Advertisement
E-Paper

জাগরী

কয়েদখানায় বসে লিখেছিলেন এই উপন্যাস। ফুল ফোটার শব্দ পেতেন তিনি! প্রেমে পড়েছিলেন হোটেল পরিচারিকার। চলে যাওয়ার ৫০ বছরে সতীনাথ ভাদুড়ীর বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে বিনোদ ঘোষালভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি। যে সে বন্দি নন, রাজবন্দি। জেলের ভেতরেও তিনি কড়া নজরদারিতে থাকেন। আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। সেই স্মৃতি ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ নিয়ে জেগে। কয়েক দিন আগেই তিনি জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে যেন কোনও একটি ‘টি সেলে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
প্রৌঢ় সতীনাথ

প্রৌঢ় সতীনাথ

ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি।

যে সে বন্দি নন, রাজবন্দি। জেলের ভেতরেও তিনি কড়া নজরদারিতে থাকেন।

আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। সেই স্মৃতি ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ নিয়ে জেগে।

কয়েক দিন আগেই তিনি জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে যেন কোনও একটি ‘টি সেলে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুনে সুপারিন্টেন্ডেন্টের মাথায় হাত! এই বন্দি বলে কি!

টি সেলগুলোতে রাখা হয় খতরনাক বন্দিদের। ছোট্ট খুপরি, একা একা থাকা। আলো বাতাস ঢোকে না বললেই চলে। সেখানে কেউ সাধ করে ঢুকতে চায়?

সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘‘বলেন কী মশাই! ওখানে কেন?’’

বন্দির উত্তর, ‘‘একা থাকলে লেখাপড়ার কাজটা ভাল হয়।’’

‘‘বেশ, ব্যবস্থা করছি তাহলে।’’

ব্যবস্থা হল। আর ওই টি-সেলে বসেই রুল টানা খাতায় লেড পেন্সিলে লেখা হল এক উপন্যাস, যার নাম জাগরী।

লেখক ‘ভাদুড়ীজি’। সতীনাথ ভাদুড়ী। সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির ভারত ছাড় আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে। লেখক হিসেবে একেবারেই নতুন, কে পড়বে তার ওই লেখা?

জেলে বসেই সেই লেখা পড়ে ফেললেন তাঁর এক অনুগত শিষ্য, তিনিও রাজবন্দি। ‘ময়লা আঁচল’-এর লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’। পড়ে শুধু মুগ্ধই হলেন না, কেঁদে ফেললেন। ‘ভাদুড়ীজি’র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, ‘‘আমি ধন্য হলাম এই অসামান্য উপন্যাসের প্রথম পাঠক হতে পেরে।’’

বরাবরের রসিক, প্রাণোচ্ছ্বল সতীনাথ নাকি তখনও একই রকম। চোখের জল ফেলার সময় ফণীশ্বরের হাতে ধরা ছিল চায়ের কাপ। তাই দেখে বলে উঠলেন, ‘‘আহা করো কী ফণী, চা যে নোনতা হয়ে যাবে!’’

‘জাগরী’ প্রকাশ হওয়া নিয়েও এক মস্ত গল্প। সতীনাথ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সেই পাণ্ডুলিপি পড়েই রইল বাক্সবন্দি হয়ে। চিরকালেরই মিতভাষী সতীনাথ।

নিজের সম্পর্কে তো একেবারেই বলিয়ে কইয়ে নন, সুতরাং জেলের ভেতর কী লিখেছেন কেই বা জানবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি আর চাপা রইল না।

‘বনফুল’, অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীনাথের পরম বন্ধু। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সতীনাথের। একদিন গেলেন বনফুলের বাড়ি। কথায় কথায় সংকোচে বলেই ফেললেন, ‘‘একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছি জেলে বসে, একবার পড়ে দেখবে?’’

‘‘আরে অবশ্যই দিয়ে যাও।’’

কয়েক দিনের মধ্যেই পড়ে ফেললেন গোটা উপন্যাসখানি। মুগ্ধ! আহ কী লিখেছে সতীনাথ! আবার ডেকে পাঠালেন বন্ধুকে।

‘‘কী লিখেছ তুমি! এ যে অসামান্য! এক্ষুনি এই উপন্যাস ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’’

‘‘কিন্তু আমার যে কোনও সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয়ই নেই।’’

‘‘দাঁড়াও, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার ভাই ঢুলু-র (অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক)। সঙ্গে সাগরময় ঘোষের ভাল পরিচয় আছে। ওঁর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’’ সাগরময় তখন দেশের সহ সম্পাদক। অরবিন্দ নিজে গেলেন পত্রিকার দফতরে। সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে। ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপিও জমা দিলেন। সাগরবাবু বললেন, ‘‘একমাস পর এসে খোঁজ নিতে।’’

একমাস পর আবার গেলেন অরবিন্দ। সাগরবাবু পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে বললেন, ‘‘অমনোনীত।’’

অরবিন্দ শুনে অবাক, ‘‘সে কী! সাগরদা আপনি নিজে পড়েছেন?’’

‘‘না আমি পড়িনি, তবে যিনি পড়েছেন তিনিও সাহিত্যের মস্ত সমঝদার।’’

ফেরত চলে এল ‘জাগরী’। এবার উপায়? হাল ছাড়ার পাত্র নয় অরবিন্দ। সোজা গেলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের বাড়ি।

‘‘দাদা এই উপন্যাসটা একবার পড়ে দেখবেন? একজন নতুন লেখক।’’

দু’দিন পরেই কাকভোরে অরবিন্দবাবুর বাগবাজারের বাড়ির নীচে সজনীকান্তর ডাকাডাকি।

‘‘এক্ষুনি নীচে এসো। আরে এ কে! কী সাংঘাতিক লেখা! এই লেখা এক্ষুনি ছাপাতে হবে।’’

‘‘আপনি ছাপবেন?’’

‘‘ছাপতে পারলে ধন্য হতাম। আমার পত্রিকায় এখন তারাশংকর আর বনফুলের ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোচ্ছে, কবে শেষ হবে জানি না। কিন্তু তত দিন এই লেখা ফেলে রাখলে চলবে না। এখনই পাঠকদের কাছে পৌঁছানো দরকার। ব্যবস্থা করছি। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি চিঠি আর এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে এখনই যোগাযোগ করো।’’

সজনীকান্ত চিঠি লিখলেন একটি হিন্দি দৈনিকের সম্পাদককে। চিঠির বয়ান, ‘‘তুমি জাগরী ছাপবে। ছেপে ধন্য হবে।— সজনীকান্ত দাস’’

লালচে নিউজপ্রিন্টে সরাসরি বই হয়ে জাগরী-র গতি হল। আর প্রকাশ হওয়া মাত্রই বাংলার পাঠক মহলে হইহই। তারপর? সতীনাথ ভাদুড়ী নামের এক নতুন লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ পেল প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার।

সাগরময় ঘোষ ছুটলেন সতীনাথ ভাদুড়ীর বাড়ি। একবার বড় ভুল হয়ে গেছে খাঁটি হীরে চিনতে, দ্বিতীয়বার আর নয়। নিজেকেই নিজে বললেন, ‘‘আমাদের একটা উপন্যাস দিতেই হবে।’’

ফেরাননি সতীনাথ। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ পেল তাঁর আরেক কালজয়ী উপন্যাস— ঢোঁড়াই চরিত মানস।

ছোটবেলা থেকেই ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ইস্কুলে সংস্কৃতের পণ্ডিত তুরন্তলাল ঝা তাঁর অতিপ্রিয় মেধাবী ছাত্রটির নাম দিয়েছিলেন ‘ক্লাস কি রোশনি’। সেই নামেই গোটা স্কুল তাকে চেনে।

একদিন ক্লাস চলছে। সতীনাথ কী যেন দরকারে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়েছে। অমনই বন্ধুদের সরস চিৎকার, ‘‘মাস্টারসাব ক্লাস তো আঁধিয়ালা হো গয়া।’’

প্রতি বছর সব পরীক্ষায় প্রথম। কিন্তু স্বভাবে বড় মুখচোরা। এমনিতে চেনা পরিচিতদের মধ্যে দিব্যি গল্পবাজ। কিন্তু অচেনা কেউ সামনে এলেই মুখে কুলুপ।

কিন্তু নতুন কিছুকে পরখ করার আগ্রহ ষোলোআনা। একবারের কথা যেমন। বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ সতীনাথ ঠিক করল, সিদ্ধি খাওয়ার উপযোগিতা বুঝতে হবে।

পর পর কয়েক গ্লাস সিদ্ধি খেয়ে নিল সতীনাথ। তার পর নেশার চোটে তো যাই-যাই দশা। কে বলল, কাঠালপাতা চিবিয়ে খেতে। তাই খেলো। তাতে বিপত্তি আরও গেল বেড়ে। কোনও ক্রমে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সে-যাত্রায় রক্ষে।

মাকে হারান ছাত্রবয়েসেই।

তিন ভাই আর চার বোনের মধ্যে সবথেকে ছোট সতীনাথ বড় হতে লাগল রামতনু লাহিড়ীর ভ্রাতুষ্পুত্রীর কাছে। তিনি ছিলেন সম্পর্কে সতীনাথের ঠাকুমা।

আইনজীবী বাবা ইন্দ্রনাথ বড্ড কড়া ধাঁচের। তাই বাবাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে ছেলে ‘সতু’।

বাবা বাড়িতে থাকলে সদর দরজা দিয়ে যাতায়াত করতেও ভয়। তখন পিছনের খিড়কি দিয়ে যাওয়া-আসা। ক্লাসের পরীক্ষায় প্রথম হয়েও যেন বাবার মন গলে না। মেডেল পেয়ে বাড়িতে এনে ভয়ে-ভয়ে বাবাকে দেখাল। তাতেও বাবার কাঠ-কাঠ উত্তর, ‘‘বেশ ঠিক আছে। রেখে দাও।’’

বরাবর ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রটি আচমকাই আই এস সি পাশ করল দ্বিতীয় বিভাগে। তার পর বিজ্ঞান নিয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করে মনে হল ভাল লাগছে না। ছেড়ে দিয়ে কলা বিভাগে ভর্তি।

বি এ পড়ার সময় মেসে যে ঘরটি পেয়েছিলেন সেই ঘরে আগের আবাসিক ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। ঘরের দরজায় লেখা ছিল ‘Do not quarrel with facts’।

বি-এ র রেজাল্টও ভাল হল না। মনের ভেতর তখন কী যে চলেছিল! শেষে ভর্তি হলেন গিয়ে পটনা ল’ কলেজে। সেখান থেকে আইন পাশ করার পর শেষ পর্যন্ত সেই বাবার সঙ্গেই জুড়ি ঘোড়ার গাড়িতে চেপে, কখনও বা সাইকেল চালিয়ে রোজ কোর্টে প্র্যাকটিস করতে যাওয়া। বাবা আইনজীবী। আদালতে তাঁকে সাহায্য করাই সতীনাথের কাজ।

শেষ পর্যন্ত ভাগ্যে এই ছিল!

মক্কেল ধরার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই সতীনাথের নেই। বরং মনে মনে আইনিপেশাকে ঘেন্নাই করত সে। তাহলে কোর্টে গিয়ে সারাটা দিনের কাজ? আদালতে পৌঁছে একটু বাদেই ডুবে যেতেন বার লাইব্রেরির বইয়ের স্তূপে। পরের পর কেস হিস্ট্রি পড়ে যেতেন। হাজার হাজার গল্প।

এক জায়গায় নিজেই লিখেছেন, ‘‘বার লাইব্রেরি হচ্ছে জেলার ব্রেন-ট্রাস্ট। কী ছাই ইতিহাসের বই পড়ে লোকে! এখানকার বুদ্ধিদীপ্ত মিঠেকড়া মন্তব্যগুলো দেশের অলিখিত ইতিহাস। আসল ইতিহাস। এরা প্রত্যহ মুখে মুখে ইতিহাসের ডিকটেশন দিয়ে যাচ্ছে।’’

আইনের প্যাঁচ কষাকষি ভাল লাগে না বলে কি আইন কিছুই বোঝেন না সতীনাথ? তাই আবার হয়? বরং এতটাই বেশি বুঝতেন যে নিজে জুনিয়র উকিল হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাছে আইনের পরামর্শ নিতে আসতেন দুঁদে উকিলরা। শুধু তাই নয়, জেলা জজরা পর্যন্ত এসে নানা রুলিং জিজ্ঞাসা করে যেতেন!

দেশ জুড়ে তখন শুধু একটাই স্লোগান ‘ইংরেজ ভারত ছাড়’। গাঁধীজির ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেশের লাখো লাখো তরুণ।

সেই ডাক আচমকা ঢুকে গিয়েছিল যুবক সতীনাথের ভেতরেও। কিন্তু জীবন তাতে তখনও ধারা বদলায়নি।

বন্ধু বিভুবিলাসকে চিঠিতে লিখছেন ‘‘Daily routine বলছি— ৭টা থেকে ৯টা good boy— আইন পাঠ। ন’টা থেকে বারোটা কেদার বাঁড়ুয্যে সাহিত্যিক-এর বাড়ী আড্ডা। খাওয়া দাওয়ার পর ছোট্ট একটি ঘণ্টা তিনেকের ঘুম। ঘুম থেকে উঠে চা পানের সঙ্গে খবরের কাগজ পাঠ। তারপর সান্ধ্যভ্রমণ। তারপর নটা পর্যন্ত বাজি রেখে ব্রিজ খেলা।’’

ছাপোষা নিস্তরঙ্গ জীবন বলতে যা বোঝায়, তাই। কিন্তু তারপরেই একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনায় বদলে গেল ছবিটা।

গাঁধীজির ডাকে তখন দেশের সর্বত্র পিকেটিং চলছে। একদিন বন্ধুদের ডাকে গেলেন মদের দোকানে পিকেটিং করতে। হঠাৎই রে রে করে ব্যাটন উঁচিয়ে তেড়ে এল আবগারি পুলিশ। বন্ধুরা পালাল লাঠির ভয়ে। একা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন একরোখা বরাবরের জেদি সতীনাথ।

পুলিশও থমকে গেল ছেলেটির সাহস দেখে। শুরু হল তর্কাতর্কি। পুলিশ পিছু হটল এই একলা ছেলেটির গনগনে চোখের সামনে থেকে। তার পর থেকেই দ্রুত বদলে যেতে থাকল নিভৃতচারী জীবন। যে সতীনাথ অপরিচিত, স্বল্পপরিচিত মানুষের সামনে কথা বলতেও সংকোচ করত, সে-ই কিনা ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বাধীনতা সংগ্রামে।

পিকেটিং তো ছিলই। সঙ্গে নিত্যদিন যোগ হল অন্য সব স্বদেশির কাজ। যে জন্য পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতেও হত প্রায়ই। পায়ে হেঁটে, নয়তো চুপিসাড়ে রাতবিরেতে ট্রেনে চেপে। অন্ধকারে মাইলের পর মাইল বিনা টর্চে জল কাদা মাড়িয়ে গিয়ে মিটিং করাও ছিল যখন তখন। দিনের মধ্যে খাওয়াদাওয়া বলতে শুধু স্বপাক সেদ্ধ ভাত। স্বদেশির টান তাঁকে এতটাই একরোখা করে দিয়েছে, বলতেন, ‘‘দেশের মানুষ যেদিন ভাল করে খেতে পাবে সেদিন আমিও ভাল খাবার খাব।’’

একদিন আচমকাই সকালে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে হাঁটা দিলেন টিকাশ্রমের দিকে। গোটা পূর্নিয়ায় হই হই পড়ে গেল ভাদুড়ীজি আশ্রমবাসী হতে যাচ্ছেন। সত্যিই তাই গেলেন। আর সেই প্রথমবার নড়েচড়ে বসলেন ছেলের ব্যাপারে বরাবরের উদাসী পিতা ইন্দ্রনাথ।

আশ্রমের কঠোর জীবনযাত্রা ছেলে যে কিছুতেই নিতে পারবে না! বড় ছেলে ভূতনাথকে পাঠালেন আশ্রমে।— ‘‘যাও সতুকে ফেরত নিয়ে এসো।’’ গেলেন ভূতনাথ। বাবার অনুরোধ জানালেন ভাইকে। আর সেই প্রথমবার বাবার কথা অমান্য করলেন সতীনাথ। আর ফেরা সম্ভব নয়। ‘না’ বলে দিলেন দাদাকে। ভূতনাথ ফিরে এলেন একা।

রাজনীতিতে আসার পর জনপ্রিয়তা বিপুল। সকলেই ভাদুড়ীজি বলতে অজ্ঞান। সেই জনপ্রিয়তা, শ্রদ্ধা কত দূর ছিল একটা ঘটনা বললে কিছুটা বোঝা যাবে।

একবার সতীনাথ অনেক দূরের এক গ্রামে মিটিং সেরে সেই গ্রামেরই একজনের বাড়ির দালানে শুয়ে রয়েছেন। হঠাৎ গভীর রাতে চিৎকার। কী ব্যাপার?

ওই অঞ্চলের এক কুখ্যাত ডাকাত একজনকে ধরে এনেছে। অপরাধ গোরু চুরি। শাস্তি প্রাণদণ্ড। গাছে বেঁধে লোকে টাঙ্গির কোপ বসাতে যাবে তাকে, সামনে এসে পড়লেন সতীনাথ। বাধা দিলেন। সেই ডাকাতসর্দারও চিনত ভাদুড়ীজিকে। হাতজোড় করে জানাল সব কথা। শুধু তাই নয়, ওই অপরাধে সতীনাথ যা বিচার করবেন তাই মেনে নিতে প্রস্তুত সে।

সতীনাথ বিচার করলেন সেই ঘন অন্ধকারে মশালের আলোয়। সামান্য কিছু জরিমানার বিনিময়ে প্রাণ রক্ষা পেল সেই গোরুচোরের।

ছোটবেলা থেকেই ছিল ফুল-গাছপালার শখ। যে সে শখ নয়, একেবারে সাংঘাতিক নেশা। কেমন?

দু-চার ঘটনা বললেই বোঝা যাবে।

পূর্নিয়ায় তাঁর বাড়িতে ছিল হাজার রকমের ফুল ফলের গাছ। একবার পরবাস পত্রিকার সম্পাদক আলো রায়, তখন তার বয়স অল্প, বন্ধুবান্ধব সমেত গেছেন সতীনাথের বাড়ি।

রাতে গল্পআড্ডা চলেছে। হঠাৎ সতীনাথ বললেন, ‘‘ফুল ফোটারও শব্দ হয় জানিস। আমি শুনেছি।’’

কেউ বিশ্বাস করল না তার কথা। তাই আবার হয় নাকি?

সতীনাথ বললেন, ‘‘হ্যাঁ হয়। তোদেরও আমি শোনাব। চল আমার সঙ্গে।’’

বলে সকলকে ওই রাতেই নিয়ে গেলেন বাগানে। অঘ্রান মাস। শিরশিরে ঠান্ডা হালকা কামড় বসাচ্ছে শরীরে।

সতীনাথের নির্দেশে সবাই মিলে উবু হয়ে চুপ করে বসে রইলেন একটি নাম-না-জানা ফুলগাছের চারপাশে।

চারদিক নিঃশব্দ। কারও টুঁ শব্দ করারও অনুমতি নেই। সবাই ঢিবঢিবে বুক নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে সেই গাছের কুঁড়ির দিকে। এর পরের বর্ণনা পড়া যাক আলো রায়ের লেখা থেকে, ‘‘ঠিক মধ্যরাতে পাপড়ি খুলল ফুলের। তারার আলোয় সয়ে যাওয়া চোখে দেখলাম প্রকৃতির কারসাজি। কুঁড়িটা খুলল প্রাণভরা ফুল হয়ে।

‘শুনলি!’ সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন সতুদা। হাতের বড় টর্চটা জ্বালিয়ে দিলেন।

‘না তো!’ জবাব দিলাম সবাই। ‘দেখলাম ফুটতে কিন্তু...’

সতুদা বললেন, ‘যখন পাপড়িগুলো মেলে ধরছিল ফুলটা...তখন ঢিবঢিব করছিল কি না বুকের ভেতর!’

‘হ্যাঁ ভিতরে বাজছিল ড্রামের মতো...’

‘ওটাই! ওটাই ফুল ফোটার শব্দ রে। মন দিয়ে যখন বুঝতে পারবি, ফুল ফোটার শব্দ বুকেই জন্মায়। অন্তত জন্মানো উচিত।’’’

শুধু কি গাছপালা ফুলফল? পোকামাকড় থেকে পাখি— সব কিছুর প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি। বাগানে কবে কোন পাখি আসে, তাও ছিল তাঁর নখদর্পণে। তার সাক্ষীও গোপাল হালদার। একবার সকাল আটটা-ন’টা নাগাদ বারান্দায় বসে গোপালবাবুর সঙ্গে গল্প করছেন সতীনাথ। হঠাৎই চুপ করে গেলেন। কান খাড়া করে কী যেন শুনে গোপালকে বললেন, ‘‘শুনতে পাচ্ছ?’’

গোপাল শুনলেন, সতীনাথের বাড়ির বিশাল গাছগুলোর আড়াল থেকে কোনও একটি পাখির ডাক। বললেন, ‘‘হ্যাঁ একটা পাখি ডাকছে বটে।’’

তখনই একমুখ হেসে সতীনাথের উত্তর, ‘‘এইবছর পাখিটা ন’দিন আগে এল। গত বছর এসেছিল অমুক তারিখে (নয়দিন পরের তারিখ), তার আগের বছর এসেছিল...তার আগের বছর...এই করে সেই পাখিটা আসার পর পর তিন চার বছর আগের দিনক্ষণ পুরো মুখস্ত বলে গেলেন সতীনাথ। যেন বাড়ির ছেলেমেয়ের জন্মের তারিখ বলছেন!

চরিত্রটিও ছিল পাকা বাঁশের মতো ঋজু। কিন্তু তাই বলে কি কোনও দিন প্রেম এসে ধরা দেয়নি? দিয়েছিল। একবারই। লেখক তখন প্যারিসে। এমনিতে বরাবর মহিলাদের সংস্পর্শ থেকে শতহস্ত দূরে। বিশেষ করে বিদেশিনী হলে তো কথাই নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন মায়ায় জড়াল প্যারিসের এক হোটেল পরিচারিকার সঙ্গে। নাম অ্যানি। ভ্রমণ ডায়েরিতে সতীনাথ লিখেছেন অ্যানিকে নিয়ে। তবে তৃতীয় পুরুষে, ‘‘একসঙ্গে বেশিক্ষণ ভাবতে পারা যায় কেবল অ্যানির কথা। আর অ্যানির কথা ভাবতে গেলেই দেখে যে, তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে, নিজের কথাও। চেষ্টা করেও আলাদা করা যায় না।’’

অ্যানির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিলেন নিজের জীবন, স্বপ্ন। তাঁকে ভারতবর্ষে নিয়ে এসে বিয়ে করবেন এত দূর ভাবনাও এসেছিল মনে, কিন্তু জানতেন না অ্যানির স্বামী আছে, একটি পুত্র আছে। জানতে পারলেন যখন অ্যানির ছেলে পোলিওতে মারা গেল। ছেলের মৃত্যুশোকে পাগল হয়ে গেলেন মা। সতীনাথ দেশে ফিরে এলেন একা একা।

প্রান্ত যৌবনে

দেশ স্বাধীন হল। তত দিনে তিনি কংগ্রেস মহলে, সাধারণ মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয়। মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব এল। সরাসরি বললেন, না। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার জন্য তিন-তিনবার জেলখাটা সতীনাথ অবলীলায় সরে এলেন রাজনীতি থেকে। বন্ধুরা-পরিচিতরা অবাক। প্রশ্নে উত্তর দিলেন, ‘‘আর কী দরকার? দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেছিলাম, স্বাধীন হয়ে গেছে, এবার রাজনীতিতে থাকলে ক্ষমতার লোভ আসবে মনে!’’

আবার ফিরে গেলেন গাছে ঘেরা নিজের সেই বাড়িতে। এবার সঙ্গী হল ‘পাহারা’ নামের একটি দেশি কুকুর আর ‘বাবাজি’ নামের এক পাচক। এদের দু’জনকে নিয়েই তখন ছিল তাঁর সংসার। এঁরাই তাঁর সারাক্ষণের বন্ধু। লোকজন আর তেমন পছন্দ ছিল না।

শরীরটা ভাল যাচ্ছে না একেবারে। নিজে সব জানেন কী হয়েছে, কিন্তু কাউকে কিচ্ছু জানান না। ‘বাগানিয়া’ সতীনাথ ডায়রি লেখেন। কী ভাবে বাগান করতে হয়, কোন গাছকে কী ভাবে ভালবাসতে হয়, বাগানের মাটি কী ভাবে তৈরি করতে হবে।

১৯৬৫ সালের ৩০ মার্চ। আগের দিনই দাদা ভূতনাথ চিঠি পেয়েছেন সতীনাথের। চিঠিতে ভাই লিখেছে, ‘আমি ভাল আছি।’

আর তার পরের দিন সকালে বাবাজিকে বাজারে পাঠালেন ভাল পাবদা মাছ আনতে। বাবুর জন্য জলখাবার টেবিলে রেখে বাবাজি গেল বাজারে।

শরীরটা আজ যেন বড় বেশি আনচান করছে। হাতে জাগরীর ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য ভিজিল’ নিয়ে পায়চারি করতে বেরোলেন নিজের শখের বাগানে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল বাবাজি। দেখে জলখাবার টেবিলেই পড়ে রয়েছে। বাবু গেলেন কই? মন কু ডাকল তখনই। ছুটে গেল সে বাগানের দিকে।

সতীনাথ মুখ গুঁজে পড়ে আছেন তারই হাতে তৈরি এক ফুলগাছের নীচে। নাকে মুখে রক্ত। আর সাধের সারমেয় ‘পাহারা’ তখনও কিছুই না বুঝে বসে রয়েছে মনিবের থেমে যাওয়া শরীরকে ঘিরে!

ঋণ: সতীনাথ ভাদুড়ীর নির্বাচিত রচনা, সতীনাথ ভাদুড়ী (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়), শতবর্ষে সতীনাথ ভাদুড়ী- এই পরবাস, সতীনাথ সংখ্যা-কোরক সাহিত্য পত্রিকা, সতীনাথ ভাদুড়ী স্মরণ সংখ্যা-বোধ সাহিত্য পত্রিকা, সতীনাথ ভাদুড়ী সংখ্যা-দিবারাত্রির কাব্য, সতীনাথ ভাদুড়ী সংখ্যা-মহাযান সাহিত্য পত্র

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy