Advertisement
E-Paper

রায় বনাম ঘটক

অভিযান’ দেখতে গিয়েছেন সত্যজিতের অনুরোধে। মাঝপথেই উঠে পড়লেন। প্রকাশ্যেই সত্যজিৎকে গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। কেন মেজাজ হারিয়েছিলেন?

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ০০:০২
অযান্ত্রিক-এর শ্যুটিং

অযান্ত্রিক-এর শ্যুটিং

অভিযান’ দেখতে গিয়েছেন সত্যজিতের অনুরোধে। মাঝপথেই উঠে পড়লেন। প্রকাশ্যেই সত্যজিৎকে গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। কেন মেজাজ হারিয়েছিলেন? মদ্যপান করে একদিন তুষার তালুকদারকে বলেছিলেন তার উত্তর।

‘‘মৃণাল ছবিটি দেখে এসে বলল, ঋত্বিক ছবিটি দেখে এসো। তুমি দেখবে মানিকবাবু বহু জায়গায় অযান্ত্রিক-এর প্রায় হুবহু কপি করেছেন। আমি ইন্দিরাতে ছবিটি দেখতে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই! অসংখ্য ফ্রেম এক্কেবারে হুবহু এক। মাঝপথে খেপে গিয়ে উঠে পড়লাম। কারণ আমার মনে হল, ছবিটা কিছুই দাঁড়ায়নি।’’

অথচ, নিজের ‘অযান্ত্রিক’ রিলিজ হওয়ার পর তার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত সত্যজিৎ রায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন! যখন সত্যজিতের ‘অশনি সঙ্কেত’ রিলিজ করল, তখনও!

ঋত্বিক হাসপাতালে। ঠিক করলেন উৎপল দত্তর ‘ব্যারিকেড’ দেখতে যাবেন। হঠাৎ করেই মত বদলে দেখলেন ‘অশনি সঙ্কেত।’ সেবারও হল থেকে বেরিয়ে হতাশ! বললেন, ‘‘অশনি সঙ্কট দেখিয়ে কেন আমার মতো অসুস্থ লোককে আরও সঙ্কটে ফেললে। মানিকবাবু চূড়ান্ত ধেড়িয়েছেন। শেষ দৃশ্যটা মনে করো, সেখানে মন্বন্তরের কোপে পড়া হাজার হাজার ভুখা মানুষের মিছিল দিয়ে ছবি শেষ হয়েছে, তাই তো?’’

ঋত্বিক মনে করতেন, গল্পের মতোই শেষটা হওয়া দরকার ছিল।

বলেছিলেন, ‘‘মৃত্যুর মিছিল নয়, নতুন জীবনের সৃষ্টি। এইটাই শেষ কথা।’’ নিজেও সব ছবির শেষে তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।

এর মানে এই নয়, মানিকের সঙ্গে ঝগড়া ছিল ঋত্বিকের। ৬৫-তে সত্যজিতের সুপারিশেই তাঁর পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কাজ হয়। শোনা যেত, সারা কলকাতা ঘুরে ঋত্বিক লেক রোডে সত্যজিতের বাড়ি দেখিয়ে দিতেন ট্যাক্সিওয়ালাকে। আর বাইরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতেন। ড্রাইভারকে কেবল জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘কত?’’

সত্যজিৎ মিটিয়ে দিতেন বিল!

জানলায় এসে দাঁড়াবেন চিরচেনা সওয়ারিকে দেখতে, ততক্ষণে ঢো‌লা পঞ্জাবি, কাঁধে ব্যাগ ভবা হাওয়া!

স্মৃতি থেকে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই চিনতেন। সেটা ‘ছিন্নমূল’ ছবির সুবাদে। ফিল্ম সোসাইটির একটা মিটিং-এ প্রথম আলাপ হয়। স্মৃতি থেকে তিনি বলছেন, ‘‘সে সময় বোম্বেতে বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করছে, বিমল রায়ের ছবির চিত্রনাট্য লিখছে। তার কিছু আগে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে, সে ছবি দেখেছে এবং দেখে তাঁর খুবই বেশিরকম ভালো লেগেছিল। সে-কথা সে প্রাণ খুলে আমার কাছে বলে। কিন্তু আমার কাছে যে-জিনিসটি সব চাইতে ভালো লেগেছিল সেটা সে যে ভাবে ছবিটাকে বিশ্লেষণ করেছিল, তার কয়েকটা দৃশ্যকে, সেটা থেকে আমার মনে হয়েছিল, ঋত্বিক যদি ছবি করে তাহলে সে খুব ভালোই ছবি করবে।’’

সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ দেখে কয়েকটি দৃশ্যের সমালোচনাও করেছিলেন ঋত্বিক। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘দুর্গা মারা যাওয়ার আগের ঝড়বৃষ্টির দৃশ্য, সেটা বেশ কাঁচা। দুর্গার মৃত্যুর খবরে হরিহর বা সর্বজয়ার প্রতিক্রিয়াও ঠিকমতো ফোটেনি।’’ তুষার তালুকদারকে তার কারণ বলতে গিয়ে ঋত্বিক বলছেন, ‘‘অভিনয়ের দুর্বলতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে দক্ষিণা ঠাকুরের তারসানাইয়ের সুর।’’

সত্যজিৎ তাঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘‘আমরা যারা প্রায় গত চল্লিশ বছর ধরে ছবি দেখছি, তাদের মধ্যে তো প্রায় ত্রিশটা বছর কেটেছে হলিউডের ছবি দেখে, কেন-না কলকাতায় তার বাইরে কিছু দেখবার সুযোগ ছিল না সে সময়টা। উনিশো ত্রিশ বা পঁচিশ থেকে শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বা ষাট অবধি আমরা হলিউডের বাইরে খুব বেশি ছবি দেখতে পারিনি।... কিন্তু ঋত্বিক এক রহস্যময় কারণে সম্পূর্ণ সে-প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাঁর মধ্যে হলিউডের কোনও ছাপ নেই। ... ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল, আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট।’’

ঋত্বিকের স্মরণসভায় সভাপতি ছিলেন সত্যজিৎ রায়।

শোকসন্তপ্ত সরলা মেমোরিয়াল হল। মঞ্চে মৃণাল সেন, বিজন ভট্টাচার্য। ছিলেন কবি পূর্ণেন্দুও। লিখছেন, ‘‘সভাপতি শেষ করলেন তাঁর ভাষণ। দর্শক বা শ্রোতা নিস্পন্দ। এ বার তিনি পাঠ করবেন একটি শোকপ্রস্তাব। পাঞ্জাবির পকেট ঘাঁটছেন চশমার জন্যে। তখন চোখে পড়ল, তাঁর চোখের প্রান্তে একবিন্দু গোপন অশ্রু!’’

Ritwik Ghatak Satyajit Ray
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy