সে ’৬০ সালের কথা। তার আগে, পঞ্চাশের দশক? বাঙালি শ্রোতা তত দিনে মন দিয়ে ফেলেছে সলিলে। এ দিকে সলিল চান মুম্বই যেতে।
এমনই এক সকালে বহু আকাঙ্খিত সেই টেলিফোন। ওপারে থাকা মানুষটি বললেন, ‘‘ঠিক আছে, চলে আসুন।’’ সেই মানুষটি আর কেউ নন, স্বয়ং বিমল রায়! বিমলদা।
ট্রেনে করে সোজা বম্বে। তার পর তো ইতিহাস। বিমলদার বাড়ি পৌছে গেলেন সলিল। কিন্তু সুরকার হিসেবে নয়। কলকাতায় এসে সলিলের লেখা ‘রিক্সাওলা’ গল্পটি পড়ে খুব পছন্দ হয়েছিল বিমলদার। হিন্দিতে সেই কাহিনি নিয়ে হইহই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সলিলের সঙ্গে কথা বলে বিমলদা ঠিক করেন ছবির নাম হবে ‘দো বিঘা জমিন’। চিত্রনাট্যও লিখবেন সলিল। কিন্তু ওই ছবির সুরকার হিসেবে তখনও সলিলের কথা ভাবেননি তিনি। ভেবেছিলেন অনিল বিশ্বাসকে।
মাঝখান থেকে বাদ সেধে বসলেন সহকারী পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। তিনি সলিলের অনেক দিনের বন্ধু। বললেন, ‘‘বিমলদা, এ ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য যখন সলিলের, তখন সুর করার দায়িত্ব ওকেই দিন না কেন?’’
এ কথা-সে কথার পর রাজি হয়ে গেলেন বিমলদা। সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন সলিলও। সেই কাজের সূত্রেই মোহন স্টুডিয়োতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল মান্নাদা’র। তখনই মান্নাদার মনে হয়েছিল, এ ছেলে অনেক দূর যাবে!
কথা লিখলেন শৈলেন্দ্র। সুর সলিলের। হিট হয়ে গেল ‘দো বিঘা জমিন’-এর গান— ‘ধরতি কহে পুকার কে, বীজ বিছা লে প্যার কে, মৌসম বিতা যায়’ আর ‘হরিয়ালা সাবন ঢোল বজাতা আয়া’।
‘দো বিঘা জমিন’-এর সুর ভাসিয়ে দিল বম্বেকে। লোকের মুখে মুখে তখন ‘মৌসম বিতা যায় মৌসম বিতা যায়’। অলটাইম হিটের তালিকায় চলে গেল ‘দো বিঘা জমিন’। বদলে গেল হিন্দি ছবির গোটা আবহাওয়াটা।
এর পরে বিমলদা হাত দিলেন ‘মধুমতী’-তে। নায়ক দিলীপকুমার। তখন দিলীপসাবের যে-কোনও ছবির সুরকার-গীতিকার জুটি হিসেবে কাজ করতেন নৌশাদ-শাকিল।
‘মধুমতী’র জন্যও এই জুটিকেই বেছে নিয়ে ছিলেন দিলীপকুমার। মুম্বইয়ে তখন নায়ক হিসেবে দিলীপকুমারই শেষ কথা। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা মেনে চলতে হত পরিচালকদের।
কিন্তু বম্বে টকিজের কর্ণধার বিমলদার তখন যুক্তি, ‘‘আমার মনে হয়, ‘দো বিঘা জমিন’-এর সাফল্যের পরে আর একটি সুযোগ পাওয়া উচিত সলিল-শৈলেন্দ্র জুটির। আর ওদের কাজ যদি আমাদের পছন্দ না-হয়, তখন তো অল্টারনেট রইলই।’’
দিলীপকুমারকে দু’বার ভাবার সময় দেননি সলিল-শৈলেন্দ্র জুটি। তবে শুরুতে ‘আজা রে পরদেশি’র সুরটা বদলে দিতে বলেছিলেন।
সলিল গিয়ে সে-কথা লতা মঙ্গেশকরকে জানালেন, ‘‘বিমলদা বলছেন সিচুয়েশন অনুযায়ী গানটা ঠিক যাচ্ছে না। কী করি?’’
শুনে রেগে আগুন লতাদি। বলে ওঠেন, ‘‘বিমলদা যদি এই গান নিয়ে অন্য কিছু করেন, তা হলে আমি আর এই প্রোডাকশনের জন্য গানই গাইব না।’’ এর পর মুচকি হেসে বিমল রায় বলেছিলেন, ‘‘চলো ঠিক আছে, লতা যখন বলছে, রেখেই দাও।’’
এর পরে আর থামানো যায়নি সলিলকে। ছবি রিলিজের সঙ্গে সঙ্গে গোটা ভারত মজে গিয়েছিল তাঁর সুরবাহারে।— ‘আজা রে পরদেশি’, ‘চড় গয়ি পাপী বিছুয়া’, ‘দিল তড়প তড়প কে কহ রহা হ্যায় আ ভি জা’, ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল ধড়কে, সুহানা সফর ঔর ইয়ে মৌসম হসিন’, ‘টুটে হুয়ে খয়াবোঁ নে’…।
রেডিয়ো সিলোনে আমিন সায়ানি তখন একটা অনুষ্ঠান করতেন। ‘বিনাকা গীতমালা’। সেখানেও ইতিহাস গড়ল ‘মধুমতী’। ওই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে কখনও কোনও ছবির সব গান বাজানো হত না। সেই প্রথম বার শ্রোতাদের দাবির কাছে হার মেনে পর পর সাত দিনই ‘মধুমতী’র সাতটি গান বাজল।
‘মধুমতী’র পরেই দিলীপসাবের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল সলিলের। বিমল রায়ের ‘মুসাফির’ ছবিতে দিলীপসাবকে দিয়ে গানও গাইয়েছিলেন তিনি।— ‘লাগি নাহি ছুঁতে রামা, চাহে জিয়া জায়ে’।
•••
‘দো বিঘা জমিন’-এর পরের কথা মনে পড়ছে। ‘নৌকরি’ ছবির জন্য সলিল ফোন করেছিলেন কিশোরদাকে। তিনিই ছিলেন এই ছবির নায়ক।
সলিল বলছিলেন, ‘‘সুর করেছি। তুই চলে আয় আমার বাড়ি।’’
শুনে কিশোরদা সলিলকে যা বলেছিলেন, আজও ভুলিনি।— ‘‘রাতে স্বপ্ন দেখলাম, তুমি আমাকে দিয়ে গান গাওয়াবে বলে ধরতে আসছ। আর আমি ছুটে পালাচ্ছি। পিছন পিছন তুমিও। আমি বলছি, আমাকে ছেড়ে দাও, তোমার ওই শক্ত সুরে আমি পারব না গান গাইতে। তুমি চিৎকার করে বলছ, পালাস না, সহজ করে সুর করেছি।’’ কথাটা শেষ করেই কিশোরদার সেই বিখ্যাত হাসি।
‘নৌকরি’ ছবির ‘ছোটা সা ঘর হোগা বাদলোঁ কি ছাও মে’ দারুণ হিট করল। আর ওখান থেকেই প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে বাড়ল কিশোরদার চাহিদা।
‘আনন্দ’ ছবি হবে। রাজেশ খন্নার লিপে ছবিতে ‘কহিঁ দূর জব দিন’ এবং ‘মৈনে তেরে লিয়ে হি সাত রং কে সপনে চুনে’— দু’টিই গেয়েছিলেন মুকেশজি।
‘ব্যাকগ্রাউন্ড সং’ হিসেবে সলিল প্রথমে রেখেছিলেন মান্নাদার গাওয়া ‘জিন্দেগি কৈসি হ্যায় পহেলি’-র গানটি।
এ দিকে এ গান শুনে রাজেশ খন্না বলে উঠলেন, ‘‘এ কী! এমন অপূর্ব একটা গান ব্যাকগ্রাউন্ডে?’’
আবদার করে বসলেন, ‘‘আমি ছাড়ব না। এই গানটার লিপ আমিই দেব। সুরটা খুব টাচি।’’ তাই-ই হল।
এই গানের সঙ্গে সলিল ব্যবহার করেছিলেন মিউটেড ট্রাম্পেট। এর আগে হিন্দি ছবির মিউজিকে আগে কোনও সুরকার এ ভাবে লো-টোনে ট্রাম্পেট ব্যবহার করেননি। এই ব্যবহারটাই গানটাকে অন্য একটা মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।
বহু কাল পরে কলকাতায় রাজেশ খন্নার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অনেক কথা হয়েছিল সে দিন। তার মাঝে উনি তুললেন ‘আনন্দ’-এর সেই পুরনো গল্পটা! আমি অবাক না হয়ে পারিনি।
•••
সব গায়ককে সম্মান করতেন সলিল। সকলের প্রতি ছিল তাঁর সমান মমতা। কিন্তু এক বার মুম্বইয়ের একটি ম্যাগাজিনে সলিলের মুখে এমন একটি কথা বসিয়ে দেওয়া হল, যাতে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি হতে পারত।
ওঁর চলে যাওয়ার ঠিক এক বছর আগের কথা। ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ ছবির জন্য মুম্বই গিয়েছিলেন সলিল। তখনই ওই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এক বিখ্যাত সাংবাদিককে।
গায়ক হিসেবে ‘মধুমতী’ ছবির ‘টুটে হুয়ে খয়াবোঁ নে’ গানটি সম্পর্কে সলিল নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ইটস নট মাই প্রাইড।’’ সাক্ষাৎকারে সলিলের বয়ানে এও রাখা হয় যে, রফিসাবের তুলনায় গায়ক হিসেবে তিনি নাকি এগিয়ে রাখেন মুকেশজি, মান্না দে-কে।— ডাহা মিথ্যা কথা। সলিল এ সব বলতেই পারেন না।
‘মায়া’ এবং ‘ছায়া’ ছবির গল্প এখনও আমার মধ্যে প্রবল। রফিসাবকে দিয়ে গান গাওয়ানো নিয়ে সলিলের ইনভলভমেন্ট কিছুতেই ভোলার নয়। চমৎকার দু’টি গান রেখেছিলেন সলিল ওঁর জন্য। কী অসাধারণ গেয়েওছিলেন রফিসাব!
আসলে কোন গান কাকে দিয়ে গাওয়াবেন, কোন গায়কের কী রেঞ্জ, এ সব ছিল সলিলের নখদর্পণে। ‘টুটে হুয়ে খয়াবোঁ নে’ গজল টাইপের গান। যেমন ভাবে, যে-সুরে সলিল ওই গানটি রফিসাবকে গাইতে বলেছিলেন, তিনি ঠিক সেই ভাবেই গেয়েছিলেন।
এ গান তিনি কখনওই মুকেশজি, কিশোরদা বা মান্নাদাকে দিয়ে গাওয়াতেন না। সলিলের সুরে বেশির ভাগ হিট গান গেয়েছেন মুকেশজি। কিন্তু তাঁরও সীমাবদ্ধতা ছিল। যেশুদাসেরও তাই। এই দুই গায়কের জন্য সলিল বি ফ্ল্যাট রেঞ্জ বেঁধে দিতেন। যাতে ওঁদের গায়কীতে কোনও অসুবিধে না হয়। এ সব ঘটনা না বুঝে, না জেনে দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে সলিলের মুখে যা-ইচ্ছে তাই কথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল! খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন সলিল। কষ্টও পেয়েছিলেন খুব।
•••
‘অর্কেস্ট্রাইজেশন’ কথাটা বিদেশে খুব চালু। আমাদের এখানে তার প্রথম শুরু সলিলের হাতে। তার গোড়ার গল্পটা বলি।
‘দো বিঘা জমিন’ নিয়ে বিমলদা গিয়েছিলেন মস্কো ফিল্মোৎসবে। ডেলিগেট হিসেবে সলিলও তাঁর সঙ্গে। রাজ কপূর গিয়েছিলেন ‘আওয়ারা’ ছবি নিয়ে।
সেখানে রাশিয়ার ‘কয়্যার’ দেখে তাক লেগে গিয়েছিল সলিলের। একশো, দু’শো শিল্পীর কোরাস!
ওখান থেকে ফিরে এসেই সলিল ‘বম্বে ইয়ুথ কয়্যার’ তৈরি করেন। তা নিয়ে হইচই পড়ে গেল বম্বেতে। উত্তেজনার পারদে ফুটতে থাকল শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রোতারাও। সলিলের কয়্যারে হারমোনিয়াম বাজাতেন সুরকার অনিল বিশ্বাস। তবলায় রোশনজি। গানে লতা-মান্নাদা-মুকেশজি। সঙ্গে আমিও।
কয়্যারে গান গাওয়ার জন্য আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু অভিনেতা অসীমকুমার।
আমি তখন গান শিখি পণ্ডিত লক্ষ্ণণ প্রসাদ জয়পুরিয়ার কাছে। আমাদের বাড়িতে উনি এলেন আলাপ হওয়ার পরে। কয়্যারে আসতে বললেন। সেই শুরু হল সলিলের সুরে সুরে আমার গলা মেলানো।
‘৫৮ সালে কলকাতায় চারটি অনুষ্ঠান করেছিল ‘বম্বে ইয়ুথ কয়্যার’। ঘোষণায় ছিলেন দিলীপকুমার। পরে সলিল তৈরি করলেন কলকাতা কয়্যার। সে’ও তো অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে গেল।
•••
সঙ্গীতের ব্যাকরণ গুলে খেয়েছিলেন সলিল। কেবলই বলতেন, ‘‘গ্রামার না-জানলে ভাল মিউজিক কম্পোজ করা যায় না।’’ গানের এই দখলদারির কারণেই সলিল গড়ে নিতে পেরেছিলেন নিজস্ব ঘরানা।
‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়াতন’ গানটার কথা মনে পড়ছে। নিচু স্কেলে শুরু হওয়া মান্নাদার গাওয়া এই গান কখনই কি ভোলার? অথচ গানটা কী করে যে একজন কাবুলিওয়ালার লিপে বসিয়েছিলেন সলিল, আজও অবাক লাগে ভাবতে!
পর্দায় ছবিটি দেখলে কোত্থাও মনে হয় না, এ গান মানাচ্ছে না! বরং কাবুলিওয়ালার বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি আমরা।
এক সময় রটে গিয়েছিল, এ গানের জন্য নাকি সলিল কাবুলিওয়ালার ডেরায় গিয়ে সুর খুঁজে বেড়াতেন। কোনও কোনও সাংবাদিকও তাঁদের লেখা বইয়ে এমন কথা লিখেছেন। গল্পটা পুরো বানানো।