Advertisement
E-Paper

রাজনৈতিক সংবাদকেও গৃহস্থের রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন

বরুণ সেনগুপ্ত তাঁর সময়কালে অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। সোজা কথায় যাকে গ্ল্যামার বললে ভুল হয় না। প্রিন্ট মিডিয়ার পতাকা উচ্চে তুলে রাখা এই সাংবাদিককে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন দেবাশিস ভট্টাচার্যবরুণ সেনগুপ্ত তাঁর সময়কালে অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। সোজা কথায় যাকে গ্ল্যামার বললে ভুল হয় না। প্রিন্ট মিডিয়ার পতাকা উচ্চে তুলে রাখা এই সাংবাদিককে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
বরুণ সেনগুপ্ত।

বরুণ সেনগুপ্ত।

নায়ক অনেকেই হন। উত্তমকুমার একজনই। বরুণ সেনগুপ্ত সম্পর্কে এটাই আমার প্রাথমিক অনুভব। অভিজ্ঞতাও।

প্রায় চার দশক সাংবাদিকতায় থেকে বহু বরেণ্য, যশস্বী সাংবাদিককে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁরা কেউ অগ্রজ, কেউ আমারই সম-সময়ের, কেউ বা অনুজপ্রতিম। বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-কর্মকুশলতায় তাঁরা হয়তো অনেক এগিয়ে। কিন্তু বরুণবাবুর মতো আলোকময় নন। সব আলো কেমন করে যেন তাঁর মুখেই পড়ত। সে জন্যই তিনি অনন্য।

দু’-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

একবার মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামে কিছু লোক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আপনারা বরুণ সেনগুপ্তকে সামনে দেখতে পান? রোজ দেখেন?’’ প্রথমে প্রশ্নটি বুঝিনি। পরে মালুম হল, বরুণ সেনগুপ্ত নামক ব্যক্তিটি যে ধরাছোঁয়ার আওতায় থাকতে পারেন এবং নিত্যদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়— সেটা তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না!

বরাহনগর বা ডানলপের দিকে থাকতেন আনন্দবাজারের এক প্রবীণ কর্মী। কোনও কারণে তাঁর একদিন পুলিশি সহায়তার দরকার হয়েছিল। তখন সদ্য চাকরি পেয়েছি। দেখছি, সিনিয়র দাদারা শশব্যস্ত হয়ে বড় বড় পুলিশ কর্তাদের ফোন ঘোরাচ্ছেন।

চুপচাপ বসে ছিলেন বরুণদা। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে বললেন, ‘‘এস পি-আই জি না করে থানায় ফোন করলেই তো হয়।’’ তার পর নিজেই ফোন ঘোরালেন থানায়।

বড়বাবু ছিলেন না। মেজবাবু ফোন ধরলেন। বরুণদা বিনীতভাবে শুরু করলেন,‘‘স্যর, আমার নাম বরুণ সেনগুপ্ত। আনন্দবাজারে কাজ করি। একটা অনুরোধ করছি...’’

ফোন ছাড়ার পরে এক সিনিয়র দাদার মন্তব্য, ‘‘এ বার তো আর এক কাণ্ড হল! ওই অফিসার বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে বলবেন, আজ আমাকে বরুণ সেনগুপ্ত ফোন করেছিলেন!’’ সকলের সঙ্গে হেসে উঠলেন বরুণদা নিজেও।

তখনকার সিপিএম অফিসে প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়দের কোনও রকম বেখাপ্পা প্রশ্ন করলেই তাঁদের অনেক বার বলতে শুনেছি, ‘‘এটা নিশ্চয় বরুণ শিখিয়ে দিয়েছে?’’ প্রমোদবাবু প্রায়ই বরুণবাবুর পদবি ‘সেন’ বলতেন। একদিন ফস করে বললাম, ‘উনি তো সেনগুপ্ত। আপনি ওঁকে বরুণ সেন বলেন কেন?’ প্রমোদদার সরস জবাব, ‘‘বরুণ বদ্যি হতেই পারে না। বদ্যি কখনও বদ্যিকে এত বাঁশ দেয় না। ও সেনগুপ্ত নয়!’’

এই সব টুকরো ছবি এক সুতোয় গাঁথলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, বরুণ সেনগুপ্ত তাঁর সময়কালে অন্যদের চেয়ে কতটা আলাদা ছিলেন। সোজা কথায় যাকে গ্ল্যামার বললে হয়তো খুব ভুল হবে না।

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, যখন কলেজে পড়ি। আনন্দবাজার পত্রিকায় বৃহস্পতিবারের ‘রাজ্য ও রাজনীতি’ কলাম তো বটেই, ‘পালা বদলের পালা’ এবং ‘ইন্দিরা একাদশী’ তত দিনে গোগ্রাসে পড়ে ফেলেছি। বইয়ের পিছনের প্রচ্ছদে তাঁর হিরো-হিরো ছবি দেখেছি। জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ করে তাঁর জেলে যাওয়ার খবর জেনেছি। অতএব তিনি চেনা না হয়ে পারেন! অবশ্যই মনে মনে।

বছর কয়েক পরে আনন্দবাজারে চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে বরুণদাকে প্রথম সামনাসামনি দেখলাম। তিনি সে দিন কোনও কথা বলেননি। আমার শুধু দেখার রোমাঞ্চ! বাড়ি ফিরে সবার কাছে আমিও গল্প করে বলেছিলাম, আজ বরুণ সেনগুপ্তকে দেখলাম!

তখনকার নিউজরুম ছিল বিশাল খোলা হলঘর। ঢুকেই বাঁ দিকে পাশাপাশি দুটি চেয়ার। বরুণদা বসতেন দ্বিতীয়টিতে। প্রথমটি চিফ অব ব্যুরো সুনীল বসুর। রিপোর্টিংয়ের দৈনন্দিন কাজকর্মে বরুণদা বিশেষ মাথা গলাতেন না। সত্যি বলতে কী, নিউজরুম পরিচালনার কোনও ক্ষেত্রেই তাঁকে প্রকাশ্যে তেমন কোনও সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখিনি। কিন্তু তাঁর উপস্থিতির ওজনটা সব সময় বোঝা যেত। সাধারণ ভাবে মানুষটি ছিলেন দিলখোলা, হাসিখুশি মেজাজের। নিজের লেখার কাজটুকু সেরে ওই চেয়ারে বসেই সহকর্মীদের সঙ্গে নানা রকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি, খুনসুটিতে মেতে থাকতেন।

পিছনের পার্টিশনে মাথা হেলান দিয়ে গা এলিয়ে বসার একটি অদ্ভুত ভঙ্গি ছিল তাঁর। একটি বাতিকও ছিল। মাথার মাঝখানে হাত বুলিয়ে অনবরত চুল ছেঁড়ার। আয়েস করে পাইপ খেতেন। কখনও সিগারেট। আর অর্ধনিমীলিত চোখে নজর করতেন নিউজরুমের কাজকর্ম।

কাজ শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই রোজকার রাজনৈতিক খবরাখবর সংগ্রহের ভার দেওয়া হয় আমাকে। রিপোর্টিংয়ের পরিভাষায় যাকে বলে পলিটিক্যাল বিট। এ বার আমি সরাসরি বরুণদার কাছে কাজের সুযোগ পেলাম।

তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সংবাদদাতা। ওই নির্দিষ্ট পদটিতে তাঁর আগে বা পরে আর কেউ আসেননি। বিভিন্ন পার্টি অফিস ঘুরে এসে তাঁকে দিনের খবর জানাতাম। তিনি প্রয়োজনীয় উপদেশ দিতেন। কিন্তু খুব জরুরি কিছু না হলে রিপোর্ট লেখার পরে নিজে আর দেখতেন না।

তাঁর শেখানোর কায়দাও ছিল ভারী অমায়িক। কখনও নিজের বিরাট ছায়া অনুজের উপর ফেলতেন না। বরং নতুনকে নিজের মতো করে এগোনোর পথ করে দিতেন। তাই বাড়তি কোনও চাপ তৈরি হত না।

তখনও বামফ্রন্ট বৈঠকের কিছু গুরুত্ব ছিল। বৈঠকের ভিতরকার খবর জানতে একটু-আধটু কাঠখড় পোড়াতে হত। আলিমুদ্দিনের সিপিএম অফিসে প্রমোদবাবু বা সরোজবাবুর সাংবাদিক বৈঠকের পরেও তাই বিভিন্ন শরিক দলের দরজায় হানা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।

নানা ঘাটে ঘুরে অফিসে ফিরে দেখতাম বরুণদা ততক্ষণে ভিতরের না-বলা সব খবরের সঙ্গে নিজের বিশ্লেষণ মিশিয়ে লেখা তৈরি করে রেখেছেন।

একবার জেনে নিতেন নেতারা প্রকাশ্যে কে কী বললেন। তার পর মুচকি হেসে বলতেন, ‘‘একদম লিখে দাও... দাঁড়ি, কমা, ফুলস্টপ সব।’’

এর পরে যা হত, সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। নিজের লেখা কপিটি এগিয়ে দিয়ে বরুণ সেনগুপ্ত বলতেন, ‘‘একটু চোখ বুলিয়ে দেখে দাও তো, বানান-টানান ভুলভাল হল কি না! আমি তো আর তোমাদের মতো ভাল ছাত্র নই। টেনেটুনে পাশ!’’

তাঁর লেখা যে কত মনোগ্রাহী ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝরঝরে, সাবলীল তার গতি। সেই লেখার ভুলভাল ঠিক করব আমি?

না। বুঝতে পারতাম, আসল কারণ হল, বরুণদা নিজের লেখা পড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন কেমন করে ওই ধরনের খবর লিখতে হয়। নিজেকে জাহির না করে ওটাই ছিল তাঁর শেখানোর কৌশল। কখনও বুঝতে দিতেন না, তিনি মহীরুহ।

বরুণবাবুর জন্ম বরিশালে, ১৯৩৪ সালে। জন্মদিনটি ঘটনাচক্রে বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। কারণ ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন বাঙালি সহজে ভোলে না। বরুণবাবুরও একই তারিখে জন্ম। সুভাষচন্দ্রের প্রতি প্রবল অনুরাগ ছিল ছোটবেলা থেকেই। নেতাজি ছিলেন তাঁর আদর্শ। নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কাজ করেছেন। বইও লিখেছেন। কলেজে পড়তে পড়তে ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ব্লকের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন বরুণবাবু।

এক বক্তৃতা সভায়

বরিশালের বি এম স্কুলে লেখাপড়া শুরু হওয়ার পরে ১৯৪৭-এ দেশভাগের আগেই বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন কিশোর বরুণ। ভর্তি হন উত্তর কলকাতার হাতিবাগান পাড়ায় টাউন স্কুলে। সেখান থেকে সিটি কলেজ। বাণিজ্য শাখায় স্নাতক। প্রথাগত শিক্ষা এমনই আটপৌরে। বাকিটা তিনি গড়েছেন। এক অর্থে সেটা তাঁর অর্জিত গৌরব।

সাংবাদিকতায় বরুণবাবু কোনও নতুন ধারা এনেছিলেন কি না, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে। কিন্তু এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, রাজনৈতিক সংবাদ পরিবেশনাকে তিনি গৃহস্থের রান্নাঘরে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। রাজনীতির মতো আপাতনীরস বিষয়ও তাঁর লেখার প্রসাদগুণে অন্দরবাসিনীদের দুপুরের পড়ার রসদ হয়ে উঠেছিল। ভাষার জারিজুরি বা তত্ত্বের কচকচানি নয়। কথা বলার মতো সহজ ভঙ্গিতে রাজনীতির ভিতরের খবর ও পর্যবেক্ষণ তাঁর লেখাকে জুগিয়েছিল বাড়তি আকর্ষণ। বরুণ সেনগুপ্তের জনপ্রিয়তার এটি এক বড় কারণ।

তাঁর সাংবাদিক-জীবনের একটি বড় সময় জুড়ে টিভি চ্যানেল ছিল না। আবার দৃশ্যমাধ্যম-সাংবাদিকতা যে দ্রুত বাড়ছে, সেটাও শেষ দিকে এক সময় তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু লক্ষণীয় হল, টিভি-র ক্যামেরা থেকে সর্বদা দূরে থাকতেই পছন্দ করতেন বরুণবাবু। তাঁর অভিমত ছিল, সংবাদপত্রে নিয়মিত ভাবে দীর্ঘকাল কোনও সাংবাদিকের লেখা পড়তে পড়তে তাঁর সম্পর্কে পাঠকের মনে একটি ছবি তৈরি হয়। ক্যামেরায় মুখ দেখালে সেই ছবি ধাক্কা খেতে পারে। সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। অতএব পাঠকের মনে ছবি হয়ে থাকাই বেশি ভাল।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তাঁর ওই ধারণা ঠিক ছিল না ভুল, সেই আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। যেটা বলার তা হল, সংবাদপত্রের অর্থাৎ প্রিন্ট মিডিয়ার পতাকাকে উচ্চে তুলে রাখাই তিনি বরাবর পছন্দ করেছেন।

বরুণবাবু আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন ১৯৫৯ সালের শেষ দিকে। তখন থেকে তাঁর পেশাদার সাংবাদিক জীবনের শুরু। তার আগে কলেজে পড়ার সময় ‘ভাবীকাল’ নামে একটি সাময়িকী বের করতেন তিনি। তবে তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।

পরে বিশিষ্ট ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসুর (যিনি পরে খুন হন) সহায়তায় ১৯৫৭ সালে বরুণবাবু বের করেন একটি সাপ্তাহিকী— ‘বর্তমান’। ওই নামেই ১৯৮৪ সাল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বরুণ সেনগুপ্তের হাতে তৈরি দৈনিক। তিনি যার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।

আজীবন নিজেকে রিপোর্টার বলেছেন বরুণবাবু। সংবাদপত্রের সম্পাদক হয়েও রিপোর্টারের জার্সি খুলতে কোনও দিন রাজি ছিলেন না। লেখাতেও বারবার সেভাবেই নিজেকে তুলে ধরেছেন। কারণ সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তের উত্থান, প্রতিষ্ঠা সবেরই ভিত্তি ওই রিপোর্টারি।

মূলত রাজ্য-রাজনীতি ছিল তাঁর প্রধান বিচরণভূমি। যার কয়েকটি পর্ব খুব উল্লেখযোগ্য। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস জমানার পতন ও বামেদের সঙ্গে নিয়ে প্রথম একটি অ-কংগ্রেসি সরকার পত্তন, নকশাল আন্দোলন, জরুরি অবস্থা জারি এবং এই রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের দাপাদাপি, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠন, সেই সরকারের নানা অনিয়ম, সর্বোপরি শাসক বাম ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস— একই সঙ্গে উভয়ের মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান।

এই রকম অনেক কিছু খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। আর প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর লেখনী ও বিশ্লেষণ পাঠকদের আগ্রহের খোরাক হয়েছে।

মমতা যে রাজ্যে সিপিএম-শাসনের অবসান ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন, সেই ভবিষ্যদ্বাণী বরুণ সেনগুপ্ত করেছিলেন ২০১১ আসার অন্তত কুড়ি বছর আগে। তৃণমূল কংগ্রেস গঠন তখন হয়তো মমতার স্বপ্নেও ছিল না! বরুণবাবুও শেষ পর্যন্ত মমতাকে ক্ষমতায় দেখে যাননি। তিনি প্রয়াত হন ২০০৮ সালে। কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ সত্যি হয়েছে।

সাংবাদিকতায় নির্ভীক স্পষ্টবাদিতাকে তিনি সব সময় মান্যতা দিতেন। তারই পরিণামে জরুরি অবস্থার সময় তাঁকে জেলেও যেতে হয়। কারাবাসের কষ্টভোগ বড় কম ছিল না। গরমে, শীতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক জেল থেকে অন্য জেলে পাঠানো হত তাঁকে। যাতে ভোগান্তি বাড়ে। জেল থেকে ফিরে লিখলেন ‘অন্ধকারের অন্তরালে’।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার নেপথ্য কাহিনি বা অন্দরের খবর লেখায় এক রকম সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। লেখার কায়দায় অনায়াসে অর্জন করতে পারতেন পাঠকের আস্থা। একবার ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে জ্যোতি বসুর রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সংবাদ নিয়ে তো রীতিমতো শোরগোল! সমালোচকেরা প্রশ্ন তুললেন, বরুণবাবু কি বৈঠকের সময় টেবিলের তলায় বসে ছিলেন? এত বিশদ বিবরণ তিনি পেলেন কোথায়? বরুণদা সে সব গায়ে মাখতেন না। হেসে উড়িয়ে দিতেন।

একটি ক্ষেত্রে ঘটেছিল চরম ছন্দপতন। ১৯৮২-র বিধানসভা নির্বাচনের কিছু দিন আগে বরুণদা লিখলেন, পশ্চিমবঙ্গে ভোট স্থগিত হয়ে যাবে। কেন্দ্র এখানে রাষ্ট্রপতি শাসনে ভোট করাবে। নির্বাচনের প্রচার এবং প্রস্তুতিপর্ব তখন তুঙ্গে। বরুণ সেনগুপ্তের লেখা এমন একটি খবরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সিপিএম সন্ত্রস্ত, বিরোধীরা উল্লসিত। কিন্তু সরকারি স্তরে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। নির্বাচন কমিশনও চুপ।

এ দিকে ভোটের দিন এগোচ্ছে। তবু বরুণদা তাঁর খবরের নিশ্চয়তা থেকে একচুল সরতে নারাজ। বরং আরও বার কয়েক ভোট হবে না বলে লিখেও দিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দিল্লির যে উচ্চমহল থেকে তিনি এই খবর জেনেছেন, তা ভুল হতে পারে না। মুখেও বারবার বলছেন সেটা।

নির্বাচনের আগের সন্ধ্যা। সম্ভবত রবিবার ছিল সেটা। আমরা খবর লিখছি—কাল ভোট। বরুণদা তখনও লিখছেন এবং বলছেন, শেষ মুহূর্তে ভোট বাতিল হয়ে যাবে।

হল না। পরদিন যথানিয়মে ভোট হয়ে গেল। বরুণদার মুখ থমথমে। এবং পরবর্তী কলামে তিনি নিজেই খোলাখুলি লিখলেন, ‘ভুল বলেছিলাম। ক্ষমা চাইছি।’

এটাই তাঁর পেশাদারিত্ব। এখানেই তাঁর প্রসারতা। তাই একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিক নিজের ত্রুটি স্বীকারে সে দিন একটুও কুণ্ঠিত হননি। বরং জানিয়ে দিলেন, সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা পাঠকের প্রতি। সেখানে কোনও আপস তিনি করবেন না।

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং জ্যোতি বসু— দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিল জোয়ার-ভাটার। তাঁদের বিবিধ কাজকমের্র, নীতি-সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে লেখার জন্য দু’জনেই তাঁকে ‘শত্রু’ মনে করতেন। বরুণদাও সাংবাদিক হিসেবে নিজের অবস্থান ছেড়ে নড়তেন না। যা উচিত মনে হত, অপ্রিয় হলেও তা খোলাখুলি লিখে যেতেন। একবার নয়, বারবার।

শুনেছি, সিদ্ধার্থ রায় নাকি একদিন মহাকরণে তাঁর ঘরে সাংবাদিকদের সামনে বরুণবাবুর উদ্দেশে রেগে বলেছিলেন, ‘আই উইল সি দ্যাট পাইপ-স্মোকিং জার্নালিস্ট।’ বরুণদা সে কথা জেনে পরক্ষণেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে পাইপের ধোঁয়া উড়িয়ে ঢুকে হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘ইয়েস মিস্টার চিফ মিনিস্টার, হিয়ার ইজ ইয়োর পাইপ স্মোকিং জার্নালিস্ট। প্লিজ সি হিম...’’ রাগে গরগর করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর। জরুরি অবস্থার সময় বরুণবাবুকে জেলে ভরে নাস্তানাবুদ করতে পেরে হয়তো কিছুটা ‘আত্মপ্রসাদ’ লাভ করেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর!

জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বরুণবাবুর মুখোমুখি এমন ‘তু তু, ম্যায় ম্যায়’ সম্ভবত হয়নি। তবে বহু বছর ধরে তাঁদের সম্পর্কটা নিঃসন্দেহে বিষময় হয়ে গিয়েছিল। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। সে সব এখানে আলোচ্য নয়।

আমাকে অবশ্য জ্যোতিবাবুর সঙ্গে হাতে ধরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বরুণদাই। তখন সদ্য পলিটিক্যাল বিট পেয়েছি। একদিন ভর সন্ধেবেলা বললেন, ‘‘হাতে কাজ আছে তোমার? না থাকলে চলো, একটু ঘুরে আসি।’’

সেই সময়ে নিজেই গাড়ি চালাতেন তিনি। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে। তাঁর গাড়িতেই নিয়ে গেলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের অফিসে। তখন পুরনো বাড়ি। দোতলায় ভিতরের একটি ঘরে জ্যোতিবাবু, প্রমোদবাবু, সরোজবাবু বসেছিলেন।

বরুণদা ঢুকলেন। পিছনে আমি। অন্য কথাবার্তার প্রয়োজন তাঁদের নিশ্চয় ছিল। কিন্তু তারই এক ফাঁকে আমাকে দেখিয়ে জ্যোতিবাবুকে বললেন, ‘‘এরা সব আমাদের নতুন রিক্রুট। কয়েক জন এসেছে। এরাই নেক্সট জেনারেশন। সবাই ভাল ভাল ছেলে। এর নাম দেবাশিস। ও এখন রেগুলার আসে।’’ দু’-এক কথায় সৌজন্য বিনিময় করেছিলেন জ্যোতিবাবু। কিন্তু সে দিনের ওই মুখ চেনানো কত দূর সহায়ক হয়েছিল, পরে অনেক বার তা বুঝেছিলাম।

আরও একজনকে চেনাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বরুণদা। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ। আমি তাঁকে দেখেছি বামফ্রন্টের এক শীর্ষনেতা হিসেবে। কিন্তু বারবার মনে হত, তিনি যেন রাজ্য-রাজনীতির ভাণ্ডারি। শুধু নিজেদের নয়, অন্য দলগুলির, এমনকী বিরোধী শিবিরের নানা বিষয়ের হদিশও মিলত তাঁর কাছে।

অশোকদা আমাদের মতো ‘দুগ্ধপোষ্য’দেরও ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। ব্যতিক্রম বরুণদা। কারণ বরুণদা ছাত্র ব্লক করার সময় থেকেই অশোকবাবুর চেনা। একদিন ফরওয়ার্ড ব্লক অফিসে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে বরুণদা আমাকে বললেন, ‘‘এই জায়গাটা চিনে রাখো। পারলে মন্দির-মসজিদ-গির্জার মতো রোজ একবার করে মাথা ঠেকিয়ে যাবে। কাজ হবে।’’ তাঁর সেই উপদেশ পালন করে কোনও দিন ঠকিনি।

আনন্দবাজারে আমরা যে ক’জন একসঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম, তাদের সঙ্গে বরুণদার কেমন করে যেন একটা ব্যক্তিগত সখ্য তৈরি হয়ে যায়। সেই প্রশ্রয় অবশ্যই এসেছিল তাঁর দিক থেকে। বরুণদার তত্ত্বাবধানে আমাদের একটা সিগারেট-ক্লাব ছিল। নিয়ম হয়েছিল, মাসের মাইনে হলে ঘুরে ঘুরে এক-এক বার আমরা এক-এক জন কোনও দামি ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট সিগারেট কিনব এবং সকলে ভাগ করে সেই সিগারেটগুলি খাওয়া হবে। মজাটা বেশ কিছু দিন চালু ছিল।

আমাদের মাঝেমধ্যে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন বরুণদা। চাইনিজ। কখনও চাঁদনির পিছনে টেম্পল স্ট্রিটে, কখনও পার্ক স্ট্রিটে। খেতে যাওয়ার মধ্যেও ছিল এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। অফিসে বেশি পাঁচকান না করে আমরা নির্দিষ্ট কয়েক জন চুপচাপ রাস্তায় বেরিয়ে কোথাও দাঁড়াতাম। বরুণদা গাড়িতে তুলে নিতেন। তবে এ সব তো আর বেশি দিন গোপন থাকে না! কানাঘুষো শুরু হতেই তাতে ছেদ।

বরুণদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে ছেদ পড়ে তিনি আনন্দবাজার ছাড়ার পরে। সেটা ১৯৮৪-র মাঝামাঝি। তাঁর নিজের তৈরি দৈনিকের প্রকাশনা শুরু হয় সেই বছরেরই শেষ দিকে। তার পর কখনও-সখনও কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যেত। এক সামাজিক আমন্ত্রণে আমার বাড়িতেও তিনি এসেছিলেন। বিজয়া বা নববর্ষে নিয়মমাফিক সৌজন্যেও ভুল হত না।

অনেক পরে তাঁর কাগজে সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তের কাছে দায়িত্বশীল পদে কিছু দিন কাজও করেছিলাম। সেই সময় আবার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হত তাঁর সঙ্গে। তবে কোথায় যেন আমাদের চেনা পুরনো বরুণদাকে খুঁজে পাইনি। সেটা অবশ্য একেবারেই ব্যক্তিগত উপলব্ধি। দায়ও একান্ত ভাবে আমার।

Barun Sengupta Journalist বরুণ সেনগুপ্ত
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy