E-Paper

গানে গানে সলিল স্মরণ

বাংলা গানের দীপ্যমান সূর্য কাজী নজরুল তখন অস্তায়মান। এই সময়টাতে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে সলিল চৌধুরীর আবির্ভাব। গণসঙ্গীত দিয়েই শিল্পীজীবনের শুরু।

সৌম্যেন সরকার

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৩৯
মঞ্চে ইমন এবং অন্তরা

মঞ্চে ইমন এবং অন্তরা

চল্লিশ দশকের মধ্যপর্ব। বাংলা গানের দীপ্যমান সূর্য কাজী নজরুল তখন অস্তায়মান। এই সময়টাতে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে সলিল চৌধুরীর আবির্ভাব। গণসঙ্গীত দিয়েই শিল্পীজীবনের শুরু। তাঁর সক্রিয় শিল্পীজীবনের মধ্যগগনে রচিত ওজস্বী বাস্তবধর্মী গানগুলি একটি নতুন চেতনার সঞ্চার করেছিল।

অনেকের মতে, সলিলের সাঙ্গীতিক প্রতিভার সুবর্ণ ফসল ফলেছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যে ব্যাপ্ত সময়সীমায়। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তাঁর সত্তর বছরের জীবনপর্বে সলিল প্রতি দশকেই তাঁর সৃজনশীল গভীরতার প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁর কাব্য ও সুরে একটা বলিষ্ঠ চেতনা অনুভূত হয়। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, সলিল পাশ্চাত্য কর্ডের ব্যবহারে অদ্বিতীয় সঙ্গীতকার ছিলেন। এখনকার গানে যে কর্ড চার্টের ব্যবহার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে গৃহীত হয়, তিনিই প্রথম তা শুরু করেছিলেন।

জনতার মিছিলের গান থেকে, রোম্যান্টিক স্বপ্নমেদুর আবেগসমৃদ্ধ সুখ-দুঃখের, প্রেম-বিরহের আর্তিও তিনি অনায়াস দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতেন গানের কাঠামোয়। স্বরগ্রামের বিচিত্র মেলবন্ধনে নিয়ত খুঁজে পেতেন নতুন সৃষ্টির প্রেরণা। গীতিকার ও সুরকার হিসেবে নিজের যোগ্য আসনটি অধিকার করার পাশাপাশি, চলচ্চিত্রের সঙ্গীতকার হিসেবে তাঁর প্রতিভা বিকাশের ভিন্নমুখী আর একটি পথ প্রশস্ত হয়েছিল।

সলিল চৌধুরীর ৯৯তম জন্মদিন উপলক্ষে আনন্দপুর সলিল চৌধুরী বার্থ সেন্টেনারি সোসাইটি এবং সুরধ্বনি উপস্থাপন করল সলিল-সৃষ্ট গানগুলি নিয়ে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান, ‘আমার টিকিট কাটা অনেক দূরের’।

জি ডি বিড়লা সভাগৃহে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হল সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষকে। এই অনুষ্ঠানের বিন্যাস করেছিলেন কবি শুভ দাশগুপ্ত। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং পরিচালনায় ছিলেন অন্তরা চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর সৃষ্টির ভান্ডার থেকে তাঁরই গান চয়ন করে সাজানো হয়েছিল এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের সূচনায় শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবেশন করলেন ‘জাগো মোহন’ গানটি, সঙ্গে ক্যালকাটা কয়্যারের শিল্পীবৃন্দ। ইমন চক্রবর্তী গাইলেন ‘না জানে কিঁউ’ এবং ‘পথে এ বার নামো সাথী’। গান দু’টির সঙ্গে ক্যালকাটা কয়্যারের হারমনি পার্টগুলি সত্যিই প্রশংসনীয়। রাঘব চট্টোপাধ্যায় শোনালেন ‘পথ হারাব বলেই এ বার’ এবং ‘বাজে গো বীণা’। রকেট মণ্ডল গিটারে বাজিয়ে শোনালেন ‘রজনীগন্ধা’র একটি গান।

শিশুশিল্পীদের দিয়ে অন্তরা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান সুরধ্বনি নিবেদন করল ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে’ এবং ‘নাচো তো দেখি আমার পুতুল সোনা’। দু’টি গানই সুন্দর ভাবে পরিবেশিত হল। এর পর পরিবেশিত হল ‘কুয়াশা আঁচল খোলো’ ও ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ (শুভঙ্কর ভাস্কর), ‘হেঁইয়ো হো হো হেঁইয়ো’ ও ‘আর দূর নেই দিগন্তের বেশি দূর নেই’ (লোপামুদ্রা মিত্র), ‘শোনো কোনও একদিন’ ও ‘জিন্দেগি আজ ফির ভরি ভরি সি হ্যায়’ (সুজয় ভৌমিক), ‘ভালবাসি বলেই ভালবাসি না’ ও ‘এইবার স্বপ্নের বন্ধন খুললাম’ (হৈমন্তী শুক্লা), ‘গুজর গয়ে দিন’ ও ‘ঝনন ঝনন’ (মনোময় ভট্টাচার্য), ‘কহিঁ দূর জব দিন ঢল যায়ে’ ও ‘দূর নয় বেশি দূর ওই’ (সৈকত মিত্র), ‘কিছু তো চাহিনি আমি, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকি’ (শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘যারে যা আমার আশার কূল রেখে যা’ ও ‘আজ তবে এইটুকু থাক’ (ইন্দ্রাণী সেন), ‘কে যাবি আয় ওরে আমার সাধের নায়ে’ (শুভমিতা), ‘সুহানা সফর’ ও ‘এই রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’ (রূপঙ্কর বাগচী) এবং অন্তিমে সম্মেলক গান পরিবেশিত হল কল্যাণ সেন বরাটের পরিচালনায় ‘মানব না এ বন্ধনে’ ও ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’।

এই গানগুলির মধ্যে রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘বাজে গো বীণা’, সুজয় ভৌমিকের কণ্ঠে ‘জিন্দেগি আজ ফির ভরি ভরি’, হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘ভালবাসি বলেই ভালবাসি না’, মনোময় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘ঝনন ঝনন’ উল্লেখযোগ্য। সৈকত মিত্রের গাওয়া ‘দূর নয় বেশি দূর ওই’ গানের সঙ্গে শ্রোতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বেশ ভাল লাগল। ইন্দ্রাণী সেনের কণ্ঠে ‘আজ তবে এইটুকু থাক’ শুনতে ভাল লাগে।

ক্যালকাটা কয়ার সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে কল্যাণ সেন বরাটের পরিচালনায় একটি বিশেষ ভূমিকা বহন করেছিল, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অন্তরা চৌধুরীর ধন্যবাদ প্রাপ্য, তাঁর প্রবাদপ্রতিম পিতৃদেব সলিল চৌধুরীর ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং বর্তমান প্রজন্মের তরুণ শিল্পী অর্কদীপ মিশ্র ও তৃষা পাড়ুইকে এই গানের মধ্যে নিমজ্জিত করার জন্য। দু’জনেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের গানগুলি পরিবেশন করেছেন।

শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি গানই সুগীত। বিশেষ করে ‘অন্নদাতা’ ছায়াছবির গান ‘রাতো কে সায়ে ঘনে’ অনবদ্য পরিবেশনা। শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সাথী রে তুঝ বিন’ গানটি শুনতে ভাল লাগে। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন দেবাশিস বসু। ওঁর উপস্থাপনা যথাযথ।

যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন বুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়। অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বাপি উকিল (গিটার), তাপস ভৌমিক (পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান), অর্ণব ও মণীশ চক্রবর্তী (কি বোর্ড), দিব্যেন্দু সাঁতরা (লিড গিটার), সৌম্যজিৎ পাল (সেতার), জলধর বৈদ্য (তবলা), দিলীপ মুখোপাধ্যায় (ঢোলক ও থুম্বা), প্রশান্ত মল্লিক (অক্টোপ্যাড) প্রশান্ত (বেস গিটার)। যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের সাধুবাদ জানাই তাঁদের বিশেষ ভূমিকার জন্য। ওঁদের সহযোগিতা অনুষ্ঠানটিকে বহুলাংশে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। অনুষ্ঠানের দৈর্ঘ্য আরও সংক্ষিপ্ত হলে মনে হয় শ্রোতারা উপভোগ করতেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Salil Chowdhury Programme tribute

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy