্রায় একই সময়ে, কাঠের প্লেট থেকে এন্টাগ্লিয়ো পদ্ধতিতে প্রিন্ট নেওয়ার চেষ্টায় সফল হন। প্রথমে সেগুন কাঠের প্লেট এবং তারপর শান্তিনিকেতনে গিয়ে প্লাইউডের প্লেট থেকে প্রিন্ট বার করতে সক্ষম হন তিনি। পরবর্তীকালে সানমাইকা প্লেটের উপরে খোদাই করে বা বিশেষ ভাবে তৈরি কার্ডবোর্ড প্লেটে কাজ করে তার চেয়েও সুন্দর প্রিন্ট বার করার পদ্ধতি তিনিই উদ্ভাবন করেন।
এক সময়ে শিল্পীর ধারণা ছিল, সংস্কৃত ভাল করে না জানলে কিছুতেই ভাল ছবি আঁকা যায় না। সেই কারণে সংস্কৃত শিক্ষা থেকেও বিরত থাকেননি। হাতিবাগানে একটি টোল খুঁজে বার করে সেখানকার এক পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত পড়তে যেতেন। অর্থাৎ একেবারে সূচনার দিন থেকেই এই সিদ্ধান্তে তিনি স্থিত ছিলেন যে, শিল্পের স্বার্থে যা যা প্রয়োজন, তা নিজ অস্তিত্বে আত্মস্থ করতে কোনও দ্বিধা রাখা উচিত নয়। এই শিক্ষাব্রতের এক অসামান্য ছাপ দেখা যায় সনৎ করের শিল্পদক্ষতায়।
যেহেতু তিনি ছাপচিত্র মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত, হয়তো সেই কারণেই তাঁর সৃষ্টিশীল মন নানা রকম উদ্ভাবনের দিকে তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। ভারতীয় ছাপচিত্রের ইতিহাসে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর যে অনুসন্ধান এবং সেই সন্ধানজাত যে নতুন পথের আবির্ভাব, তা কেবলই ভারতীয় ছাপচিত্রের ক্ষেত্রে দিগন্ত উন্মোচনকারী নয়, বিশ্বের ছাপচিত্রের ইতিহাসেও এক নতুন সংযোজন। বস্তুত শুধুমাত্র দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বেই উড এন্টাগ্লিয়োর জনক তিনি।
এখানে একটি কথা অত্যন্ত জরুরি। মাধ্যমগত বিচারে যে সমস্ত কাজকে আমরা পৃথক ভাবে ‘ছাপাই চিত্র’ বলছি, ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, মাধ্যমের পরিচয় ছাড়া এই সমস্ত কাজকে অনায়াসে তাঁর পূর্ণ মাত্রার পেন্টিং বলা যায় কি না। সনৎ কর সেই বিরল শিল্পীদের একজন, যিনি কারিগরি দক্ষতার তুঙ্গে পৌঁছেও শিল্পের অন্তর্বস্তুকে পরিহার করেননি, বরং তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
সত্তরের দশকের একেবারে গোড়ায়, দু’টি ভিন্ন প্লেট জুড়ে যে বড় প্রিন্টের জন্ম— ‘ওহ্, দিস ওয়র্ল্ড’, সেখানে এক চিত্রাংশে নিজস্ব হস্তরেখায় তিনি বুনে দিয়েছেন শব্দপ্রতিমাকে। এখানে তিনি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন একটি অমোঘ প্রশ্নে— মানুষ মানুষকে ভালবাসে না কেন?
যেন তাঁর এই প্রশ্ন থেকেই ১৯৭৩ সালের স্কেচ খাতায় ‘ইটারনাল কাপল’-এর অনুসন্ধান আমরা দেখতে পাই। তার পরে বৈষ্ণব পদাবলির উপরে ভিত্তি করে ১৯৭৪ সালে পদাবলির মাধুর্যমণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি। শিল্পী কি অন্তত সাময়িক ভাবে মানুষের প্রেমহীন অস্তিত্বে দৈবিক মধ্যস্থতা চেয়েছেন?
পুরাণকল্প, স্বপ্ন এবং শিল্পীর অবচেতন মনের ফসল একটি মায়াবী হাতের মুদ্রা। এই দু’টি হাতের সুন্দর মুদ্রা যেন মানুষের এই পৃথিবী থেকে অন্য এক পৃথিবীতে উত্তরণের সঙ্গী, পথপ্রদর্শক। এখানে শিল্পরসিক দেখবেন ‘ডেইটি অব পিস’। অপূর্ব ছাপচিত্র। ঠিক সেই রকম সুন্দর মুদ্রাটি বারবার ঘুরেফিরে আসে, ‘বাউল’ এবং আরও বিভিন্ন ছবিতে।
পরে আবার স্কেচখাতার ড্রয়িং থেকে উঠে আসে তাঁর আপন হাতে গাঁথা একটি ফুলের মালা ‘গারল্যান্ড’।
বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২-এ শিল্পীর আঁকা ‘রাবণ’ ছবিতে অনবদ্য বিমূর্তকরণ দেখা যায়। এ ছাড়াও ‘হান্টার’ ছবির নানা রঙের প্রাচুর্যের মধ্যে দু’টি একাগ্ৰ চোখ দর্শকের মন কাড়ে।
চিত্রলেখা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ‘সনৎ কর আর্কাইভ’ থেকে তুলে এনে একটি অসাধারণ প্রদর্শনী শিল্পপ্রেমীদের উপহার দিলেন, যেখানে শিল্পী সনৎ কর এক অন্য মাত্রার ছাপ রেখেছেন, সৃষ্টি করেছেন এক অবিস্মরণীয় শিল্পসম্ভার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)